খোলা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ বিশ্ববিদ্যালয়

আমি, ছাব্বিশ বছর আগে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয় সিনে ডাই হয়ে গিয়েছিলো। সিনে ডাই, ক্যালিগুলার মতো পরাক্রান্ত শব্দযুগল, যার অর্থ অনির্দিষ্ট কালের জন্যে বন্ধ’, সেই প্রথম শুনেছিলাম। বুঝেছিলাম ধ্রুপদী লাতিন ভাষা কত সংক্ষেপে কতো দীর্ঘ কাজ করে। সে থেকে এ-শব্দ দুটি আমার জীবনে ও হৃৎপিণ্ডে ভয়ংকর স্বৈরাচারীর মতো বেঁচে আছে। ভর্তি হয়ে সবে সলিমুল্লাহ ছাত্রাবাসে ঢুকেছি, চৌকিতে উঠতে পারি নি, মেঝেই প’ড়ে আছি। অমানি একদিন এনএসএফের জমিরালিরা আমাদের ঘর থেকে তাড়া ক’রে ছাত্রাবাসের পূর্ব দিকের ছোটো দরোজা দিয়ে বের করে দিলো। মোনেম খাঁ বিশ্বদ্যিালয়ের অনির্দিষ্ট কাল বন্ধ ঘোষণা করেছে, আর তা বাস্তবায়নের ভার নিয়েছে এনএসএফের মাস্তানেরা; আমরা অসহায়েরা ভয়ে ভয়ে ভালোমানুষের মতো ছাত্রাবাস থেকে বেরিয়ে এলাম। ছোটো দরোজাটির পাশে একটা নড়োবড়ো চেয়ারে বসে গৃহশিক্ষক বা হাতে ক্যাপস্টান সিগারেট ধরাতে ও টানতে লাগলেন; লাল চোখের জমিরালিরা পালন করতে লাগলো প্রচণ্ড প্রহরীর দায়িত্ব। এমএ পড়ার সময় সহপাঠিনীর সাথে একদিন দূরে কোথাও যাওয়ার কথা হলো, আমি অনেকগুলো নিবেদনমূলক শব্দ ও বাক্য মনে মনে সৃষ্টি ও মুখস্থ করতে থাকলাম; কিন্তু দূরে যাওয়ার আগের দিন বিশ্ববিদ্যালয় সিনে ডাই হয়ে গেলো। আমার জীবন অনির্দিষ্ট কালের জন্যে বন্ধ হয়ে গেলো। সেদিন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হৃৎরোগে মারা গেলে খুশি হতাম, পাকিস্তান দু-টুকরো হয়ে গেলে শান্তি পেতাম; কিন্তু অনেক দিন, আমার জীবনে কোনো শান্তি রইলো না। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শেষ পরীক্ষার দিন সান্ধ্যভোজের সময়, পোলাওকোর্মার উৎসবের মধ্যে, হঠাৎ খুনোখুনি হয়ে গেলো; ছাত্রাবাস থেকে দৌড়ে বেরিয়ে গেলাম; দু-দিন পর বিশ্ববিদ্যালয় সিনে ডাই হয়ে গেলো। চট্টগ্রাম মহাবিদ্যালয় থেকে পদত্যাগ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিতে গিয়ে দেখি ওই পাহাড়ি বিদ্যালয়ে অনির্দিষ্ট কাল ঘোষিত হয়ে গেছে। এরপর অনেক অনির্দিষ্ট কাল ভোগ ও উপভোগ করেছি; এখন চলছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনে ডাই- অনিবার্য অনির্দিষ্ট কাল; কবে ওই অনির্দিষ্ট মহাকাল শেষ হবে কেউ জানে না। আমাদের বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধের জন্যে বিশ্ববিখ্যাত; অসংখ্য বন্ধে ক্ষতবিক্ষত আমাদের শিক্ষাবর্ষ; তার ওপর রয়েছে ঋতুতে ঋতুতে অনিবার্য অনির্দিষ্ট কাল। অনির্দিষ্ট কাল ঘোষিত হয় আকস্মিক সান্ধ্য আইনের মতো- পথিক রাস্তায় রয়েছে, হঠাৎ সান্ধ্য আইন ঘোষিত হয়েছে, তাই তাকে দিগ্বিদিক ভুলে ছুটতে হয় গৃহের দিকে। সিনে ডাই ছাত্রদের জীবনে হঠাৎ ঘোষিত সান্ধ্য আইনের মতো- যেখানে ছিলো সেখানে থেকে তাকে ছুটতে হয় ছাত্রাবাসের দিকে, কাঁথাবালিশ গুছিয়ে নিতে হয়, বেরিয়ে পড়তে হয় ছাত্রাবাস খেকে। সকালে হ’লে সকালেই বেরোতে হয় সন্ধ্যায় হ’লে বোরোতে হয় সন্ধ্যায়, মধ্যরাতে হলে বেরিয়ে পড়তে হয় মধ্যরাতে। যাওয়ার জায়গা না থাকলেও বেরোতে হয় পকেটে একটি কপর্দক না থাকলে ও বেরোতে হয়। সিনে ডাইর শিকার ছাত্ররা, মর্মে মর্মে তারা ভোগ করে সিনে ডাই; অন্য সবাই উপভোগ করে অনির্দিষ্ট কালের দুটি। উপাচার্য কয়েক দিন বিশ্রাম নিয়ে স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করেন, শিক্ষকেরা বাসায় ভিসিআর ও লাউঞ্জে টিভিতে ক্রিকেট দেখেন, শুধু ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিতাড়িত হয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয় খাঁ খাঁ করতে খাকে। বিশ্ববিদ্যালয় মানে খোলা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ বিশ্ববিদ্যালয় কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে লেখাপড়া হয় খুবই সামান্য, কোর্স খুবই সংক্ষিপ্ত তাও ঠিকমতো পড়ানো হয় না; বন্ধের পর বন্ধ ও অনির্দিষ্ট কাল আসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দালান সমাধিস্তুপের মতো প’ড়ে থাকে।

দুটি কারণে সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয় সিনে ডাই হয়; [এক] ছাত্ররা যদি তীব্র সরকার বিরোধী আন্দোলন গ’ড়ে তোলে, প্রশাসনকে বিকল করে দেয়; ও [দুই] ছাত্ররা যদি নিজেদের মধ্যে হানাহানিতে লিপ্ত হয়, নিজেদের হাতে খুন হয় নিজেরা। ষাটের দশকে বিশ্ববিদ্যালয় সিনে ডাই হতো প্রথম কারণে;- ছাত্রদের আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠলে, মোনেমের বাহিনী অসহায় হয়ে পড়লে সরকার অনির্দিষ্ট কাল ঘোষণা করতো। ওপর থেকে চাপিয়ে দেয়া হতো অনির্দিষ্ট কাল। ছাত্রদের মধ্যে হানাহানি তখনো হতো, তবে তার চরিত্র ভিন্ন ছিলো।

এনএসএফের মাস্তানের মাঝে মাঝে হানাহানিতে উৎসাহ বোধ করতো, কিন্তু তখন হানাহানি সীমাবদ্ধ থাকতো ছোটো এলাকায়। এমন হত অস্ত্রের কারণে। তখন ছোরা ও হকিস্টিকই ছিলো ছাত্রদের মারণাস্ত্র; তা খুব বড় রকমের ত্রাস সৃষ্টি করতে পারতো না। শুধু জড়িতরাই জড়িত হতো হানাহানিতে। এখন হানাহানিতে ব্যবহৃত হয় আগ্নেয়াস্ত্র- পিস্তল, রিভলবার, কাটা রাইফেল, মেশিনগান, বোমা। হানাহানিতে যারা জড়িত নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের আটানব্বই ভাগ ছাত্রই হয়তো জড়িত নয়, কিন্তু তারাও অনায়াসে এসে পড়ে ওই সমস্ত অস্ত্রশস্ত্রের সীমার মধ্যে। এখন আর ওপর থেকে সিনে ভাই চাপিয়ে দেয়া হয় না, সরকার বিরোধী আন্দোলনের জন্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে সুনির্দিষ্ট কাল ঘোষিত হয় না; এখন সিনে ডাই হয় ছাত্রদের পারস্পরিক হানাহানির ফলেই। ছাত্ররা এখন লিপ্ত রয়েছে আত্মহননে, ছাত্ররা এখন নিজেরাই নিজেদের শিকার। এর চেয়ে শোচনীয়, মর্মান্তিক, বেদনাদায়ক আর কিছু হতে পারে না। নিজের ছাত্রদের লাশ দেখার জন্যে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেই নি, আমি তাদের দেখতে চেয়েছি। দেবদূতের মতো সুন্দর, মেধাবী, দীর্ঘায়ু; কিন্তু এখন ফিরে ফিরে তাদেরই লাশ দেখতে হয়। আমার ছাত্ররা এখন আর মেধার জন্যে বিখ্যাত হয় না, পরিচিত হয় অপমৃত্যুর কোলে আশ্রয় নিয়ে। অনেক দিন কোনো মেধাবী ছাত্রের নাম শুনিনি, কিন্তু ঋতুতে ঋতুতে গুনছি নিহত ছাত্রদের নাম। নিহত হয়েই কি পরিচিতি অর্জন করতে হবে আমার ছাত্রদের? কিন্তু আমি নিহত ছাত্র চাই না, এমন কি শহীদ ছাত্রও চাই না; চাই প্রাণবন্ত উজ্জ্বল জীবনমুখি ছাত্র। ছাত্ররা কেনো খুন হচ্ছে পরস্পরের হাতে? এ-প্রশ্নের ছোটো উর হবে রাজনীতিই তাদের খুন করছে। যে-রাজনীতি ছাত্রদের খুন করে, যে রাজনীতি ছাত্রদের উৎসাহিত করে পরস্পরকে হননে, তা রাজনীতি নয়, দস্যুতা; দস্যুতার চেয়েও ঘৃণ্য। যারা ক্ষমতায় আছে ও যারা ক্ষমতার জন্যে উৎসাহী, তাদের সবাইকে এখন এগিয়ে আসতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ রক্ষায়। তাদের বোঝা উচিত বিশ্ববিদ্যালয়কে নষ্ট ক’রে ক্ষমতায় থাকা বা ক্ষমতায় যাওয়া আসলে নিরর্থক। ছাত্রদেরও বুঝতে হবে বিষয়টি খুব ভালোভাবে, বুঝতে হবে তারাই শিকার। যে-ই তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিক না কেনো, ছাত্রদের বুঝতে হবে তাদের বান্ধব নয়, শত্রু। ছাত্রদের বুঝতে হবে যে অস্ত্র তারা তুলে নিচ্ছে নিজেদের হাতে, তা তাদের বিশ্বাসঘাতক সহচর। উপাচার্যদেরও বুঝতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানকেন্দ্র, শক্তিকেন্দ্র নয়। আমাদের উপাচার্যরা যদি পদের মোহ ভুলতে পারেন, দলাদলি ভুলতে পারেন, জ্ঞানকেই প্রধান ক’রে তুলতে পারেন, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় আবার পরিশুদ্ধ হয়ে উঠতে পারে। উপাচার্যরা সব কিছু নিয়েই ব্যস্ত থাকেন, শুধু লেখাপড়ার দিকটি ছাড়া। বিভিন্ন বিভাগে লেখাপড়া হয় কিনা, শিক্ষকেরা ক্লাশে যান কিনা, গবেষণা করেন কিনা এসব দিকে উপাচার্যদের লক্ষ্য নেই, কেননা তারাও তা করেন নি; বরং যে শিক্ষকেরা লেখাপড়ার সাথে সংস্রবহীন তারাই অর্জন করেন উপাচার্যদের প্রীতি ও পদোন্নতি। শিক্ষা যখন নষ্ট হয়ে যায়, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশ নষ্ট করার জন্য দল বেধে আসে নানা উৎপত্তি। হানাহানি ও সিনে ডাই তার চরম রূপ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অবিলম্বে খুলে দেয়া দরকার, মুক্তি দেয়া দরকার অনির্দিষ্টকালের গ্রাস থেকে। বন্ধ বিশ্ববিদ্যালয় কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বিশ্ববিদ্যালয় মানে হচ্ছে খোলা বিশ্ববিদ্যালয়: পুস্তক, পাঠাগার, ক্লাশ, ছাত্রছাত্রী, জীবন ও উল্লাস।