রঙিন আবর্জনা

আসলে আবর্জনার বাক্স, কিন্তু পৃথিবী জুড়ে মানুষেরা গুটি সাজিয়ে রাখে বসার ঘরে শোয়ার ঘরে মাদকদ্রব্যের মধ্যে টান বোধ কার ভেতরে ভেতরে ওটি দেখার জন্যে। পরিচারিকা, শিশু ও নিষ্ক্রিয় নারীরাই শুধু নয়; চিকিৎসক, প্রকৌশলী, অধ্যাপক, ব্যবস্থাপক ও সমাজের বিভিন্ন শিরেরা আক্রান্ত এ-আবর্জনামাদক দিয়ে। ওই আবর্জনা ও মাদক আক্রান্ত করে মগজকে, খুলির ভেতর দুপুর থেকে সন্ধ্যা থেকে মাঝরাত পর্যন্ত জমতে থাকে সময়ের বিস্তর আবর্জনা। এটির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে মানুষ এ-ছোটো গ্রহটি ভ’রে রূপান্তরিত হচ্ছে এক ইন্দ্রিয়ের প্রাণীতে- চোখ ছাড়া আর কিছু দরকার নেই তাদের। শুরুতে ছিলো সাদাকালো, তাতে চোখ কিছুটা জ্বলতো; এখন রঙিন আবর্জনাকে সোনার মতো রঙিন দেখায়, শয়তানের মুখকে দেবদূতের মুখ মনে হয়, মলখণ্ডকে মনে হয় হীরের টুকরো। বিশ শতকের বাস্তব মানুষকে ওই বাক্সটি ক’রে তুলেছে এক পরাবাস্তব বিশ্বের অধিবাসী। ওটি মাদকদ্রব্যের থেকে মারাত্মক, আনবিক বোমার থেকে ভয়াবহ কিন্তু এরই কাছে মানুষের সঁপে দিয়েছে উজ্জ্বল দুপুর, স্নিগ্ধ সন্ধ্যা ও কোমল রাত্রি। বাঙলাদেশের মতো দরিদ্র দেশে, যেখানে সব কিছুই কালো, সেখানে এর রঙিন রাজনীতিক তাৎপর্য রয়েছে। ওই বাক্সে দারিদ্র্যকে রঙিন সুন্দর লাগে, বন্যাকে মনে হয় সৌন্দর্যের চল, দুর্ঘটনা হয়ে ওঠে আকর্ষণীয়, একনায়কের মুখকে নায়কের মুখ ব’লে ভুল হয়।

গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদী দেশগুলোতে এই বাক্সটি হচ্ছে বিনোদন, ও আরো বিনোদন, ও আরো বিনোদন, অর্থাৎ আরো মনোরম মাদক, ও আরো মারাত্মক মাদক; স্বৈরাচারী একনায়ক পর্যুদস্ত দেশগুলোতে ওই বাক্সটি হচ্ছে আরো স্বৈরাচার, আরো পীড়ন, আরো অধিকারহরণ। বিলেতি-ফরাশি-জার্মান বাক্সে প্রধানমন্ত্রী পাঁচ মিনিট মুখ দেখানোর সুযোগ পায় না, পাতিদের কথাতো ওঠেই না; আর তারা যখন সুযোগ পায়, ঘরে ঘরে বাক্স বন্ধ হয়, তাই পপগানের ফাঁকে ফাঁকে মুখ দেখাতে হয় তাদের। নইলে ওই মুখ কেউ দেখতে চায় না। মন্ত্রীর মুখ দেখার জন্যে তারা ঘরে ঘরে বাক্স রাখে না। স্বৈরাচারী দেশগুলো একনায়কদের পায়ের নিচে; সেখানে বাক্সটিতে সারাক্ষণ সেঁটে থাকে তাদের মুখমণ্ডল। একটি আফ্রিকি দেশে অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার সাথে সাথে আকাশ থেকে ধীরে ধীরে নেমে আসে একনায়কের মুখচ্ছবি, তাকে ঘিরে সূর্য ওঠে, চাঁদ অস্ত যায়, আকাশ গাঢ় নীল হয়ে ছড়িয়ে থাকে। আরেকটি আফ্রিকি দেশের মহান নেতা ভাষণ দেন দিনের পর দিন, আর দিনের পর দিন ধারাবাহিকভাবে তার মুখ, চিৎকার, হাত নাড়া দেখে জনগণ। এক ইউরোপী ওই দেশে গিয়ে বুঝতে পেরেছিলো সে কতো নির্বোধ। একটি নতুন বাক্স কিনে ঘরে এনে খুলেই সে দেখে দেশনায়কের মুখ, দেখেই সে বাক্স বন্ধ করে; আবার দু-ঘণ্টা পরে খুলে দেখে সেই মুখ, পরের দিন খুলেও দেখে সেই মুখ, এবং তার ও পরের দিন খুলে দেখে পর্দায় সেঁটে আছে ত্রাণকর্তার মুখ। সে বাক্সটি নিয়ে ছুটে দোকানে যায়, জানায় যে তার বাক্সটি নষ্ট, কারণ যখনি সে বাক্স খোলে তখনি দেখতে পায় পর্দায় সেঁটে আছে মহানায়কের মুখমণ্ডল। নিশ্চয়ই বাক্সটি নষ্ট, নইলে কেনো দিনের পর দিন একই মুখ সেটে থাকবে? দোকানি ওই নির্বোধ ইউরোপীকে জানায় যে তার বাক্সটি শুধু ঠিকই নেই, আছে তার শ্রেষ্ঠ অবস্থায়, কারণ তাদের মহানায়ক দিনের পর দিন ভাষণ দেয়, আর মহানায়কের মুখ যদি বাক্সে ধরা পড়ে তবে বুঝতে হবে বাকটি তার শ্রেষ্ঠ অবস্থায় রয়েছে। বাঙলাদেশে এ-বাক্সের পঁচিশ বছর হচ্ছে একনায়কত্বের পচিশ বছর; এক বড়ো একনায়ক এর উদ্বোধন করেছিলো, আর এক ছোটো একনায়ক তার পঁচিশপূর্তি উৎসব পালন করছে। এখন পালিত হচ্ছে তৃতীয়মানের স্বৈরাচারের রজতজয়ন্তী। এ-বাক্স দিনের পর দিন বাঙালিকে উপহার দিয়েছে একনায়কের মুখ, তার পরিবারের মুখ, তার ভৃত্যদেৱ মুখ। এ.-একনায়কত্বের আরেকটি দিক হচ্ছে বাক্সের সঙ্গে জড়িত সকলের প্রতিভার হঠাৎ বিকাশ। কর্মচারীরা এতে হঠাৎ অভিনেতা হয়ে ওঠে, নাট্যকার হয়ে ওঠে কেউ, তাদের সন্তানেরা হয়ে ওঠে গায়ক, নর্তকী, স্ত্রীরাও বাদ যায় না। আবর্জনা সম্প্রচারের প্রধান হয়ে যেই আসে সে-ই টের পায় তার ভেতরে একটা মস্ত শেক্সপিয়র ঘুমিয়ে আছে, খুঁচিয়ে তাকে সে জাগিয়ে তুলে, আর সাতজন অধস্তন সমকালীন শেক্সপিয়রের মাথার আবর্জনাকে নাট্যরূপ দেয়।

এ-বাক্স পঁচিশ বছর ধরে বাঙালিকে কী উপহার দিয়েছে? এর প্রথম উপহার একনায়কত্ব; এ-বাক্স একনায়কত্বকে ব্যাপক করেছে, একনায়ককে ক’রে তোলেছে নায়ক। এরপর উপহার দিয়েছে একগুচ্ছ ভাঁড়। ভাঁড়দের জনপ্রিয় করেছে। এ-বাক্স দেশ থেকে নাটক ধারণাটি দূর করতে সমর্থ হয়েছে। গত দু-দশকে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশিসংখ্যক নাটক উৎপাদিত হয়েছে এ-বাক্সে যার একটিও নাটক নয়। সোপ অপেরা বা ‘সাবানপালা’কে পরিচিত করিয়েছে নাটক নামে। এ-বাক্সটি অধ্যাপকদের বিদূষকে পরিণত করেছে। এ-বাক্সের অধ্যাপকেরা সেজেগুজে গান আর নাচের আসর উপস্থাপন করে, ইউরোপ-আমেরিকা হ’লে তাদের চাকুরি যেতো, কিন্তু এখানে তা গৌরবজনক। এ-বাক্স ঘরে ঘরে বালিকাদের নষ্ট করেছে, তাদের বুঝিয়েছে অভিনেত্রী হ’তে পারাটাই জীবনের সার্থকতা। এ-বাক্স ‘সংবাদ’ শব্দটিকে চিরকালের জন্যে নষ্ট ক’রে দিয়েছে। আমাদের বুঝিয়েছে যে পদ্মায় লঞ্চডুবিতে আড়াইস শো যাত্রীর মৃত্যুর কোনো সংবাদ নয়, তবে রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপকদের বক্তৃতা মাত্রই সংবাদ। এ-বাক্স পচিশ বছর ধ’রে ভুল বাঙলাভাষা ও ভুল বানান উপহার দিয়ে আসছে বাঙালিকে। এ-বাক্স ‘কবী’ বানান প্রচার করতেও লজ্জা পায় না; আর এ-বাক্সই আমাদের শিখিয়েছে যে ব্যবস্থাপকেরা ‘বক্তৃতা’ প্রসঙ্গে’ কোনো কথা বলে, বক্তৃতায় বলে না- এবাক্স আমাদের শিখিয়েছে যে ধর্মকর্ম করার ভালো জায়গা হচ্ছে সম্প্রচারকক্ষ, আর বুঝিয়েছে যে প্রতিক্রিয়াশীলতাই জীবনের আলো। এ-বাক্স আমাদের একটি সত্য উপহার দিয়েছে যে রাজাকারই গুরুত্বপূর্ণ, মুক্তিযুদ্ধ নয়। এ-বাক্স গত কয়েক বছরে মুক্তিযুদ্ধকে হাস্যকর করে তুলেছে; তারা মুক্তিযুদ্ধের যে-সব নাটক দেখিয়েছে তাতে মুক্তিযুদ্ধকে পরিণত করেছে ভাড়ামোতে। এ-উৎসব দেখে একটি জিনিশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে তারা ওয়াল্ডার ওম্যান-এর মতো ছবি তৈরি করেছিলো, আর ইংরেজি ছবিই তারা ভালো তৈরি করতে পারতো; বুঝিয়েছে যে বাঙলা অনুষ্ঠানগুলো তারা প্রযোজনা করেনি। বাঙলাদেশে এক সময় তেরো পার্বণ ছিলো; এখন চাষীরা উৎসব করতে পারে না, কিন্তু সরকারি চাষীরা মাসে মাসে উৎসবে মেতে উঠে।

একটি প্রশ্ন মনে জাগে যে পঁচিশ বছর পর কি ঢাকায় কোনো আবর্জনা সম্প্রচারকেন্দ্র থাকবে, থাকলে ওই আবর্জনা কেউ খাবে? ঢাকায় হয়তো কেন্দ্র থাকবে, কিন্তু সেটি হয়ে পড়বে পুরোপুরি অপ্রয়োজনীয়, কেননা তার আবর্জনা কেউ চেখেও দেখবে না। তখন হয়তো সেটিকে বিলুপ্ত ক’রে দিতে হবে। সম্প্রচারপ্রক্রিয়ার যে-উন্নতি হচ্ছে দিন দিন, তাতে আগামী দশ বছরে গ্রামের চাষী নিজের বাক্সে কেঁপে উঠতে দেখবে নগ্ন মার্কিন রূপসীকে, বস্ত্র খুলে ফেলতে দেখবে ফরাশি তিলোত্তমাকে, চোখের সামনে বিকশিত দেখবে ভারতীয় দ্রৌপদীদের; তখন এমন চাষী কোথায় পাওয়া যাবে, যে বাক্স খুলে দেখবে একনায়কের মুখ, শিখবে ধর্মকর্ম, আর তাকাবে তৃতীয় মানের ভাঁড়দের ক্রিয়াকলাপের দিকে? জাহাজ মার্কা আলকাতরার বিজ্ঞাপনটিকে আমার খুবই তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়। তবে বিজ্ঞাপনটি অসম্পূর্ণ। বিজ্ঞাপনটিতে ঞ্জালে, জাহাজে, নৌকোয়, টিনের চালে ওই আলকাতরা লাগানোর উপকারিতার কথা বলা হয়; কিন্তু বলা জরুরি ছিলো যে জাহাজমার্কা আলকাতরা লাগানোর সবচেয়ে উপযুক্তস্থল হচ্ছে টেলিভিশনের পর্দা, বিশেষ করে যখন তাতে ধরা প’ড়ে বিটিভির অনুষ্ঠান। বিজ্ঞাপনটি হয়তো অচিরেই সংশোধিত হবে, এবং বাস্তবায়িত হবে বাঙলার ঘরে ঘরে।