হরতালের অর্থনীতি ও বিকল্প ভাষা

দেশে গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতা সম্পর্কে আমার গভীর সন্দেহ ছিলো; কিন্তু সম্প্রতি ওই সন্দেহে একটু ফাটল ধরেছে, দেখতে পাচ্ছি দেশে বিস্ময়করভাবে কিছুটা গণতন্ত্র আর বাকস্বাধীনতার পুনর্জন্ম ঘটেছে। কিছুকাল আগেও ‘হরতাল’ শব্দটি নিষিদ্ধ ছিলো, তার পত্রপত্রিকায় মুদ্রিত হওয়ার অধিকার ছিলো না; এখন শব্দটি বড়ো অক্ষরেও ছাপা হচ্ছে। আগে এর সুভাষণ বা বিকল্প ভাষণ ছিলো ‘কর্মসূচী’। এ-শব্দটি অন্তত স্বাধীনতা ফিরে পেয়েছে। আগে হরতাল প্রতিরোধের সশস্ত্র ব্যবস্থা নেয়া হতো, সম্প্রতি সরকার আশ্রয় নিয়েছে গণতান্ত্রিক ও মননশীল ব্যবস্থায়। সরকারি গবেষকরা আবেদন জানিয়েছে হরতালের বিকল্প ভাষা উদ্ভাবনের। ‘ভাষা’ শব্দটি বেশ লক্ষণীয়। তারা বলতে পারতো হরতালের বিকল্প উপায় বা ব্যবস্থা বা অন্য কিছুর কথা; তারা হরতালকে একটি ভাষা হিসেবে গণ্য করে ভাষাবিজানের এলাকাকে সরকারিভাবে সম্প্রসারিত করে দিয়েছে। এ-সরকার ‘কবি’র সরকার, অভিনেতার সরকার, এখন দেখছি এটি ভাষাবিজ্ঞানীর সরকারও বটে। অর্থনীতি সব নীতির ওপরে; তাই সরকারি গবেষকরা আর্থনীতিক জুজু দেখিয়েই মানুষকে ভয় পাইয়ে দিতে চেয়েছে। তারা জানিয়েছে একদিনের হরতালে অপচয় ঘটে আড়াইশো কোটি টাকার। শুনে চমকে উঠেছি, আনন্দিত হয়েছি যে বাঙলাদেশে একদিনে আড়াইশো কোটি টাকার কাজ হয়। আড়াইশো কোটি টাকায় কতো কিছু করা যায়, বহু বুড়িগঙ্গা ও যমুনা সেতু বানানো যায়, আড়াইশো কোটি টাকায় হয়তো দশটা বিমান কেনা যায়, পঁচিশটা সোনারগাঁ হোটেল করা যায়, পঞ্চাশটি সৈন্যাবাস বানানো যায়, আড়াইশো মসজিদ নির্মাণ করা যায়, আড়াই হাজার তোরণ তৈরি করা যায়, আড়াই হাজার স্বতঃস্ফূর্ত জনসভার ব্যবস্থা করা যায়, আরো অনেক কিছু করা যায়। একদিনের অপচয়ের টাকা দিয়ে এতো কিছু করা যায়, তবে সারা বছরের সদ্ব্যবহারের টাকা দিয়ে রূপকথার রাজ্য বানানো যায়। সারা বছরে যদি আড়াইশো দিন সদ্ব্যবহার হয়, তাহলে টাকার পাহাড় জমে যাওয়ার কথা। সারা বছরে আয় হওয়ার কথা ষাট হাজার কোটি টাকারও বেশি। নিশ্চয়ই ওই টাকা আয় হয়। তাই প্রশ্ন জাগে ওই টাকা কোথায় যায়? এতো টাকা আয় হওয়ার পর কেনো একটি যমুনা বা বুড়িগঙ্গার সেতুর জন্যে হাত পাততে হয় বিদেশের কাছে, কেনো জাতীয় বাজেট প্রতি বছর পরিণত হয় ভিক্ষার ঝুলিতে? কেনো শ্রমিকদের বেতন এতো কম, কেনো সরকারি কর্মচারীদের বেতনে মাসের দশদিনও চলে না? কেনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এমন দুরবস্থা, কেনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকের এতো অভাব, কেনো বিশ্ববিদ্যালয়ে টাকার অভাবে কোনো গবেষণাই হয় না? এ-হিসেবটা সরকারের কাছে চাওয়ার অধিকার আছে জনগণের। আরো কিছু হিসেবও চাইতে পারে জনগণ। রাষ্ট্রীয় কাজে আর দলীয় কাজে রাষ্ট্রের কতো টাকা অপচয় করেন ব্যবস্থাপকেরা? স্বতঃস্ফূর্ত জনসভার জন্যে কতো ব্যয় হয়, তোরণের পেছনে ব্যয় কতো, বিদেশ ভ্রমণে কতো অপচয় ঘটে, তেলের খনি বিদেশির হাতে তুলে দেয়ায় রাষ্ট্রের অপচয় হয় কত কোটি টাকা? মিহি অর্থনীতিবিদরা হয়তো এর হিসেব রাখেন, তবে সাধারণ মানুষের কাছে তা একটি বড়ো প্রশ্ন হয়ে আছে।

বোঝা যায় হরতাল এখন সরকারকে বিব্রত করে। আগে এ-সরকারকে কিছুই বিব্রত করতো না, এখন সরকার বিব্রত বোধ করার মতো মানসিক অবস্থা আয়ত্ত করেছে। বেশ গণতান্ত্রিক স্পর্শকাতরতা অর্জন করেছে। বিরোধী দলগুলোর রাজনীতিক ক্রিয়াকলাপের চূড়ান্তরূপ হচ্ছে হরতাল। সাতাশিতে ধারাবাহিক হরতালের অশেষ উদ্দীপনা আমরা দেখেছি। ওই হরতাল বাঙলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে গণ্য হবে, তবে তা সফল হয়নি। সত্যিই কি সফল হয়? হরতালের সাফল্য হরতাল হওয়ায়। হরতাল ডাকা হয়েছে, দেশ ভরে হরতাল হয়েছে; দিনের পর দিন হয়েছে। এটা কি বড়ো সাফলা নয়? হরতাল সরকার উৎখাত করতে পারে না, হরতাল পারে সরকারের ব্যর্থতা দেখিয়ে দিতে; হরতাল পারে সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের মনোভাব জানিয়ে দিতে; এর বেশি কিছু পারে না। এর বেশি কিছু পারে তখনি যখন সরকার হয় গণতান্ত্রিক, দায়িত্বশীল, জনগণের মনোভাবের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। যে-সরকার এসব গুণসম্পন্ন নয়, তাকে সারা মাস হতাল করেও হটানো যায় না। হরতালের শর্তই হচ্ছে যার বিরুদ্ধে হরতাল করা হচ্ছে সে গণতান্ত্রিক, মানবিক, দায়িত্বশীল হবে। এককালে অনশন ধর্মঘট সফল হতো; কারণ শক্তিধরেরা জীবনের মূল্যে বিশ্বাসী ছিলো। যারা জীবনের মূল্যেই বিশ্বাসী নয়, যারা বন্দুক চালিয়ে মাঝে মাঝেই থামিয়ে দেয় মানবিক প্রতিবাদ, তাদের কাছে অনশনের কোনো মূল্য থাকতে পারে না। হরতালেরও মূল্য থাকতে পারে না। বাঙলাদেশে হরতাল হয় সফলভাবে, কিন্তু তা ব্যর্থ হয় অন্যভাবে। হরতালের যে-বিকল্প ভাষা বের করার আবেদন জানানো হয়েছে, তার ফল বিপজ্জনক হ’তে পারে। আবেদনকারীরা হয়তো ধ’রে নিয়েছে যে হরতালের বিকল্প হচ্ছে আবেদননিবেদন, কিন্তু তাতো সন্ত্রাসমূলকও হতে পারে। এক নেত্রী সে-কথা এর মাঝেই বলেছেন। হরতাল কী ঘোষণা করে? হরতাল জানিয়ে দেয় যে সরকারের ওপর জনগণের আস্থা নেই, জনগণ গণতন্ত্র চায়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নতুন সরকার গঠনের বাণীই প্রকাশ পায় হরতালে। এ-বাণী পাঠোদ্ধারের শক্তি থাকে না অগণতান্ত্রিক সরকারের। তাদের কাছে নিজেরা ক্ষমতায় থাকার নামই গণতন্ত্র।

সরকার রাজনীতিক হরতালের অর্থনীতি প্রকাশ করেছে, কিন্তু বাংলাদেশে যে একরকম সামাজিক হরতাল সারা বছর চলে, তার অর্থনীতি প্রকাশ করেনি। তাতে দৈনিক কত কোটি অপচয় হয়, জানানোও সরকারের দায়িত্ব; তার সমাধানও সরকারের কর্তব্য। উচ্চ মাধ্যমিক ছাত্রদের কথাই ধরা যাক। তাদের পরীক্ষা থেকে ফল প্রকাশে লাগে এক বছর, ফল প্রকাশ থেকে আবার ক্লাশ শুরু হতে লাগে এক বছর। লাখ খানেক ছাত্রের জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়ের দুটি বছর বাধ্যতামূলক নিষ্ক্রিয়তায় বা রাষ্ট্রিক-সামাজিক হরতালে অপচয়িত হয়। এর আর্থমূল্য কতো? কতো লক্ষ কোটি টাকা? বাঙলাদেশের অফিসে আট ঘণ্টা কাজ করার কথা। গড়ে সেখানে তিন ঘণ্টার বেশি কাজ হয় না। এতে দৈনিক অপচয় কতো? কারখানাগুলোতে ঠিক মতো উৎপাদন হয় না। এতে অপচয় হয় কতো কোটি? দেশে প্রতিদিন ঘুষে অপচয় হয় কত কোটি, এক শো কোটি? এ-ধরনের বার্ষিক হরতাল দেশে লেগে আছে; এর অপচয় সম্পর্কে গবেষণা হওয়া দরকার। সরকার এতে রাজি হবে না। সরকার হরতালের অপচয়ের যে-হিসেৰ প্রকাশ করেছে, যা হরতালের বিরুদ্ধে লজ্জাজনক অপপ্রচার, এতেও অপচয় হয়েছে কয়েক লক্ষ টাকা। অর্থনীতিবিদেরা হিসেব করে দেখাতে পারেন যে ঐ-সরকার মূলত; অপচয়ের সরকার, উৎপাদনের সরকার নয়; তাই অপচয়ের কথা বলা তার সাজে না। হরতালের বিকল্প ভাষা হচ্ছে একটি সৎ শুদ্ধ গণতান্ত্রিক নির্বাচন, যাতে লুঠতরাজ হবে না, টেলিভিশন কেন্দ্রে বসে জয়পরাজয় নির্ধারণ করা হবে না। তাহলে দেখা যাবে জনগণ বিকল্প ভাষাটি ধ্বনি-শব্দ-বাক্য-অর্থে ঠিকমতো প্রকাশ করেছে; সরকারকে জানিয়েছে: বিদায়।