মানুষেরা

কবি ব্লেক আর্তনাদ করে উঠেছিলেন, হায়, আমি কেনো আমার প্রজাতির অন্যদের মতো নই। তিনি কিছুটা বেশি ভিন্ন ছিলেন অন্যদের থেকে;- তিনি এমন কিছু দেখতে পেতেন মানুষের মুখে, ফুলের পাপড়িতে, স্বর্ণমুদ্রার মতো ভোরের সূর্যে, যা দেখতে পেতেন না অন্যরা। তিনি শুনতেন এমন স্বর, যা শুনতে না অনার। তিনি বাস করতে অন্য বাস্তবতায়। তবে শুধু ব্লেক ভিন্ন বাস্তবতায় বাস করতেন না, আমরা সবাই বাস করি ব্যক্তিগত বাস্তুবতায়। আমাদের বাস্তবতার মধ্যে মিল আছে, ওই বাস্তব অনেকাংশে অভিন্ন; তবে খুবই ভিন্ন অনেকাংশে। এক অখণ্ড বাস্তবতা ব’লে কিছু নেই। একই শহরে থাকছি, পোহাচ্ছি একই যন্ত্রণা, বা থাকছি একই রাস্তায়, সহ্য করছি একই পীড়ন বা ঘুমোচ্ছি একই শয্যায়, বিক্ষত হচ্ছি একই কাটার আঘাতে; তবুও আমরা পুরোপুরি একই বাস্তবে নই। একে অপরের মধ্যে ব্যবধান দুস্তর। আর কোনো প্রজাতির মধ্যে সম্ভবত এমন দূরত্ব নেই। প্রতিটি পাখি সম্ভবত থাকে একই বাস্তবে, প্রতিটি পোকাও থাকে একই বাস্তবতায়, কিন্তু মানুষ ভিন্ন ভিন্ন বাস্তবতার অধিবাসী। একই ঘটনা দুজনে দেখি না একই রকমে, একই দৃশ্য সমান সুন্দর নয় দুজনের কাছে, দুজনের বিশ্ব বা মহাজগৎ কখনোই এক নয়। প্রতিটি মানুষ একেকটি বাস্তবতা। মানুষের মাথায় প্রতি মুহূর্তে কী চলছে, তা খুলে দেখা যেতো যদি, তাহলে ধরা পড়তো যে তারা কতো পৃথক। একজন হয়তো আদিম, তার হয়তো বিকাশই ঘটেনি; আরেকজন হয়তো অনাগত কালের, তার সময় এখনো আসে নি। একজন ভিখিরির কথা ধরা যাক। বারবার আমার জানতে ইচ্ছে করে তার বিশ্বটি। তার স্থূল বাস্তবাটি স্পষ্ট। রাস্তার পাশে থাকে, ছেড়া ত্যানা পরে খেতে পায় না, ট্রাকের চাকার পাশেই ঘুমিয়ে থাকে, নরকে থাকে। তার বিশ্ব কতোটুকু? সে তো জানে না পৃথিবী গোল, জানে না এটা ঘুরছে, জানে না এটা কতো বড়ো? সে প্রায় কিছুই জানে না। সে থাকে যে-বাস্তবে, তার থেকে সম্পূর্ণ পৃথক একজন শিক্ষিত মানুষের বাস্তবতা। ধার্মিকদের বাস্তবতার কথা ধরা যাক। তারা বিধাতায় বিশ্বাস করে, তাদের বিধাতারা নানা রকম: মুসলমানের বিধাতা একরকম, হিন্দুর বিধাতা আরেক রকম; খ্রিস্টানের বিধাতা আরেক রকম, ইহুদির বিধাতা আরেক রকম। বিভিন্ন ধর্মের অনুসারী হওয়ার ফলেই তারা বিছিন্ন হয়ে পড়েছে বিভিন্ন বাস্তবতায়। ওই বাস্তবতারাশি শুধু বিভিন্ন নয়, পরস্পরবিরোধীও। একজন হয়তো কোনো তরুণীর দিকে তাকানোর সাথে সাথে কেঁপে ওঠে, কেননা তার বিধাতা তাকিয়ে আছে তার দিকে এবং এজন্যে তাকে কঠিন শাপ্তি পেতে হবে। তার বিশ্বাস তাকে এক হিংস্র বাস্তবতার মধ্যে ফেলে রেখেছে। যুক্তিবাদীর কাছে ব্যাপারটি হাসাকর। সে হয়তো বিধাতার অস্তিত্বই অস্বীকার করে, কেননা অস্বীকার করার কারণের অভাব নেই; আর যদি স্বীকারও করে যে বিধাতা আছে কোনোখানে, তবুও একটি তরুণীর দিকে তাকানোটাকে শাস্তিযোগ্য মনে হবে না তার কাছে। একজনের কাছে যা স্বৰ্গনরকের বস্তিবতা; আরেকজনের কাছে তা কৌতুক। ধার্মিকদের বাস্তবতা যেমনি হিংস্র তেমনি সুখকর। কোনো প্রশ্নের কামড় সহ্য করতে হয় না তাদের, তারা উপভোগ করে মেনে নেয়ার ও পরকালে প্রবল ইন্দ্রিয়পরায়ণ জীবনযাপনের সুখ। মানুষ সাধারণত নিজের চোখে দেখে না, নিজে বিচার করে না; দেখে অন্যের চোখে, আর অন্যের বিচার বিশ্বাস করে। বিশ্বাস জিনিসটি মানুষকে ছুঁড়ে দেয় ভিন্ন ভিন্ন বাস্তুবে। একনায়কত্বে যে-বিশ্বাস করে সে বুঝতে পারে না গণতন্ত্রের বাস্তবতা; আর গণতন্ত্রে বিশ্বাসী বুঝতে পারে না সমাজতন্ত্রের বাস্তবতা। কবিৰ বাস্তবতা বুঝে উঠতে পারে না রাজনীতিক, আর রাজনীতিকের বাস্তবতা দুর্বোধ্য মনে হয় শিল্পীর কাছে। প্রতিটি মানুষ ভিন্ন ভিন্ন বাস্তুব মাথায় নিয়ে ঘুরছে ফিরছে, মুখোমুখি হচ্ছে, শত্রুতায় জড়িত হচ্ছে, চুমো খাচ্ছে; কিন্তু থেকে যাচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন বাস্তবে। বাইরের যে- বাস্তবতা, যাতে বাস করি আমরা, তা প্রখর সত্য; তবে আরো প্রখর ভেতরের বাস্তবতা। ওই বাস্তবের কেন্দ্র মস্তিষ্ক, যা মানুষকে পরিণত করে ভিন্ন সত্তায়, ভিন্ন বিশ্বে। একেকজনের ইন্দ্রিয় একেক রকমে প্রবল। যার দৃষ্টি দৃশ্যের ভেতরে আরো কিছু দেখতে পায়, যার শ্রুতি স্বরের ভেতরে শুনতে পায় আরো কিছু, যার ত্বক অনুভব করে স্পর্শাতীত আরো কিছু, তাদের পৃথিবী বিভিন্ন। একজন কবিতায় কোনো সুখ পায় না, কবিতাকে মনে করে হাস্যকর, তার বাস্তুব ও বিশ্ব এক; আরেকজন পাগল কবিতার জন্যে, কবিতাই তার চরম সুখ, তার বাস্তব আরেক রকম। একজনের বাস্তবে কোনো কবিতা নেই, আরেকজনের বাস্তবে কবিতা ছাড়া সব কিছু গৌণ। একজনের কাছে টাকাই সত্য, আরেকজনের কাছে টাকা ময়লার মতো। তারা বাস করে দু-বাস্তবে। মানুষের মাগজের মতো বিকাশ ঘটে ততো বাড়ে তার বাস্তবতা বা বিশ্ব। ধর্মবিশ্বাসীদের মস্তিস্ক সম্ভবত সবচেয়ে অবিকশিত, তাদের বিশ্বও সংকীর্ণ। স্বর্গ-নরক-আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমিত তাদের বিশ্ব, কতকগুলো পুরোনো নির্দেশ দ্বারা চালিত তাদের জীবন।

সামাজিক অবস্থা ও শিক্ষা মানুষের বাস্তবের সীমা বাড়িয়ে দেয়। ভিখিরির জীবনে ভাতই হয়তো সবচেয়ে সুন্দর, কিন্তু সচ্ছল মানুষ ভাতের সৌন্দর্যের কথা ভাবে না। যে জানে পৃথিবী ঘুরছে, কেনো ঘুরছে, আর যে জানে না, তাদের বাস্তব শুধু ভিন্নই নয়, তারা হয়তো দুই প্রজাতির প্রাণী। যে মনে করে নারীর স্থান গৃহ, তার, আর যে বিশ্বাস করে নারীপুরুষের সাম্যে, তার বাস্তবতা বিপরীত। একজন জানেন পরপুরুষের দিকে তাকালে কিছু হয় না, পরলোকে তো হবেই না, এমনকি এ-লোকেও চোখেও সামান্য যন্ত্রণা হয় না, বরং মাঝে মাঝে সুখ পাওয়া যায়। তার বিশ্ব অনেক আলোকিত, অনেক মানবিক। আরেকজন জানে পরপুরুষের দিকে তাকালে চোখে উত্তপ্ত লৌহ ঢালা হবে, তার বিশ্ব অন্ধ ও অমানবিক। একজন জানে বিধাতা ব’লে কিছু নেই বা থাকলেও তাতে কিছু যায় আসে না। তার বিশ্ব উদার। আরেকজন বিশ্বাস করে বিধাতা আছে, সে প্রচণ্ড শাস্তি দেয়ার জন্যে সব সময় ব্যগ্র। তার বিশ্ব সংকীর্ণ। এই যে বিচিত্র বাস্তবতা ও বিশ্ব মানুষের সেগুলোকে যদি মোটা ভাগে ভাগ করি; এবং একটিকে বলি আলোকিত, অনাটিকে অন্ধকার; এবং আলোকিত ও অন্ধকার বাস্তবের হিশেব নিই আমাদের দেশে, তাহলে দেখতে পাবো আমাদের এখানে অন্ধকারেরই আধিক্য। আমাদের মগজগুলোতে অন্ধকার কেমন কাজ ক’রে চলছে, তা চোখে দেখার উপায় নেই; তবে আমরা যে-সব কাজ ক’রে চলছি, তা থেকেই অনুমান করতে পারি কী চলছে আমাদের মগজগুলিতে। যে-অশুভ আমরা ছড়িয়ে দিচ্ছি। সামাজিক-রাস্ট্রিককভাবে, মিথ্যা ও অসততাকে যেভাবে ক’রে তুলছি জাতীয় ব্যাপার, প্রগতিকে বর্জন ক’রে যেভাবে ছড়িয়ে দিচ্ছি প্রতিক্রিয়াশীলতা, তা থেকে তো বোঝা যায় মাথায় চলছে অন্ধকারের প্রবল আধিপত্য। রাস্ট্র যারা চালাচ্ছে, তাদের মাথা ভরা অন্ধকার; যারা চালাচ্ছে সমাজ, তাদের খুলি পরিপূর্ণ অন্ধকারে। দেশের অধিকাংশ মানুষ গরিব ও নিরক্ষর; তারা যে বাহ্যবাস্তবে বাস করে, তা ভয়াবহ, আর তার মাথায় লালন করে যে-বাস্তব, তাও হয়তো কম ভয়াবহ নয়। মাথার ভেতরে আলোকিত বিশ্ব বহন করেন, এমন মানুষ খুব কম। আলোর বৃত্তটি বাঙলায় খুবই সীমাবদ্ধ। কোটি কোটি মানুষ দেশ ভ’রে, কোটি কোটি তাদের বাস্তব। ওই বাস্তবতারাশি যদি হতো আলোকিত, তাহলে দেশ। আলোকিত হয়ে উঠতো; কিন্তু তার বদলে মগজে তাদের অন্ধকার, তাই অন্ধকার বাহ্যবাস্তবেও।