জাতীয় ভাষা একাডেমি

বাঙলাদেশে কতোগুলো ভাষা আছে? এর উত্তর আমি জানি না; কেউ জানেন? সরকারি দলিলপত্র ঘেটেও এর কোনো উত্তর মিলবে না। বাঙলা ভাষা নিয়ে বাঙালি প্রচুর আন্দোলন করেছে, অনেক রক্ত ঢেলেছে, সৃষ্টি করেছে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র; তাই এমন ধারণা জন্মেছে আমাদের যে বাঙলাদেশে ভাষা রয়েছে একটি-বাঙলা। বাঙলা বাংলাদেশের প্রধান, জাতীয় ও রাষ্ট্রভাষা; তবে একমাত্র ভাষা নয়, আরো ভাষা আছে দেশে। এই ভাষাগুলো সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানি না আমরা, উৎসাহীও নই ভাষাগুলো সম্পর্কে; কেননা আমরা ওই ভাষীদের সম্পর্কেই পুরোপুরি উৎসাহহীন। আমাদের ও রাষ্ট্রের আগ্রহ থাকা দরকার ওই ভাষাগুলো সম্পর্কে। ওই ভাষাগুলো বাঙলাদেশেরই সম্পদ। বাঙলা সম্পর্কে আমাদের উৎসাহ অনেক; অবশ্য তার অনেকটাই মৌখিক ও রাজনীতিক। দু-দশকের স্বাধীনতাও পারে নি বাঙলা ভাষাকে মর্যাদা দিতে, শক্তির এলাকাগুলোতে প্রতিষ্ঠিত করতে। বাঙলা হয়ে আছে বাঙালির অবহেলিত, উপেক্ষিত, করুণ রাষ্ট্রভাষা। বাঙলা সম্পর্কেও আমরা খুবই কম জানি। বাঙলা ভাষার নিয়মকানুন শৃঙ্খলা ভালোভাবে উদঘাটিত হয় নি এখনো, নেয়া হয় নি তার শৃঙ্খলা আবিষ্কারের কোনো সুপরিকল্পিত উদ্যোগ। কিছু প্রথাগত বাকরণ রয়েছে বাঙলার; এগুলো পড়ানো হয় বিদ্যালয়ে-মহাবিদ্যালয়ে; এগুলো প’ড়ে শিক্ষার্থীরা বাঙলা ভাষা সম্পর্কে পায় নানা রকম ভুল ধারণা। উনিশ ও বিশ শতক ভ’রে ইংরেজি ও সংস্কৃত বাকরণের আদলে লেখা হয়েছে ওই ব্যাকরণবইগুলো। কেউ কেউ ভালোভাবে লিখতে পেরেছেন, অনেকেই পারেননি। বাঙলাদেশে আজকাল ব্যাকরণ নামে যে-বইগুলো চলছে, সেগুলো লেখা হয়েছে আগের বইগুলো নকল ক’রে; যারা লিখেছেন, তারা বোঝেন না ভাষার শৃঙ্খলা, যারা পড়াচ্ছেন তারা বোঝেন না ভাষার শৃঙ্খলা, আর যারা পড়ছে, তাদের কাছে সবই হয়ে উঠছে বিশৃঙ্খলা। বিভিন্ন সময়ে ভাষা বিশ্লেষণ বর্ণনার বিভিন্ন রীতি দেখা দেয়, আগের রীতি বাদ দিয়ে নতুন রীতিতে বিশ্লেষণ করা হয় ভাষা। এর ফলে ভাষার অনেক অজানা বৈশিষ্ট্য উদঘাটিত হয়, যা আগে জানা হয়েছিলো এলোমেলোভাবে, তা হয়ে ওঠে পরিচ্ছন্ন। পৃথিবীর প্রধান ভাষাগুলো বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রীতিতে বর্ণনাবিশ্লেষণ করা হয়েছে, কিন্তু বাঙলা ভাষা সেভাবে বিশ্লেষণবর্ণনা করা হয় নি। বাঙলা ভাষার ইতিহাস কিছুটা রচিত হয়েছে, একটি বড় বই লেখা হয়েছে এ-সম্বন্ধে; এতে আমাদের ধারণা হয়েছে যে বাঙলা ভাষার ইতিহাস লেখা হয়ে গেছে, আর লেখার কিছু নেই। কিম্ভ নানা পদ্ধতিতে নানা দিক থেকে লেখা হ’তে পারে বাঙলা ভাষার ইতিহাস, এবং সেভাবেই লেখা হ’লেই শুধু এর বিবর্তন সম্পর্কে পৌঁছোতে পারি মোটামুটি স্পষ্ট ধারণায়। বিশ শতকে ভাষা বিশ্লেষণ যে-রীতিগুলো দেখা দিয়েছে পশ্চিমে, সেগুলো খুবই কম প্রয়োগ হয়েছে বাঙলা বিশ্লেষণবর্ণনায়। কিছু খণ্ডিত, অসম্পূর্ণ, কখনো কখনো ভুলেপূর্ণ সন্দর্ভ লেখা হয়েছে বাঙলা ভাষার কোনো কোনো এলাকা নিয়ে; আর সেগুলো কোনো প্রভাব ফেলেনি। অক্সফোর্ড ইংরেজি অভিধানের মতো একটি অভিধান রচনার উদ্যোগ নেয়া উচিত ছিলো অনেক আগেই, কিন্তু কখনো হয়তো নেয়া হবে না। বাঙলা ভাষার একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যকিরণ রচিত হওয়া উচিত ছিলো এরই মধ্যে, কিন্তু ভাষামুখরদের কারো মনে তার ধারণাও নেই। বাঙলা উপভাষাগুলো সম্পর্কে এখনো সেটুকুই জানি, প্রায় এক শতক আগে যেটুকু জানিয়ে গেছেন জর্জ গ্রিয়ারসন। তাই আমরা বাঙলা সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানি না, বাঙলাদেশের ভাষাগুলো সম্পর্কে কিছুই জানি না; কিন্তু জানা দরকার। একটি জাতি শুধু কোলাহলে সারা জীবন কাটিয়ে দিতে পারে না।

বাঙলা ও বাঙলাদেশের বিভিন্ন ভাষা সম্পর্কে বিচিত্র গবেষণা হওয়া দরকার। এ গবেষণার জনো প্রয়োজন বহু ভাষাবিজ্ঞানী। ভাষাবিজ্ঞানীর অভাব রয়েছে বাঙলাদেশে, তাই নেয়া দরকার ভাষাবিজ্ঞানী সৃষ্টির উদ্যোগ। ভাষা-গবেষণা ও ভাষাবিজ্ঞানী সৃষ্টির জন্যে প্রয়োজন একটি সংস্থা বা একাডেমি। এখনকার কোনো একাডেমি বা সংস্থাই এ-কাজের উপযুক্ত নয়। বাঙলাদেশের সমস্ত একাডেমি ও ইনস্টিটিউট পরিণত হয়েছে স্বপ্ন ও পরিকল্পনাহীন জ্ঞানবিরোধীদের আখড়ায়, ওগুলো এখন বুড়ো জীর্ণ গর্দভের মতোই ক্লান্ত। এখনকার কোনো সংস্থার পক্ষে এ-দায়িত্ব নেয়া সম্ভব নয়। এখন দরকার একটি সংস্থা বা একাডেমি, যার নাম হতে পারে ‘জাতীয় ভাষা একাডেমি’। এটা ‘বাঙলা ভাষা একাডেমি’ হবে না, হবে জাতীয় ভাষা একাডেমি, যার দায়িত্ব হবে দেশের সমস্ত ভাষা সম্পর্কে গবেষণা চালানো। এমন এটি একাডেমি খুব অসম্ভব ব্যাপার নয়, অর্থও যে বড়ো সমস্যা হবে, তাও নয়। গরিব বাঙলাদেশে অপচয়ের কোনো শেষ নেই;- এখানে তোরণ সাজাতে যে-পরিমাণ অর্থের অপচয় ঘটে, তার চেয়েও হয়তো কম টাকা লাগবে এমন একটি একাডেমির জন্যে। এ-সরকার সৃষ্টি করবে এমন একটি একাডেমি? তাও বিস্ময়কর নয়, কেননা এ-সরকারের মাথায় ঢুকিয়ে দিতে পারা গেলে এটি মেতে ওঠে যাচ্ছেতাই নিয়ে। তবে এর কাছে জাতীয় ভাষা একাডেমি আমি আশা করি না, কেননা শুরুতেই সরকার সেটা নষ্ট করবে। অযোগ্য অনুগতরা ছুটতে থাকবে পদ ও গাড়ির জন্যে, ফুলের মালা হাতে তোরণ বানিয়ে অপেক্ষা করবে প্রভুর আগমনের, গবেষণার কাজ কিছুই হবে না। আমাদের একটি একাডেমি আছে, আমলার পর আমলা ও ব্যর্থ আমলারা সেটিকে পুরোপুরি নাশ করেছে। তার কোনো মগজ নেই, কোনো স্বল্প নেই। অরো একটি পঙ্গু একাডেমি বা গোবর উন্নয়ন সংস্থা জন্ম নিক, এটা আমার কাম্য নয়; আমি ভাবছি এমন একটি সংস্থার কথা, যা হবে পুরোপুরি জ্ঞানমনস্ক। ওই একাডেমি কে সৃষ্টি করবে? সরকার করবে না, করলে তা একাডেমি হবে না। তাই বাঙালি জাতিকেই সৃষ্টি করতে হবে ওই জাতীয় ভাষা একাডেমি এমন একটি সংস্থা ছাড়া আজ কোনো বড়ো কাজ অসম্ভব। বাঙলা ভাষার একটি ব্যাপক ব্যাকরণ যদি রচনা করতে চাই, যদি বিশ্লেষণ বর্ণনা করতে চাই বাঙলা ভাষায় ধ্বনি, শব্দ, বাক্য ও অর্থ, তবে সে-কাজ কারো একার পক্ষে অসম্ভব। বাঙলা ভাষার একটি ব্যাপক বিশ্বস্ত অভিধান রচনা করতে গেলে দরকার পড়বে বহু অভিধানবিদ ও দীর্ঘ সময়ের। উপভাষাগুলো জরিপ করতে গেলে লাগবে দীর্ঘ সময় ও উপভাষাবিদ। বাঙলা ভাষার সামাজিক ব্যাকরণ রচনা করতে গেলেও দীর্ঘ সময় ও বহু ভাষাবিজ্ঞানী লাগবে। আর এমন নয় যে ভাষাবিষয়ক কাজ কয়েক দশক করলে শেষ হবে সব কাজ; এবং তখন বিশ্রাম নেয়া যাবে। জ্ঞানের সব শাখার মতো ভাষা শাখার কাজও অন্তহীন ও ধারাবাহিক। এখনকার গবেষকেরা করবেন এখনকার কাজ, একুশ শতকের গবেষকেরা করবেন একুশ শতকের কাজ, পরের শতকগুলোর গবেষকেরা করবেন তাদের সময়ের কাজ। ওই কাজ শুরু করার গৌরব অর্জনের সুযোগ রয়েছে আমাদের। ভবিষ্যতে এমন একাডেমি অবশ্যই হবে, বিশ শতকের বিপথগামী বাঙালি যদি তা সৃষ্টি করতে না পারে, তবে অবশ্যই পারবে একুশের বাঙালি। জাতীয় ভাষা একাডেমির একটি বড়ো কাজ হবে অ-বাঙলা ভাষাগুলোর পরিচয় তুলে ধরা। এই ভাষাগুলো এ-অঞ্চলে অবহেলিত ভাষাগুচ্ছ, কিন্তু সেগুলোর মূল্য কোনো রকমেই কম নয়। এই একাডেমি যে-জ্ঞানের বিকাশ ঘটাৰে আমাদের, তাই নয়, বাঙলাদেশের বিভিন্ন জাতিকে ক’রে তুলবে ঘনিষ্ঠ, কেননা তখন আমরা পরিচয় পাবো পরস্পরের ভাষার, বুঝতে পারবো একে অন্যকে। একটি ছোটো দেশে আমরা বিভিন্ন জাতি বিভিন্ন ভাষা দ্বারা বিচ্ছিন্ন। ওই একাডেমি এ-বিচ্ছিন্নতা দূর ক’রে মেলাৰে সকলকে। যদি বাঙলা ভাষাকে আমরা ভালোবাসি, যদি এ-ভালোবাসা আমাদের কপট কোলাহল না হয়, তবে জাতীয় ভাষা একাডেমির সূচনা করা দরকার এখনি।