ধ্বংস ও সৃষ্টি

আশাবাদী অনুরাগীরা অভিযোগ করেন মাঝেমাঝে আমি নাকি অনবরত হতাশা ছড়িয়ে চলছি দু-হাতে। একবার সুড়ঙ্গের পরপারে আশার আলোর কণিকার কথা বলছি না; আমি নাকি ভেঙে চলছি চারপাশ, ভেঙে ফেলছি সব কিছু কিন্তু কিছু গড়ছি বা সৃষ্টি করছি না। এক তরুণ তো আমাকে দেশের প্রধান নৈরাজ্যবাদী আখ্যা দিয়ে সম্মানিত করেছেন। আশার কথা আমি বলি না, কেননা আশা করার মতো কিছু দেখতে পাই না; খুব গভীরে ডুব দিয়ে আশার নুড়ি খুঁজি অনেক, মুঠোতে একটি নুড়িও ওঠে না। আশার কথা না বলার একটি দার্শনিক কারণও রয়েছে;- আশাকে আমার বেশ স্থুল ব্যাপার বলে মনে হয়, হতাশাকে মনে হয় অনেক গভীর ও সত্য। মানুষের চরম পরিণতি তো হতাশা; যেখানে কবরে বা আগুনে সমাপ্তি সব কিছুর, ধ্বংসই শেষ কথা, সেখানে আশাকে খুবই হাস্যকর মনে হয়। আশা প্রতারণা করে, হতাশা করে না। আমাদের এখানে আশার ফেরিঅলার অভাব নেই, আর সারা পৃথিবীতেই সময় বুঝে আশার ফেরিঅলারা বড়োবড়ো দোকান খুলে বসে (বিশশতক শেষ হ’তে বসেছে, শতকের শেষভাগে নানা রকম রোগ দেখা দেয়; এই সমস্ত রোগের একটি হচ্ছে আশা-রোগ। এক প্রতারক মার্কিন দম্পতি এর মাঝেই বড়োসড়ো বই লিখে ফেলেছেন আগামী শতক সম্পর্কে, বইয়ের পাতায় পাতায় দেখিয়েছেন আশার রঙিন স্বপ্ন; বই খুব বিক্রি হচ্ছে, কয়েক মিলিয়ন ডলার বই প্রকাশের কয়েক সপ্তাহেই জমা হয়েছে তাদের ব্যাংকহিসেবে; তবে ওই স্বপ্নগুলো সবটাই বানানো। টাকা বানানোর জন্যে তারা ফেঁদেছেন আশার ফাঁদ, আর তাতে ধরা দিচ্ছে নিরীহ আশাবাদী সরল মানবপাখিরা। আশার একটি বই লিখে ফেলতে পারি আমরাও;- কোনো পণ্য লেখক সাতদিনে একটি আশার বই লিখে পাগল করে দিতে পারেন আশাহীন বাঙালিকে, ভ’রে তুলতে পারেন নিজের থলে। তবে সত্য হচ্ছে আমাদের আশার কিছু নেই, সত্য হচ্ছে ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থাকা বা ম’রে যাওয়া। আমি নাকি ভাঙছি প্রচণ্ডভাবে। ভেঙে ফেলছি নানা রকম মহৎ বিশ্বাস, বড়োবড়ো ভাবমূর্তি চুরমার করছি, একাডেমি ভাঙছি, বিশ্ববিদ্যালয় ভাঙছি, রাজনীতিক দলগুলো ভাঙছি; কিন্তু গড়ছি না, সৃষ্টি করছি না। আমি কোনো মহৎ বিশ্বাস উপস্থিত করছি না তরুণদের সামনে, তাদের বলছি না এতে বিশ্বাস রাখো তোমরা, সব বিপদ কেটে যাবে। বরং আমি নাকি বিশ্বাসের মোটামোটা স্তম্ভগুলো সম্পর্কে অবিশ্বাস জাগিয়ে চলছি। পৃথিবী জুড়ে আছে অসংখ্য ভাবমূর্তি; আমাদের দেশি ভাবমূর্তিরও অভাব নেই। ওই সব ভাবমূর্তির নাম ধ’রে শ্লোগান দিয়ে জীবন ধারণ করি আমরা কিন্তু আমি ওসব ভাবমূর্তি চুরমার করছি। বিদ্রোহীকে আমি স্বীকার করছি না বিদ্রোহী ব’লে, মনীষীকে সামান্য ব’লে উপস্থিত করছি, পণ্ডিতের লাশ খুঁড়েখুঁড়ে দেখিয়ে দিচ্ছি তাঁদের নিরক্ষরতা। একটি ব্যাংকের মতো একাডেমি গড়েছিলাম আমরা, বিশ্ববিদ্যালয়ে পুষছিলাম জ্ঞানী অধ্যাপক; কিন্তু এক ভোরে নীলাকাশ থেকে বজ্রপাত নেমে এলো। ধসে পড়লো একাডেমি আর বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানীরা। আমি নাকি একটি রাজনীতিক দলকেও অনুমোদন করছি না; এতো দল আমাদের, কিন্তু একটিকেও ভাবছি না সম্ভাব্য ত্রাতা হিসেবে। সংস্কৃতি জগতে অনেকে বেশ ক’রে খাচ্ছেন, অনেকে ব্যবসা করছেন প্রগতির, সম্মানিত হচেছন দিকে দিকে, কিন্তু আমি চলছি তাঁদের মহিমা হরণ ক’রে। শুধু ভাঙছি, এবং ভাঙছি এবং ভাঙছি; কিছুই সৃষ্টি করছি না, গড়ছি না। আমি যখন তাকাই আমাদের সমাজ-রাষ্ট্র-সভ্যতার দিকে, তখন তাকে একটি নড়োবড়ো কুঁড়েঘর বলে মনে হয়;- তার চালে পচন ধরেছে, বেড়ায় পচন ধরেছে, থাম নড়োবড়ো হয়ে গেছে, ভিটে জুড়ে অসংখ্য ইদুরের গর্ত। এমন একটি কুঁড়েঘরকে ঠ্যাকা লাগিয়ে টিকিয়ে রাখার চেয়ে ধ্বংস ক’রে ফেলাই ভালো। তাকে ধ্বংস করাই এক ধরনের সৃষ্টি।

আমরা এখন ইতিহাসের এমন একটি মলমাস পেরোচ্ছি, যা সৃষ্টির সময় নয়, বরং ধ্বংসেরই সময়। এখন ধ্বংসই সৃষ্টি। আমাদের কোনো কাজে মহত্ত্ব নেই, আমরা সভা ও মানুষের কথা ভাবি না, মানুষের ভেতরে যা সবচেয়ে আদিম, সবচেয়ে পাশবিক, আমরা তারই সমষ্টি। আমাদের কুঁড়েঘরের চাল, বেড়া, খাম, ভিটি লক্ষ্য করলে ছুঁচোদের ক্রিয়াকলাপের কথাই মনে পড়ে। জীবন ও সৃভ্যতার প্রধান নিয়ন্ত্রক যে-রাজনীতি, তা পুরোপুরি নষ্ট আমাদের। কোনো দলের ওপরই পুরোপুরি আস্থা পোষণ করা অসম্ভব; কোনো দলেরই কোনো লক্ষ্য নেই; প্রতিটি দলের লক্ষ্য ক্ষমতা ও অর্থ। পশ্চিমের পুঁজিবাদী দেশগুলোতে রয়েছে সামাজিক রাষ্ট্রিক নৈতিকতা, ব্যক্তিক নৈতিকতাও তাদের কম নয়, আমাদের এখানে সামাজিক রাষ্ট্রিক ব্যক্তি নৈতিকতা পুরোপুরি অনুপস্থিত। নীতির কোনো চিহ্নও চারপাশে দেখতে পাই না। নৈতিক অধঃপতন আমাদের কতোটা অতলস্পর্শী, তার পরিচয় পাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির গৃহীত একটি প্রস্তাবে। প্রস্তাবে গৃহীত হয়েছে যে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের গাড়ির জীবনবীমা করে দেবে; যে-একজন শিক্ষদের গাড়ি পোড়া গেছে, তাঁকে একটি নতুন গাড়ি কিনে দেয়া হবে। কী নৈতিক অধঃপতন! যেখানে ছাত্র নিহত হচ্ছে মাসে মাসে, জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর, অধিকাংশ শিক্ষককে আবাসিক সুবিধা দিতে পারছে না বিশ্ববিদ্যালয়, অনেক শিক্ষক বাস করেন বস্তিতে, গ্রন্থাগারে নেই বই, সেখানে প্রস্তাব নেয়া হচ্ছে গাড়ির জীবনীমার ও নতুন গাড়ির। গাড়ি আছে ক’জন শিক্ষকের? এখানে শিক্ষকছাত্রের জীবনের বীমা নেই, কিন্তু গাড়ির জীবনের বীমা আছে। এমন অনৈতিকতাকে কী ক’রে টিকিয়ে রাখি, একে ধ্বংস করাই তো সৃষ্টি। আমাদের সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকলাপের জগতটি ভ’রে গেছে বিভিন্ন তালবাজে;- শিল্পীর তুলিতে সৃষ্টি হচ্ছে না নতুন শিল্পকলা, নর্তকনর্তকী নাচ আটকে রাখছে হাজার বছর পেছনে, কবিতা উপন্যাস নাটক প্রবন্ধ ভ’রে গেছে বন্ধ্যাত্বে; কিন্তু একেই কি রাখতে হবে টিকিয়ে, স্তব করতে হবে এরই মহিমা? ব্যক্তির জীবনে যেমন নিস্ফলা সময় আসে, জাতির জীবনেও আসে তেমনি। কোনো জাতিই সময়ের প্রতিটি স্তরে সৃষ্টিশীল থাকে না, অনেক সময়ই থাকে অনাসৃষ্টিশীল। আমরা এখন তেমন একটি পর্যায়ে রয়েছি। এখন পুরোনোকে, অন্তঃসারশূন্যতাকে, প্রথাকে, মিথ্যা ভাবমূর্তিকে ভেঙে ফেলাই সৃষ্টি। অসংখ্য ছানিতে আমাদের চোখ ভরে গেছে, চোখ থেকে এখন নির্মমভাবে তুলে ফেলতে হবে ছানির অসংখ্য স্তর, তারপর তাকাতে হবে নতুন চোখে। তখন আসবে সৃষ্টির সময়। তখন রাজনীতি হবে সৃষ্টিশীল, সংস্কৃতি হবে সৃষ্টিশীল, ফিরে পাবো নৈতিকতা বা সৃষ্টি করবো নতুন পরিশুদ্ধ নৈতিকতা, শিল্পের সমস্ত শাখায় তখন দেখা দেবে নতুন সৃষ্টির শিহরণ। এখন যারা পুরোনোকে, প্রথাকে, মিথ্যে ভাবমূর্তিকে ও শ্লোগানকে, নষ্ট শিল্পকলাকে, কপট প্রগতিশীলতাকে সমর্থন করে যাচ্ছে, তারাই আসলে কাজ করছে নতুন সৃষ্টির বিরুদ্ধে। আমাদের সমাজ খুবই প্রথাগত, প্রথার জয়গানে এর রক্তমাংস জীর্ণ হয়ে গেছে। জয়গানের বদলে এখন প্রশ্ন করা দরকার, বার বার দরকার প্রশ্ন করা, কোনো কিছুকেই আর বিনা প্রশ্নে উত্তীর্ণ হতে দেয়া ঠিক হবে না। তবে এখানে প্রশ্নের বড়োই অভাব। এখানে বিদ্রোহীও ব্যক্তিগত জীবনের তোষামোদপরায়ণ; কবিতায় যিনি সব কিছু ভাঙার ধ্বনি দেন, তিনিও ব্যক্তিগত জীবনে প্রভুর কৃপা ভিক্ষা করেন। তাই এখানে প্রথা ধ্বংস হয় না, টিকে থাকে; সময় আসে না নতুন সৃষ্টির। এখন ধ্বংস করে যেতে হবে, এ-সময়ে ধ্বংসই সৃষ্টি। এরপর আসবে পুরোপুরি সুষ্টির কাল। অন্যরা যখন পুরোনো শ্লোগানে মেতে আছেন, আমি সব সৃষ্টির জন্যে ধ্বংস করে চলেছি। একদিন দেখতে পাবো এ-কুঁড়েঘরের সব কিছু ধসে পড়েছে। তারপর আসবে অবিরল সৃষ্টির সময়।