দান্তের দোজখ?

কবি দান্তের দোজখ খুব বিখ্যাত, এমন সুপরিকল্পিত শোচনীয় এলাকা আর পাওয়া যাবে না। উত্তর গোলার্ধের মাটির নিচে অবস্থিত দান্তের দোজখ, একটি বিশাল চোঙের মতো আকৃতি তার, যার নিচের দিকটা ক্রমশ সরু হয়ে পৌঁছে গেছে পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দুতে। ওই দোজখকে চব্বিশটি বৃত্তাকার স্তরে ভাগ ক’রে তিনি শাস্তির ব্যবস্থা করেছেন পাপীদের। পাপী অনেক; তবে পাপের পরিমাণ বেশি নয়। দান্তের কাছে পাপ মাত্র তিন রকম। প্রথম পাপ হচ্ছে অদম্য ক্ষুধা বা লিপ্সা; তার দ্বিতীয় পাপ বিকৃত ক্ষুধা বা সন্ত্রাস; আর তৃতীয় পাপ হচ্ছে প্রতারণা। পাপগুলোকে আজকের মানদণ্ডে পাপের মতো লাগছে না; পুণ্য ব’লেই মনে হ’তে পারে অনেকের কাছে। দান্তের পাপীরাও বিখ্যাত। তিনি বহু অমরকে স্থান দিয়েছেন দোজখে। তাদের জন্যে শান্তির যে-ব্যবস্থা করেছেন, তা রোমহর্ষক। শাস্তি উদ্ভাবনের জন্যে মহাকবির কল্পনা প্রতিভার সাহায্য নিতে হয়েছে দান্তেকে; এমন সব শাস্তির ব্যবস্থা করেছেন, যার বিবরণ প’ড়ে শিউরে উঠতে হয়। তবে আজকাল অনেকে শিউরে উঠতে নাও পারে। বিশেষ ক’রে আমাদের পক্ষে শিউরে ওঠা সহজ নয়। আমরা যে-সময়ে ও দেশে রয়েছি, সেখানে ওসব দণ্ডকে কঠোর মনে না হওয়ারই কথা। দান্তে তিন মুখের কুকুরের ব্যবস্থা করেছেন, ফুটন্তু রক্তের নদী বইয়ে দিয়েছেন, পাপীদের পাথরচাপা দিয়েছেন। তিনি এমন অনেক পাপের কথা বলেছেন, যেগুলোকে আজকাল প্রতিভা ব’লেই মনে হ’তে পারে। বাঙলাদেশে বাস ক’রে কি বার বার দান্তের দোজখের কথা মনে পড়ে না? মনে কি হয় না যে দোজখেই বাস করছি আমরা, প্রতিদিন ভোগ করছি দোজখের যন্ত্রণা, যা দান্তের পাপীরাও ভোগ করে নি? ছেলেবেলায় বাঙলা নামের একটি ‘সব পেয়েছি’র দেশের রূপকথা শুনেছি। গলাভরা গান আর গোলাভরা ধানের কিংবদন্তি শুনেছি। একটি স্বর্গ কি ক’রে দোজখে পরিণত করতে হয়, তা আমরা দেখিয়েছি। এখন এমন কোনো অভাব নেই, যা এখানে নেই। এমন কোনো দুর্ঘটনা নেই, যা আমরা ঘটাই না। এমন কোনো পাপ নেই, যা আমরা করি না। এমন কোনো অপরাধ নেই, যা আমরা প্রতিদিন সম্পন্ন করি না। দান্তের দোজখে ওই সব অপরাধ নেই, পাপ নেই, দুর্ঘটনা নেই। গত এক দশকে আমরা এসবের এমন বিকাশ ঘটিয়েছি যে আমাদের ভূখণ্ডটি যে-কোনো নরকতত্ত্ববিদের কাছে অত্যন্তু আকর্ষণীয় ব’লে বিবেচিত হবে। আমাদের ‘স্বাধীন ও সত্যভাষী’ পত্রিকাগুলোতে সব সংবাদ প্রকাশ পায় না। কিন্তু প্রতিদিন স্তম্ভে স্তম্ভে যেটুকু মুদ্রিত হয়, তাই যে কোনো মানুষকে পাগল করার জন্য যথেষ্ট। এখন সুস্থ মানুষ পাওয়াও ভাগ্যের কথা। আমরা যে একে অপরকে কথায় কথায় পাগল বলি, এটা হয়তো মিথ্যা নয়; যে-পরিবেশে বাস করছি, তাতে যদি পাগল না হই, তাহলে আমাদের মনুষ্যত্ব সম্পর্কেই সন্দেহ করতে হবে। এ-পরিবেশে যারা সুস্থ, তারা মানুষ নয়; পশুও নয়। তার চেয়েও ইতরতর কিছু।

এখানে যা কিছু ঘটতে পারে। প্রজ্বলিত রেলগাড়ি শাঁ শাঁ ক’রে ছুটতে পারে, লাফিয়ে পড়তে পারে ধানখেতে; এখানে বাস ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে নদীতে, শিশুবিদ্যালয়ে আগুন লাগিয়ে দিতে পারে মাস্তানরা, শৃঙ্খলারক্ষীরা ধর্ষণে মেতে উঠতে পারে, একটি টাকার জন্যে খুন হতে পারে একটি নিস্পাপ শিশু, ছাত্রাবাস হয়ে উঠতে পারে অস্ত্রাবাস, প্রেমিক অভিসারে গিয়ে প্রেমিকাকে ধর্ষণ ক’রে খুন করতে পারে। মাত্র এক সপ্তায় সোনার বাঙলায় কী ঘটতে পারে তার এক খণ্ডাংশ যদি সংগ্রহ করি পত্রিকার পাতা থেকে, তবে অনেকেই আতংকিত হবেন। পত্রিকার পাতা থেকে কিছু শিরোনাম তুলে দিচ্ছি। ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি হল থেকে বিপুল অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার’, ‘সিলেটে তরুণ ব্যবসায়ী খুন’, ‘ধর্ষণের দায়ে পুলিশ অফিসার গ্রেফতার’, ময়মনসিংহে দু’ব্যক্তি খুন’, ‘তিনটি সড়ক-দুর্ঘটনায় নিহত ৪ আহত ৩২’, ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি হল থেকে অস্ত্র উদ্ধার’, ‘দু-স্ত্রী ঘরে রেখে বৃদ্ধের ষোড়শীর পাণিগ্রহণ’, ‘১৭ বছরে সোয়া লাখ লোক আত্মহত্যা করেছে’, ‘নগরীতে ডাকাতি’, ‘কক্সবাজার ও যশোরে সড়ক ডাকাতি’, ‘আদমজিতে শ্রমিকের রহস্যজনক মৃত্যু’,’বরিশালে পাঁচ সন্তানের জননী ধর্ষিত’, ‘বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে খুলনায় সোয়া লাখ টাকা ছিনতাই’, ‘মেঘনা নদীতে যাত্রীবাহী লঞ্চে দুর্ধর্ষ ডাকাতি’, ‘২২টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১৮’, ‘নড়াইলে এক মাসে ১৩ জনের অস্বাভাবিক মৃত্যু’, ‘বস্তাবন্দী তরুণের লাশ উদ্ধার’, ডেমরায় ট্রাক উল্টাইয়া ৩ জন নিহত’, কিশোরী এসিড দগ্ধ, কুলসুমের শ্বাসরুদ্ধ করিয়া মারা হইয়াছে, টাঙ্গাইলে হত্যার দায়ে ১ জনের মৃত্যুদণ্ড, ইঞ্জিনচালিত নৌকা দুর্ঘটনায় ২৮ জনের প্রাণহানি, নিদারাবাদের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের দায়ে আরও একজন গ্রেফতার, রাজধানীতে পুলিশের দুটি রাইফেল ছিনতাই, এস, এস সি পরীক্ষার দুটি ভুলে ভরা মার্কশীট, ‘ভিডিপি সম্পাদিকরা ওপর পৈশাচিক নির্যাতন, চাকুরির লোভ দেখিয়ে পতিতালয়ে বিক্রি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হত্যা; দুইজন পুলিশ অফিসার সাসপেন্ড, নারী পাচারকারীসহ ১১ জন গ্রেফতার’, ‘মেডিকেল অফিসারের বাসা থেকে রক্তমাখা প্যান্ট উদ্ধার’, সাতক্ষীরায় ১৮ জন তরুণীসহ ৪৯ জন উদ্ধার, চট্টগ্রামে ব্যাগভর্তি ৩ লাখ টাকা উধাও। কয়েকদিনের কয়েকটি মাত্র শিরোনামেই দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। সব দুর্ঘটনা ধরা পড়েনি, সব অপরাধ শিরোনাম হয় নি, সব পাপ খবরের কাগজে প্রকাশ পায় নি। প্রকাশ পেয়েছে খুবই সামান্য। পৃথিবীর কোনো দেশে এতো অপরাধ ঘটে না, আমেরিকায়ও ঘটে না এতো দুর্ঘটনা। এসব প্রকাশ্য অপরাধ-দুর্ঘটনা-পাপ আমাদের সমাজের অপরাধ-পাপের তুচ্ছ অংশ। ওপরের তলায় ওই সপ্তাহে যা ঘটেছে, তার কিছুই সংবাদপত্রে আসে নি। যদি আসতো তাহলে হয়তো পুরোপুরি পাগল হয়ে যেতে হতো। দান্তের দোজখও এতো মর্মান্তিক নয়।

এসব থেকে দুটি জিনিস খুব স্বচ্ছরূপে ভেসে ওঠে। একটি হচ্ছে রাষ্ট্রযন্ত্র পুরোপুরি বিকল; অন্যটি হচ্ছে দেশ থেকে সব রকমের নৈতিকতা বিদায় নিয়েছে। রাষ্ট্র অধিবাসীদের ভাত দিতে পারছে না, কাপড় দিতে পারছে না; এমনকি হাজার হাজার উর্দিপরা শৃঙ্খলাবিধায়ক থাকা সত্ত্বেও দিতে পারছে না ন্যূনতম নিরাপত্তা। সড়কে নিরাপত্তা নেই, গৃহেও নেই; জলে নেই, স্থলভাগেও নেই। বিকল হয়ে পড়েছে সব কিছু। রাষ্টযন্ত্র দেশবাসীকে করে তুলেছে দান্তের দোজখের অধিবাসী। নৈতিকতাও কোনো অলৌকিক ব্যাপার নয়; কোনো পুণ্যগৃহ বা গ্রন্থ থেকে নৈতিকতাও মানুষের মধ্যে সংক্রামিত হয় না। ভালোমন্দের ধারণাও সামাজিক, রাজনীতিক, রাষ্ট্রিক। রাষ্টযন্ত্ৰ বাঙলার অধিবাসীদের ভালোমন্দের বোধও নষ্ট ক’রে ফেলেছে। অথচ মৌখিক নৈতিকতার ছড়াছড়ি চারপাশে। পীরে দেশ ভরে গেছে, মুরিদ উপচে পড়ছে নামাজ রোজা-আজান-হজ সম্প্রচারিত হচ্ছে রঙিন ক’রে, কিন্তু চারপাশে অনৈতিকতা। কোনো সমাজ যখন অন্তরে অনৈতিক হয়, তখন মৌখিক নৈতিকতার বাড়াবাড়ি করে। বাঙলাদেশে এখন তাই হচ্ছে। সোনার বাংলা বলতে এখন ঠোঁট জড়িয়ে আসে, ধান আর গানের গল্প হাস্যকর মনে হয়। শুধু দান্তের দোজখের রূপ মনে পড়ে।