একাকী কোরাস

কেবল কবিই বেরুতে পারে নিরুদ্দেশে;
নীলিমামাতাল লাল নৌকো নিয়ে অধীর উম্মাদ সব চিরনিরুদ্দেশ
নাবিকের মতো, ছুঁড়ে ফেলে নকশাকম্পাশকাটা, বেরিয়েছি
গন্তব্যবিহীন। যদিও সময় আজ উপযুক্ত নয় সমুদ্রযাত্রার।
নাবিকেরা দলেদলে সমুদ্রভীতিতে ভোগে: সৈকত-নীলিমা-ঢেউ
সবই শুনেছে তারা লোকজশ্রুতিতে। স্বপ্নেও তাদের
সমুদ্র রূপান্তরিত হয় সুশান্ত ডোবায়- নরম শয্যার কথা মনে পড়ে;
আর্ত চিৎকারের মতো সর্বাঙ্গ জড়িয়ে ধরে সামুদ্রিক অসুস্থতা।
সহচর নৌকো, উদ্দেশ্যশূন্যতার মহাকবি, আর আমি
ভেসে যাই স্বপজলে; দূর তীর ঘিরে আছে ১৯৭৯টি স্বপ্নের অভাব।
সদ্ভাব হয় নি কারো সাথে, মাটির ভেতরে গেছি
সরল শিকড় হ’য়ে গোপন রসের ধারা মুখে;
ওই পাললিক মাটি বাড়িয়েছে মড়ার হাড়ের মতো শুষ্ক ডাল,
নিষ্প্রাণ ছোবার মতোন সব কিমাকার ফুল।
আমি গূঢ় মহাদেশে কালো জলধারা খুঁজে ব্যথিত স্বরের মতো
সাজিয়েছি আমার রোদন।
সমগ্র ভূভাগব্যাপী মলবাহ, পুনরাবৃত্ত মল, আর মলের শোধন।

তোমার স্বরের চাপে কাঁপে যবনিকা
বিশাল প্রদীপ জ্বলে সীমাশূন্যতায়
তোমার শাণিত হাসি আগুনের শিখা
দাউদাউ জ্ব’লে উঠে ইশারা জানায়

একটি বিষাক্ত ক্ষত ক্রমশ বাড়ছে দ্রুত, ঢেকে দিচ্ছে নিসর্গনীলিমা:
গোপন অঙ্গের ক্ষত যে-রকম ক্রমে বাড়ে গ্রাস করে সমগ্র শরীর।
হলদে ময়লা পুঁজ করছে দখল শরীর-ভূভাগ।
বান্ধবেরা, দয়িত ও দয়িতারা, সন্তান, স্বপ্নেরাপুলক, বৃক্ষরা,
ছাত্ররা, রাষ্ট্রপতি, বিচারপতিরা, মূল-ও উপ-পতি ও
-পত্নীরা, অধ্যাপক, সচিবেরা, কেরানি, আচার্য ও
উপাচার্যরা, দালাল, জনতা, নেতারা, কবিতা, পাঠ্য-ও
অপাঠ্য-পুস্তক, যাদু ও বিজ্ঞান, শ্রমিকেরা, কৃষকেরা,
একটি বিশাল ক্ষতে ঢুকে যাচ্ছে, পুঁজ হ’য়ে গলিত মাংসের
থেকে ঝরছে প্রত্যহ। ভিখিরি যেমন বিশুদ্ধির প্রত্যাশায়
রৌদ্রে তুলে ধরে সংগোপন ক্ষত, জিহ্বায় শোষণ
করে ক্ষতস্থল, প্রয়োজন স্বপ্ন-রৌদ্রের শোষণ।

এদেশ বদলে যাবে, বদলে দেবে শ্রমিকেরা, অতীন্দ্রিয় ছাপ্পান্নো হাজার
বর্গমাইল শুদ্ধতা পাবে মিলিত মেধায়। পরিশুদ্ধি পাবে সব কিছু,
পদ্যপুঞ্জ পুনরায় উঠবে কবিতা হ’য়ে, পরিশুদ্ধ পাঁচটি স্তবকে
শুদ্ধি পাবে সমগ্র রবীন্দ্রকাব্য, একটি ধ্বনিতে ছেঁকে তোলা হবে ঐশী
গীতবিতানের স্বরমালা। যেতে হবে অপেক্ষমান যেখানে ভয়াল মৃত্যু,
নয়তোবা বিশাল বিজয়। জ’মে যাই তীব্র শীতে জ্ব’লে উঠি তীক্ষ্ণ
উত্তাপে- আমার সামনে কোনো মধ্যপথ ছিলো না- থাকবে না।

উত্তাল উদ্দাম জল, জলরেখা; বিশাল পদ্মের ন্যায় দিগ্বলয়;
ক্ষয় হ’য়ে গেছে তীর দৃষ্টি থেকে,
রহস্যপ্রসবা টেনে নেয় আমাদের।
একটি অদৃশ্য পাখি সঙ্গ দেয়, ডানায় বহন ক’রে
সামুদ্রিক ঢেউ। শরীর-সমুদ্র-ঢেউ এভাবে মিলিত আজ

রক্তে গেঁথে নিচ্ছি সমুদ্রসাগর: চিরদিন
দুলে যাবে সমগ্র শরীরে।
নৌকো ছুটে চ’লে মহাদেশ সাড়া দেয় জলের অতলে।
জ্ব’লে ওঠে রহস্যপ্রদীপ: বস্তুর ভেতরে দৃশ্য স্বপ্নের নির্মাণ;
ফোটে রহস্যকুসুম: শত দলে নৃত্যরত পদ্মের মতোন পদধ্বনি;
পাখা মেলে রহস্যশাবক: ডানার পালকে কাঁপে সমুদ্রের স্বর।
অবলীলায় আঙুল গাঁথে শূন্যতার সাথে শূন্যতাকে,
অর্ধেক শিখায় উদ্ভাসিত হ’য়ে ওঠে মহাকাল,
মহাকবি নৌকো ছোটে, একটি অদৃশ্য হাত
বিশাল আকাশ জুড়ে মেলে দেয় স্তরেস্তরে দিগন্তের পাল।