মুমূর্ষ প্রজন্ম

তরুণ তরুণীরা কেমন আছে এখন, তা আমি ঠিক জানি না, যদিও আমার বাস অনেকটা তাদের মধ্যেই। এমনকি বলা যেতে পারে প্রতি বছর আমারই বয়স বাড়ছে এক বছর করে, কিন্তু আমার প্রতিবেশের বয়স বাড়ছে না, প্রতিবছর নতুন তরুণতরুণীরা এসে প্রতিবেশকে তারুণ্যমুখর করে রাখছে। চার বছর আগে যারা এসেছিলো, তাদের চোখেমুখে কিছুটা ধূসরতা লেগেছে, দু-বছর আগে এসেছিলো যারা তাদের মুখের ওপর ধূলো জমতে শুরু করেছে; এবার যারা এলো, তাদের মুখ বেশ টাটকা। এদের মুখেও জমবে ধূলো দেখা দেবে ধূসরতা, আর নতুন টাটকা মুখ নিয়ে আসবে নতুনেরা। এদের মাঝখানে আছি, তবু মনে হয় কতো দূরে আছি। এক সময় আমি যেমন দূরে ছিলাম আমার পিতার থেকে, এরা যেনো তার থেকেও আমার অনেক দূরে। আমি কিছু বাঁধাবুলি বছর বছর আবৃত্তি করি। এক সময় বেশ আবেগে আবৃত্তি করতাম, এখন সে- আবেগটুকুও নেই, আর আমার সামনে বসে যারা ওই গৎ শোনে, তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হয় তারা কিছু শুনছে না, কিছু দেখছে না, তাদের কোনো ইন্দ্রিয় কাজ করছে না। এক সময় তাদের অনেকের চোখে ঝিলিক দেখতাম, এখন তা দুর্লভ হায়ে উঠেছে; এক সময় অনেকে আমার অভাবিত কথা শুনে চোখাচোখি করতো, এখন তাও করে না। কোনো উদ্দীপক তাদের উদ্দীপ্ত করে না, কিছুতেই তারা সাড়া দেয় না। তরুণীদের অনেকেই শুভবিবাহ উৎসবের শাড়ি পরে আসে, হয়তো মাঝে মাঝে ঠোটের যত্ন নেয়, কিন্তু জ্ঞান তাদের আলোড়িত করে বলে মনে হয় না। তরুণদের অনেকে পোশাকের চূড়ান্ত করে, বারান্দায় দীর্ঘতম সিগারেটের পরিচর্যা করে, কিন্তু সাড়া দেয় না। বারান্দায় তারা কোলাহল করতে ভালোবাসে, চিৎকার করে অতি উচ্চকণ্ঠে, মাতামাতি করে কারণে-অকারণে, একদল এগারোটা বাজলেই শ্লোগান নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। আমি এদের মধ্যে আছি, তবু আছি যেনো সহস্র কিলোমিটার দূরে। আমি তাদের বাস্তবতা জানি না, জানি না তাদের স্বপ্ন, তাদের কামনাবাসনার ঠিকানা, বুঝতে পারি না তাদের রক্তমাংসের স্পন্দন। জানি না তারা কখন ঘুম থেকে ওঠে, জানি না রাতে তাদের ঘুম হয় কিনা; জানি না তারা কখন গোসল করে, দাঁত মাজে কিনা, জানি না তারা কী পড়ে, আদৌ পড়ে কিনা। জানি না মাংস তাদের কতোটা উত্তেজিত রাখে, ক্ষুধা তাদের কতোটা কাতর করে। জানি না তাদের স্বপ্লে কতোটা থাকে টাকার মুখ, কতোটা থাকে সৃহপাঠিনীর বা পাশের বাসার তরুণীর মুখাবয়ব। মাঝে মাঝে তাদের সম্পর্কে গুজব শুনি- তারা অন্য রকম হয়ে গেছে, সময় তাদের নষ্ট করে ফেলেছে, তারা পরিণত হয়েছে এক মুমূর্ষ প্রজন্মে, এরকম নানা সংবাদ শুনি বিশ্বস্ত সংবাদদাতাদের মুখে। ষাটের দশকের স্বপ্নের সাথে নাকি কোনো মিল নেই আশির দশকের স্বপ্নের; ষাটের দশকের কামনাবাসনার সাথে নাকি কোনো গোত্রীয় সম্পর্ক নেই আশির মুমূর্ষু প্রজম্মের কামনাবাসনার। তারা এক মুমূর্ষু উদ্ধারহীন প্রজন্ম এমন বাণী শুনি।

শুনেছি লেখাপড়াটাকে তারা আর গুরুত্বপূর্ণ ভাবে না, ঈর্ষা করে না প্রথম শ্রেণী প্রাপ্তদের; বরং প্রথম শ্রেণী পাওয়াটাকে ভাবে জীবনের এগোনোর প্রথম বড়ো বাধা। প্রথম শ্রেণী মানে তো বিশ্ববিদ্যালয়, আর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ হচ্ছে জীবনটাকে নিজের হাতে নষ্ট করা। বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুষ নেই, পীড়ন করার মতো ক্ষমতা নেই, গাড়ি নেই, ভবিষ্যতে বাড়ি নেই, জীবনে কোনো রূপসী নেই। রূপসীরা এখন মাধ্যমিকে ফেল করা ফুটবল খেলোয়াড় চায়, কোনো প্রথম শ্রেণীকে চায় না। শুনেছি তারা শিক্ষককে ‘স্যার’ বলার চেয়ে বীমার দালালকে ‘স্যার’ বলতে পছন্দ করে। তারা বিভাগের শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের নামও জানে না, জানার উৎসাহও বোধ করে না; কিন্তু টেলিভিশনের সহপ্রযোজকদেরও নাম জানে। শুনেছি তারা টাকা ছাড়া আর কিছুতে বিশ্বাস করে না। এক তোড়া টাকাকে তারা পুণ্যগ্রন্থর থেকেও বেশি শ্রদ্ধা করে। ক্ষমতায় তারা বিশ্বাস করে এবং ক্ষমতায় যাওয়ার পেছনের গলিগুলোর ঠিকানা ডাকপিয়নের থেকেও নির্ভুলভাবে জানে। ধর্মকর্মের দিকেও নাকি অনেকেই আসক্তি রয়েছে; পীরদের ঠিকানা জানে। সবচেয়ে উদ্বিগ্ন তরুণীটিও মাইক্রোফোন শুনে ঘোমটা দেয়ার চেষ্টা করে। প্রেমেও নাকি তাদের আর আসক্তি নেই। ষাটের দশকের তরুণেরা প্রেমের জন্য পাগল ছিলো, ব্যাকুল ছিলো সহপাঠিনীদের মুখ দেখার জন্যে। এখন এটা নাকি হাস্যকর। তারা নাকি সহপাঠিনীদের ‘আপা’ বলে তাদের নিয়ে কোনো স্বপ্ন দেখে না; বরং স্বপ্ন দেখে গ্রামের চেয়ারম্যানের মেয়েকে। তরুণীরা উচ্চশিক্ষা নিয়ে এখন নাকি নিজেদের পায়ে কুড়াল মারতে বসেছে; এমএ পাশ তরুণীর জন্যে আইএ পাশ মধ্যপ্রাচ্যের ড্রাইভার প্রস্তাব পাঠায়। এমএ পাশ তরুণীর বিয়ে হয় বিএ পাশ তরুণের সাথে, যদি তার পিতা তার মেয়ের থেকেও আকর্ষণীয় হোন্ডা, রঙিন টিভি দিতে পারে। তারা খুবই হতাশ, তাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় অপচয় হয়ে যায়। এক সময় একুশ বছরে তরুণেরা বেরিয়ে যেতো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, এখন অনেকেই ঢোকে একুশ বছরে, আর কখন বিশ্ববিদ্যালয় তাদের নিষ্কৃতি দেবে, তা কেউ জানে না। মানুষের জীবনের সবচেয়ে তীব্র, সংরক্ত, কামনাবাসনাকম্পিত সময়টি তারা অপচয় করে যখন বেরোয় তখন সামনে দেখে সামাজিক মরুভূমি তাদের জন্যে একটুও ছায়ার ব্যবস্থা রাখে নি।

মানুষ স্বয়ম্ভূ নয়, এ-মুমূর্ষু প্রজন্মও জন্ম দেয় নি নিজেদের। এ-সমাজই তার জম্মদাতা। আমাদের সমাজরাষ্ট্র এমন জনক, যে তার উত্তরাধিকারীদের যৌবনেই মুমূর্ষু করে ফেলে; যযাতির মতো সন্তানের যৌবন, সংরাগ, কামনাবাসনা কেড়ে সম্ভোগ করে নিজে। সমাজরাষ্ট্র যারা চালাচ্ছে, যারা নিয়ন্ত্রণ করছে রাজনীতি, অর্থ, শিক্ষা তারাই এ মুমূর্ষু প্রজন্মের জনক। তারা ভাবছে না তরুণতরুণীদের কথা, যারা সুস্থভাবে বেড়ে উঠে নিজেদের প্রতিভায় রূপান্তরিত করে দিতে পারে সমাজকে। বরং জনকেরা ব্যস্ত নিজেদের নিয়ে, তারা নিজেদের কামনায় থরথর করে কাঁপছে, বাসনায় উত্তেজিত থাকছে, উদ্দীপ্ত থাকছে সম্ভোগে। দেশের দিকে তাকালে মনে হয় এটা যেনো বার্ধক্যে যৌবন আর যৌবনে বার্ধক্যের দেশ। ক্ষমতাধিকারী বাতিল বুড়োলের গাল থেকে চর্বি বেয়ে পড়ে, হাসি ঝকঝক করে, কামনা জ্বলজ্বল করে ঠোঁট জুড়ে। আর মুমূর্ষু প্রজন্মের মুখমণ্ডল বিবর্ণ, হাসিতে ধূসরতা, ঠোঁটে শুষ্ক। বেশ কয়েকটি বাতিল বুড়োকে দেখেছি আমি, যারা কুঁকড়ে গিয়েছিলো অবসর নেয়ার পর ধরাধরি করে যেই তারা বসলো গিয়ে শক্তিমান আসনে, অমনি তাদের মুখে দেখা দিলো আভা, দাঁত শক্ত হয়ে উঠলো, বাহু এতো আবেগপরায়ণ হয়ে উঠলো যে সামনে যে-তরুণীকে পায়, তাকেই জড়িয়ে ধরে। বাতিল বুড়োরা এখানে উপভোগ করে আর যুবক যুবতীরা হয় অপচয়িত। সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন পরিকল্পনার মধ্যে প্রধান পরিকল্পনাটি হওয়ার কথা নতুন প্রজন্মকে নিয়ে, কিন্তু এ দেশে তাদের নিয়েই কোনো পরিকল্পনা নেই। তারা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে অপরিকল্পিতভাবে। ইয়েটস এক মুমূর্ষু প্রজমোর কথা বলেছিলেন, যারা ছিলো একে অপরের বাহুতে আলিঙ্গনাবদ্ধ, সুর ও সুরার প্রাচুর্যে মুমূর্ষু; আর বাঙলাদেশ জন্ম দিচ্ছে একের পর এক মুমূর্ষু প্রজন্ম, সমাজরাষ্ট্র স্বাদের অস্বীকার করেছে, জীবন তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে। মাদক তাদের জন্যে যতোটা অভিশাপ, তার চেয়ে অনেক মর্মান্তিক অভিশাপ রাষ্ট্র ও সমাজ।