জনগণের মদ্য

মার্ক্স জনগণের আফিমের কথা বলেছেন, মদ্যের কথা বলেননি। জনগণের মদ্য
চোলাইয়ের যে-কলটি আবিষ্কার করেছিলেন এডিসন, মার্ক্স তার বিশ্বজনীন উৎপাদন দেখে যান নি। ওই মহাআবিষ্কারক উদ্ভাবন করেছিলেন এমন এক অভিনব কল, যেটি উৎপাদন করে চলছে জনগণের প্রিয়তম মদ, যার নাম সিনেমা। বিশশতক বিশ্বযুদ্ধ ও বিনোদনের শতাব্দী এ-শতকের মানুষ বস্ত্র ছাড়া চলতে পারে, অস্ত্র ছাড়া পারে না; এ শতকের মানুষ ভাত ছাড়া বাঁচতে পারে, বিনোদন ছাড়া পারে না। বিনোদন ব্যবসা এ শতকের মহত্তম ব্যবসা। বিজ্ঞানের চোখে ঘুম নেই বিনোদনের কথা ভেবে ভেবে; প্রতিদিনই কিছু-না-কিছু আবিষ্কৃত হচ্ছে এ-দুঃখী গ্রহের দুঃখী অধিবাসীদের চিত্তবিনোদনের উদ্দেশ্যে। জনগণের রক্তমাংসচিত্ত বিনোদনে সিনেমা মদ্যটি এখনো অপরাজিত; পৃথিবী জুড়ে ধনীরা, বিশেষ করে গরিবেরা প্রাণ ভ’রে পান করে চলছে এ পানীয়টি। একে গরিবদের পানীয়ও বলা হয়। সিনেমাকে জাতে উঠতে সময় লেগেছে, সম্ভবত আজো পুরোপুরি জাতে উঠতে পারেনি। অনেকে আজো একে বলেন ‘ব্যাড আর্ট’ বা ‘অপশিল্পকলা’। জাতে ওঠার জন্যে এটি নিজের নাম বদলিয়ে ঘন ঘন বায়োস্কোপ, মুভি, টকি, ফিল্ম, সিনেমা প্রভৃতি নাম নিয়েছে; তবে যে-নামই নিয়েছে সেটিই কিছু দিনের মধ্যে মহিমা হারিয়েছে। অচিরেই হয়তো পাওয়া যাবে এর কোনো নতুন নাম। বাঙলায়ও ঘটেছে একই ঘটনা; – বই, ছবি, ছায়াছবি নানা নামে ডাকা হয়েছে একে, তবে এর আসল উপভোগীরা এক সিনেমাই বলে, যদিও অনেকে একে শিল্পটির গণ্য ক’রে বলেন ‘চলচ্চিত্র’। এর একটি বিশেষণ খুব শোনা যায়; বলা হয় এটি একটি শক্তিশালী মাধ্যম। শক্তিশালী শব্দটি আজকাল সন্দেহজনক; শক্তি বিশশতকে বিভীষিকাই বেশি সৃষ্টি করেছে।

সিনেমা পরনির্ভর মাধ্যম; যখন সিনেমা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে চেয়েছে, তখনি তা নির্ভর করেছে উৎকৃষ্ট সাহিত্যের ওপর। ভালো সিনেমা ভালো সাহিত্যের ভিন্ন মাধ্যমে স্থানান্তর বা উপস্থাপন। পথের পাঁচালীকে চলচ্চিত্রিত করলে পথের পাঁচালীই থাকে; এবং থাকে বিভূতিভূষণেরই। চ্যাপলিন ও আরো দু-একজন ছাড়া প্রধান চলচ্চিত্রকাররা সবাই মহৎ লেখদের অধমর্ণ। মহৎ সাহিত্যের চলচ্চিত্রন দেখলে বোঝা যায় সাহিত্য স্রষ্টারা কতো বড়ো বিখ্যাত পরিচালকদের থেকে। ততীয়-চতুর্থ মানের লেখকেরাও অনেক বেশি প্রতিভাবান প্রথম মানের পরিচালকদের থেকে। চলচ্চিত্র থেকে মহৎ সাহিত্যসমূহ সরিয়ে নিলে যা থাকে তা নিয়ে অর্থ খ্যাতি শক্তির গৌরব করা চলে তবে মহত্ত্ব ও শিল্পকলার গৌরব করা চলে না। শুরু থেকেই সিনেমা উপভোগীদের কয়েকটি বিশেষ রিপুর পরিতোষ যোগাতে চেয়েছে; আজো যুগিয়ে চলছে পুরোদমে। যদি কোনো একটি উপাদানকে সিনেমার প্রধান লক্ষণ বলে চিহ্নিত করা হয়, তাহলে সেটি হবে যৌনতা বা যৌনাবেদন। সিনেমার জগতটি ওই তীব্র প্রবল আবেদন দিয়ে মোড়া। ছবির ভেতরে আছে ওই আবেদন; আর বাইরে তো ওটিই প্রবল। সিনেমা নিয়ে যে-সব পত্রপত্রিকা বেরোয়, তাতে ওই আবেদন; অভিনেতাঅভিনেত্রীদের শরীর ও পোশাক জুড়ে ওই আবেদন। সিনেমা একমাত্রিক পদ্ধতি ব’লে জনগণের উপভোগের জন্যে সবচেয়ে সহজও। বই পড়তে হয়, বুঝতে হয়, উপলব্ধি করতে হয়; আর সিনেমা শুধু দেখলেই চলে। তাই এটিই হয়ে উঠেছে জনগণের মদ্য।

যে-অঞ্চলে জীবন দুর্দশাগ্রস্ত আর সামাজিক বিনোদনের কোনো উপায় নেই, সেখানে সিনেমাই অবদমিত কামনাবাসনা পরিতৃপ্তির সহজ উপায়। ভারতীয় উপমহাদেশটি এর এক আদর্শ এলাকা। এখানে অধিকাংশ মানুষের খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা কিছু নেই। বাস্তব জীবন এখানে অধিকাংশের জন্যে নরক। তারপর রয়েছে অন্যান্য প্রবৃত্তি। মানুষ কোনো-না-কোনো নেশা চায়, যা তাকে সজীব করতে পারে। খাদ্য এখানে নেই, পানীয় তো স্বপ্নের বস্তু; তার ওপর নিষিদ্ধ। নারী-পুরুষ পরস্পরের কাছাকাছি আসতে চায়, এটাই মানবিক স্বভাব। এ-অঞ্চলে তার সুযোগ নেই। এ-অঞ্চলের মানুষ ক্ষুধাতৃষ্ণা ও অবদমিত জৈব কামনাবাসনার সমষ্টি। তাদের কোনো ক্ষুধাই মেটেনি কোনো তৃষ্ণাই শীতল হয়নি। তাই এ অঞ্চলে পাশবিকতার এমন ছড়াছড়ি। এ-অঞ্চলের সিনেমার পুঁজি এখানকার মানুষের ক্ষুধাতৃষ্ণা ও অবদমিত কামনাবাসনা। হিন্দি সিনেমা এ-পুঁজিটাকে ব্যবহার করে সবচেয়ে বর্ণাঢ্যভাবে; আর ক্ষুধায় তৃষ্ণায় কামনায় বাসনায় পীড়িত মানুষেরা ওই মদ আকণ্ঠ পান করে। হিন্দি সিনেমার নায়িকাদের দেহকাঠামো ওই ক্ষুধাতৃষ্ণা কামনাবাসনার পরিতৃপ্তি জন্যে আদর্শ কাঠামো। হিন্দি নায়িকারা স্থুলাঙ্গী হয়ে থাকে;- তাদের শরীরে প্রচুর মাংস, অসংখ্য বাঁক, বিশাল বক্ষ ও প্রশস্ত পশ্চাদ্দেশ থাকতে হয়। ওই নায়িকা দর্শকদের খাদ্য ও পানীয়। ক্ষুধার্ত মানুষেরা প্রচুর খেতে চায়, ক্ষুধার্ত দর্শকেরাও চায় এমন নায়িকা, যার দেহ তারা কল্পনায় পেট ভ’রে খেতে পারে। সাধারণত দরিদ্র দর্শকেরা শীর্ণ নায়িকা পছন্দ করে না, কারণ তার দেহে মাংস নেই; ওই নায়িকা তাদের ক্ষুধা ও কামনা পূরণ করতে পারে না। সে-নায়িকাই এক নম্বর, যাকে কোটি কোটি বুভুক্ষুও খেয়ে শেষ করাতে পারে না। তারা নায়িকার শরীরে খোঁজে সমস্ত ক্ষুধার পরিসমাপ্তি। হিন্দি সিনেমায় নাচগুলো হচ্ছে বিকল্প যৌনমিলন। এ-সব সিনেমায় নায়িকারা আড়াই ঘণ্টায় আড়াই খাইল দৌড়োয়, নায়ক দৌড়োয় দু-মাইলের মতো। তাদের বিভিন্ন প্রতাঙ্গকে আন্দোলিত করতে হয় দশ বারো হাজার বার। একটি সিনেমায় নায়িকা বক্ষ ঝাকুনি দেয় পাঁচ হাজার বার, পশ্চাদ্দেশ আন্দোলিত করে দু-হাজার বার, কাম প্রকাশ করে কয়েক শো বার আর ক্ষুধার্ত তৃষ্ণার্ত দর্শকমণ্ডলির ঘটতে থাকে কামনার মোক্ষণ। তবে পুরোপুরি ঘটে না। পশ্চিমে প্রকাশ্য চুম্বন প্রভৃতি দর্শককে হালকা ক’রে তোলে, কিন্তু এ-অঞ্চলে জীবনের মতো সিনেমায়ও ক্ষুধাতৃষ্ণাকামনাকে বিকট খলে নেড়ে তৈরি করা হয় এক বিষাক্ত কামনাজাগানো পাচন। এ-পাচন যে-ছবিতে সবচেয়ে কড়াভাবে তৈরি হয় সেটির জন্যেই পাগল হয়ে ওঠে জনগণ। এসব ছবিতে যে-কাহিনী থাকে, তা তুচ্ছ; তবে ওই কাহিনীতে জনগণের ইচ্ছাপূরণের চেষ্টা থাকে। বহু বছর আমি ছবিঘরে গিয়ে সিনেমা দেখি নি। বছর বিশেক আগে একটি ছবি শুরু হতে-না-হতেই যে ছবিঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম, তারপর ঢাকার কোনো ছবিঘরে ঢুকিনি। বাধ্য হয়ে এবার একটি ছবি দেখতে হলো। ছবিটি কেনো চলছে? এটিতে আছে ক্ষুধার্তের তৃষ্ণার্তের ক্ষুদাতৃষ্ণা মেটানোর চেষ্টা। অত্যন্ত নিম্নমানের এ-ছবি, কিন্তু প্রথম তিরিশ মিনিট পর্দা জুড়ে নায়িকার বিশাল শরীর খুলে খুলে দেখানো হয়েছে। নায়িকার সম্মুখ, পশ্চাৎ, উর্ধাঙ্গ, নিম্নাঙ্গ এমনভাবে পরিবেশন করা হয়েছে যে গোগ্রাসে গেলা যায়। এর যা কাহিনী, কোনো অপন্যাসিকও তা লিখতে রাজি হবে না। তবে পরিচালক বানিয়েছেন এমন এক মদ্য, যা জনগণ গোগ্রাসে পান করলে তাদের দোষ দেয়া যায় না। তাদের জীবনে কোনো কামনারই পরিতৃপ্তি ঘটে নি, কোনো ক্ষুধাই তাদের মেটেনি, এমন মাংসল কাউকে তারা কখনো আলিঙ্গনে পায় নি এ-ছবি তাদের তা দিয়েছে। রাষ্ট্র ও সমাজ তাদের যা কখনো দেবে না, এ-সিনেমা দিয়েছে তাদের সে-মদ্য; তা তারা পান ক’রে চলেছে দেশ জুড়ে।