প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়

আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়টিকে আমার খুব মনে পড়ে। রাস্তার পাশে একটি ভিটের ওপর ছিলো প্রাথমিক বিদ্যালয়টি; তার পশ্চিম ধারে ছিলো কয়েকটি যুগল কবর, পুবে মসজিদ, দক্ষিণে জঙ্গল ও পুকুর। প্রাঙ্গণে ছিলো ধারালো সরু কাঁটাভরা এক রকম ঘাস। বিদ্যালয়টি ছিলো একটি লম্বা ঘর, যার ভেতরে একটা নড়োবড়ো হাতলভাঙা চেয়ার, একটা ভাঙা টেবিল, আর বেড়ার গায়ে একটা রঙচটা ব্ল্যাকবোর্ড ছাড়া আর কোনো আসবাব ছিলো না। বেড়ার গায়ে কাঠ সেঁটে এমনভাবে আমাদের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো, যা বর্ণনা করার ভাষা এখনো মামি আয়ত্ত করে উঠতে পারি কি। শীতে হু হু ঠাণ্ডা হাওয়া ঢুকতো ভেতরে; আর বোশেখের প্রথম বাতাসেই আমাদের বিদ্যালয়ের জংধরা টিনের চাল উড়ে গিয়ে আশ্রয় নিতো উঁচু আমগাছটির ডালে। আমাদের দু’জন ক্লান্ত ধূসর শিক্ষক ছিলেন। ওই বিবর্ণ বিষণ্ণ বিদ্যালয়ে তাঁরাই আমাকে দিয়েছিলেন সবচেয়ে মৌলিক জ্ঞান। এরপর অনেক প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ, মহা, ও বিশ্ববিদ্যালয় দেখেছি। বাঙলাদেশের বিদ্যালয়ের আদর্শরূপ আঁকা হয়ে গেছে আমার চেতনায়, কোথাও গেলে ওই এলাকার বিদ্যালয়টিকে চিনতে আমার কষ্ট হয় না। ওই এলাকার যে-ভবনটি সবচেয়ে ভাঙাচোরা, যার বেড়ায় দেয়ালে শ্যাওলার প্রবল প্রসাধন, যার এক দিক হেলে আছে বা কোনো অংশের নির্মাণ স্থগিত হয়ে আছে অনেক বছর ধ’রে, যে-ভবনটিকে ওই এলাকার মানুষেরা গভীর অবহেলা করে, যেটিকে দেখলে চোখে মুহূর্তে ছানি পড়ে, আমি বুঝতে পারি সেটি কোনো বিদ্যালয়। বিদ্যাকে আমরা কতো গুরুত্বপূর্ণ মনে করি, বিদ্যালয় দেখলেই তো চিরকালের জন্যে বোঝা হয়ে যায়। থানার দালান ঝকঝক করে, মসজিদগুলো থেকে আলো বেরোয়, বিভিন্ন অফিসের ভেতরে ও বাইরে নানা রকম নবাবি, জরাজীর্ণ শুধু বিদ্যালয়গুলো। আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়টির চালে তবু কয়েকটি ঢেউটিন ছিলো; পাশের গাঁঁয়ের বিদ্যালয়টির তাও ছিলো না। শুকনো বাশপাতা দিয়ে ওই বিদ্যালয়ের প্রধান ও একমাত্র শিক্ষক চাল ও বেড়া বানিয়েছিলেন তাঁর বিদ্যালয়ের। ওই দুর্দশাগৃহে যারা জ্ঞানের বাতি জ্বালাতেন, তাদেরও মনে পড়ে; এবং মাথা নত হয়ে আসে। যে-গুটিকয় মানুষের কথা মনে হ’লে আমার মাথা নত হয়ে সুখী বোধ করে, আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা আছেন তাদের শীর্ষে। ওই বয়সে টাকাপয়সার কথা বুঝি নি, আজো বুঝে উঠতে পারি নি; স্যারদেরও যে জীবন চালানোর জন্যে টাকাপয়সার দরকার হতো, তা মনে আসে নি। এখন বুঝি স্যারদের মুখে যে-অক্ষয় ক্লান্তি দেখেছি, তা ছিলো অভাবের ক্লান্তি। ইউনিয়নের প্রেসিডেন্টের মুখে সে-ক্লান্তি ছিলো না, তার বন্ধু বড়ো দারোগার মুখে সে ক্লান্তি ছিলো না; এই ক্লান্তি ছিলো শুধু আমাদের স্যারদের মুখে। পরে উচ্চ বিদ্যালয়ের, মহাবিদ্যালয়ের স্যারদের মুখেও দেখেছি একই অক্ষয় ক্লান্তি। আমলার মুখে এই ক্লান্তি দেখি নি, ব্যবসায়ীর মুখে ওই ক্লান্তি দেখি নি, কালোবাজারির মুখে ওই ক্লান্তি দেখি নি। তাদের মুখ খুবই আলোকিত। এখন আমি যেখানে আছি, তাতে আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়টিকে খুব মনে পড়ে। এটা বিশ্ববিদ্যালয়; তবে এর কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাথে। এর ভবনে দেখতে পাই আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিবর্ণতা; আর শিক্ষকদের মুখে দেখতে পাই আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মুখের অক্ষয় ক্লান্তি। প্রাথমিক বিদ্যালয় আর বিশ্ববিদ্যালয় একই সামাজিক রাজনীতির নিয়তির ক্রোধে দণ্ডিত যুগল সহোদর।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন খুবই বিখ্যাত; এটি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতীক। বাইরে থেকে বেশ মনে হয় দালানটিকে, কিন্তু এটিও আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়টির মতোই। একেবারে আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়। আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের রঙচটা ব্ল্যাকবোর্ডটি কীভাবে যেনো এসে সেঁটে আছে কলাভবনের ক্লাশক্ষের দেয়ালে। আমি ঠিক চিনতে পারি- একই ব্ল্যাকবোর্ড- সেটিতে চকের দাগ পড়তো না, এটিও পড়ে না। আর এই হাতলতাঙা, পাভাঙা চেয়ারটি- ওটিও আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছিলো। হেডস্যার বসতেন, বসতে বলতে একেবারে ধ’সে গেছে। তারপর ওটি চ’লে এসেছে কলাভবনের ক্লাশকক্ষে; এখন ওটিতে বসাও যায় না। আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাখা ছিলো না, তবে এর চেয়ে ভালো বাতাস ছিলো। উত্তর আর দক্ষিণ থেকে বাতাস ঢুকতো। কলাভবনের ক্লাশকক্ষগুলোতে অনেক পাখা টাঙানো আছে, কোথা থেকে এসেছে জানি না, তবে আমার প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে আসে নি। সেখানকার প্রাকৃতিক পাখী এতো খারাপ ছিলো না। এগুলোর কোনোটা ঘোরে, কোনোটা অটল; কোনোটি ট্রাকের বংশধর, কোনোটি রেলগাড়ির, কোনোটি অশ্বের। এরা যখন গতিশীল হয়, তখন মহাপ্রলয়ের ধ্বসি জাগে। আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক কোণে দুটি চড়ুই ছিলো; সেগুলোও চ’লে এসেছে কলাভবনে। ছাত্ররা যখন শ্লোগান থেকে বিরত থাকে তখন ওই রাজনীতিপ্ৰবণ চই দুটি তাদের শ্লোগান শুরু করে। যাদের কমপক্ষে দশ বছর যাত্রাভিনয়ের অভিজ্ঞতা নেই, তারা কলাভবনের ক্লাশকক্ষে পড়ানোর অযোগ্য। বক্তৃতাভবন ব’লে একটি নতুন দালান হয়েছে ক-বছর আগে। ওটা আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের থেকেও নিকৃষ্ট। এটির স্থপতিরা অর্থচিন্তাশীল ছিলেন, শিক্ষাচিন্তাশীল ছিলেন না। প্রথম দিনেই ওই ভবনের অসংখ্য আসন বিকলাঙ্গ হয়ে যায়, ব্ল্যাকবোর্ড নিজের কালিমা ঘুচিয়ে ফরশা হয়ে ওঠে; বাথরুম আবর্জনাস্থলে পরিণত হয়। কারো এদিকে চোখ নেই। কর্তাদের বাড়ির দেয়াল নিয়ে প্রশাসক ও প্রকৌশলীরা বছরপরম্পরায় ব্যস্ত; কিন্তু কলাভবনের হাস্যকর মঞ্চ, বিকলাঙ্গ চেয়ার, নড়োবড়ো ডায়াস, বসার অযোগ্য বেঞ্চ, ও পাখার কর্কশ কোরাস কাউকে বিচলিত করে না। আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়ও কাউকে বিচলিত করতো না। নিয়তি আমাকে এক প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে আরেক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়ে এসেছে। চারদিকে ঝকঝকে কতো কিছু দেখি। মন্ত্রণালয়গুলো বিলাসগৃহের মতো, ব্যাংক প্রমোদশালার প্রতিদ্বন্দী, আমলাদের কক্ষে কোমল কার্পেটের আবেদন, থানাগুলো ঝকঝকে, কারো কারো জুতো আয়নার থেকেও মসৃণ, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসকদের কক্ষগুলোও নয়নাভিরাম; অবহেলিত শুধু বিদ্যার এলাকাটি। কলাভবনে আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে ফিরে পেয়ে কী যে সুখ লাগে আমার!

তারপর মুখের সেই অক্ষয় ক্লান্তি! যে-ক্লান্তি দেখেছিলাম আমার স্যারদের মুখে, তাই দেখতে পাই কলাভবনের শিক্ষকদের মুখে। আমার মুখেও লেগে আছে একই ক্লান্তি। আমরা ধরেই নিয়েছি শিক্ষকদের কোনো পার্থিব চাহিদা নেই। একজন কেরানিও বিশাল কক্ষে কার্পেট ছড়িয়ে কোমল আসন আলোকিত ক’রে বসেন, দূরালাপে ব্যস্ত থাকেন দূরালাপনীতে; কিন্তু একজন শিক্ষকের নিজের কোনো কক্ষের দরকার নেই, তিনচারজন একসাথে বসলেই তাঁদের চলে। আর দূরালাপনী- তা আমার প্রাথমিক শিক্ষকের ছিলো না, তাই এখানেও থাকতে পারে না। তৃতীয় শ্রেণীতে পাশ করে তারা যদি কেরানি হতেন, তাহলে পেতেন, প্রথম শ্রেণী পেয়ে শিক্ষক হয়েছেন বলে, ওসব তাঁদের প্রাপ্য নয়। তাঁরা শিক্ষক, তাই তারা থাকবেন বস্তিতে। আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক অনেক ভাগ্যবান ছিলেন; তাদের বস্তিতে থাকতে হয় নি; তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের স্বস্তিতে থাকতে হয়। সৎ মানুষের ভালো জায়গায় থাকা পাপ। চোরাচালানিরা থাকবেন গুলশানে, বারিধারায়; উৎকোচস্ফীত আমলারা থাকবেন সুন্দর জায়গায়; শিক্ষক থাকবেন বস্তিতে। তাঁরা যাতায়াত করবেন কীভাবে? হাঁটবেন, নইলে বাসে চড়বেন। গাড়িতে চড়বেন অন্যরা। প্রথম শ্রেণী পেয়ে শিক্ষক হ’লে এটা তো স্বীকার করতেই হবে প্রথম শ্রেণী পাওয়া ওই তরুণ প্রভাষকটি, তিনি যদি দারোগা হতেন, তাহলে বেশ থাকতেন, কতো কিছু এরই মাঝে হতো তাঁর। কিন্তু শিক্ষক হওয়ায় শাস্তি তাঁকে পেতেই হবে। বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে কাস্টমসে চলে গেলে যে যুবকটি, তাকে প্রশংসা করি: সে বুঝে ফেলেছে বিদ্যা ও জীবনের মর্মকথা। বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা গৃহশিক্ষকতা করে টাকা রুজি করছেন, ভালো থাকছেন; এটা সহ্য হচ্ছে না আমলালের! শিক্ষাকেরা কেনো ভালো থাকবেন? কোনো বাড়ি করবেন? কেনো গাড়ির স্বপ্ন দেখবেন? শিক্ষকদের যদি পুরোপুরি বস্তির অধিবাসী করে না তুলতে পারি, তাহলে আমাদের সমাজরাষ্ট্র এগোবে কেমনে? শিক্ষকেরা ঘুষ খেতে পারছেন না, তাই ভালো থাকতে পারছেন না। এ-সমাজে অবৈধ আয় ছাড়া ভালো থাকা অসম্ভব। চারপাশে শিক্ষকদের মুখের দিকে তাকিয়ে, নিজের মুখ আয়নায় দেখে, আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মুখ মনে পড়ে। একই ক্লান্তিতে আচ্ছন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মুখ মনে পড়ে। একই ক্লান্তিতে আচ্ছন্ন প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়। তারপরও চাই বিদ্যা, মৌলিক বিদ্যা, বিদ্যার উন্নতি?