খোকনের সানগ্লাস

সানগ্লাসে বড়ো বেশি মানাতো খোকাকে
বেলবটম ট্রাউজার রঙিন হাওয়াই শার্ট গো গো নীল সানগ্লাসে
ভীষণ মানাতো খোকাকে। অনার্স ভর্তি হয়েই খোকা বাসা ছেড়ে উঠে
গিয়েছিলো সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে, যেখানে যার দেয়ালে দেয়ালে
আমার নিজের চারটি বছর কাঁথার সুতোর মতো গাঁথা হয়ে আছে।
খোকন, আমার খোকন। বিকেলে অনেক দিন, প্রায় প্রতিদিন
উর্মিকে আদর করার জন্যে, আম্মির কাছে আব্দার করার জন্যে
আমার কোন লেখাটি ওর ভিশশন লেগেছে ভালো বলার জন্যে আসতো বাসায়।
খোকন টিপছে কলিংবেল, তাই ওই পুরোনো আধবিকল যান্ত্রিক ঘণ্টা
গিটারের মতো ওঠে বেজে। খোকন, আমার খোকন।
ওর মাকে উর্মিকে কাজের ছেলেটাকে পিছে ফেলে আমি নিজেই খুলতাম দরোজা
আমার ফ্ল্যাটের দরোজায় খোকনকে মনে হতো তরুণ দেবদূত।

খোকন তো বেড়ে উঠতো বিদ্রোহী বৃক্ষের মতোই।
ওর বাহু বৃক্ষরাজের বলিষ্ঠ শাখার মতো নভোমুখি, নানা তরুবর মৌলিল,
আকাশে লাগতো তার ডাল। কখনো খোকনকে মনে হতো
মেঘলোকে যুবরাজ আলবাট্রস, সমুদ্রের গাঢ় নীল আকাশের স্বাদ পান ক’রে
অজর অমর হ’তে পারতো খোকন, আমার খোকন।

খোকন মেলতো ডানা স্বপ্নের ভেতরে, ডানার পল্লবে
পল্লবে মালার মতোন গেঁথে সমুদ্র অরণ্য রাত্রি আর দিবসগুলোকে।
উড়তো সে, উড়তো সে, উড়তো খোকন….

খোকনকে মনে হ’লেই ওর সানগ্লাসটিকে মনে পড়ে।
বীথি উপহার দিয়েছিলো কোনো উপলক্ষ ছাড়াই, বীথি খোকার সহপাঠিনী,
এ-কাহিনী শুনেছি খোকার মায়েরই মুখে। খোকন, আমার
ভালোবাসা আর ভালোবাসার প্রথম সন্তান। থোকন বলতো সানগ্লাস
বড়ো উপকারী, চোখে রোদ লাগে পরিমিত, রাস্তার জঘন্য দৃশ্যাবলি মনে হয়
মনোহর যামিনী রায়ের ছবি, দেশটাকে সুশ্রী আর প্রিয় মনে হয়।
বুঝতাম তার সমস্ত ব্যাখ্যার পিছে কম্পমান ভীরু ভালোবাসা।
গাছ চায় মাটি থেকে রস। কুড়িটি বসন্ত মাত্র খোকনের তখন বয়স।
২৯ মার্চ ১৯৭১, খোকন এলো ঘরে সারা গায়ে বিদ্রোহী বাতাস,
দাউদাউ জ্বলছে চোখ খোকনের, অগ্নিকুণ্ডে পরিপূর্ণ ঢাকার আকাশ,
বললো, ‘তোমাকে দিলাম এই সানগ্লাস,আমি যাচ্ছি রক্ত আর অগ্নিময়
সেই দিকে সারা বাঙলা যেই দিকে আজ। সানগ্লাসে আর নয়
খালি চোখে সুশ্রী আমি দেখবো বাঙলাকে।’ খোকন তো চ’লে গেলো,
খোকন, আমার থোকন। তারপর দেখেছি আমি নিজে
জলে বা শিশিরে নয় সারা বাঙলা রক্তে গেছে ভিজে। যে-নদীতে ভাসতো রাজহাঁস
সেখানে ভাসছে শুধু নিরীহ বাঙালির লাশ। সূর্য আর নক্ষত্রের সারাবেলা
মানুষের, সেখানে প্রাগৈতিহাসিক জন্তুরা সে-মানুষ নিয়ে
করে বর্বরতা খেলা। তারপর এলো নতুন বন্যা… সূর্যসংকাশ
ভেসে গেলো জন্তুরা, জন্তুদের সকল আবাস।

যার বছরে ছ-বার কাচ বদলাতে হয়, সেই আমি কাচহীন দেখছি বাঙলাকে
ছায়া সুনিবিড়। মায়ের খোঁপার মতো একেকটি ঘর।
সবুজ গোলাপ হাতে পথেপ্রান্তে হাঁটছে হল্লা করছে লক্ষ মুজিবর।
খোকনের সানগ্লাস প’ড়ে আছে শুধু খোকা নেই। খোকন,
তুমি কি দেখছো বাঙলাদেশ আজকাল এমনি সুন্দর। তাই এ-নিসর্গলোকে
কারো সানগ্লাস পরতে হয় না। এখানে সবার চোখে এমনিই নীল।
তোমার সানগ্লাস কেমন নীল হয়ে লেগে আছে সকলের চোখের মণিতে।
তোমার সানগ্লাস সকলের চোখের মণিতে…