আর একদিন আসিও বন্ধু

আর একদিন আসিও বন্ধু- আসিও এ বালুচরে;
বাহুতে বাঁধিয়া বিজলির লতা রাঙা মুখে চাঁদ ভ’রে।
তটিনী বাজাবে পদ-কিঙ্কিণী, পাখিরা দোলবে ছায়া;
সাদা মেঘ তব সোণার অঙ্গে মাখাবে মোমের মায়া।
আসিও সজনী এই বালুচরে, আঁকা-বাঁকা পথখানি;
এধারে ওধারে ধান ক্ষেত তারে লয়ে করে টানাটানি!-
কখনো সে গেছে ওধারে বাঁকিয়া কখনো এধারে আসি,
এ’রে ও’রে লয়ে জড়াজড়ি করে ছড়ায় ধূলার হাসি।
এহ পথ দিয়ে আসিও সজনী,- প্রভাতে ও সন্ধ্যায়,
দিগন্ত-জোড়া ধানের ক্ষেতের গন্ধ মাখিয়া গায়।
-চরের বাতাস, বাতাস করিয়া শীতল করিছে যারে;
সেই পথে তুমি চরণ ফেলিয়া আসিও এ নদী পারে।

আর একদিন আসিও সজনী, এ মোর কামনাখানি,
মূক বালুচরে আখর এঁকেছি নখরে নখর হানি।
লিখিয়াছি তাহা পাখীর পাখায় মোর নিঃশ্বাস ঘা’য়ে,
আর লিখিয়াছি দূর গগনের কনক মেঘের ছা’য়ে।
সেই সব তুমি পড়িয়া পড়িয়া অলস অবশ কায়,
এইখানে এসে থামিও বন্ধু মোর বেণুবন-ছায়।
এই বেণুবন মোর সাথে সাথে কাঁদিয়াছে বহু রাতি;
পাতায় পাতায় জড়াজড়ি করি উতল পবনে মাতি।

এইখানে সখি সাক্ষ্য হইয়া রাতের প্রহরগুলি;
কত যে কঠোর বেদনা আমার তোমারে বলিবে খুলি।
রাত-জাগা পাখী কহিবে তোমারে, আমার বে-ঘুম রাতি
কাটিতে কাটিতে কি ক’রে নিবেছে একে একে সব বাতি।
সেইখানে তুমি বসিও সজনী, মনে না রাখিও ডর,
সেদিন আমার যত কথা সখি এই মূক মাটি তলে,
মোর সাথে সাথে ঘুমায়ে রহিবে মহা-মৃত্যুর কোলে।
এই নদী তটে বরষ বরষ ফুলের মহোৎসবে;
আসিবে যাহারা তাহাদের মাঝে মোর নাম নাহি রবে।

সেদিন কাহারো পড়িবে না মনে, অভাগা গাঁয়ের কবি,
জীবনের কোন্‌ কনক বেলায় দেখেছিল কার ছবি।
ফুলের মালায় কে লিখিল তারে গোরের নিমন্ত্রণ;
কে দিল তাহারে ধুপের ধোঁয়ায় নিদারুণ হুতাশণ।
সেদিন কাহারো পড়িবে না মনে কথা এই অভাগার;
জনিবে না কেউ কত বড় আশা জীবনে আছিল তার।
ধরণীর বুকে প্রদীপ রাখি সে, আকাশেরে ডাক দিত,-
মাটির কলসে জল ভ’রে সে যে তটিনীরে বুকে নিত।
এত বড় আশা কী ক’রে ভাঙিল, কি ক’রে জীবন ভোরে,
রঙ-কুহেলির সোনার স্বপন ভাঙিল সিঁধেল চোরে।
এসব সেদিন স্মরিবে না কেহ, দুঃখ নাহিক তায়;
যে গেল তাহারে ফিরায়ে আনিতে পিছু-ডাকে নাহি হায়।
যে দুখে আমার জীবন দহিল সে দুখের স্মৃতি রাখি;
সবার মাঝারে রহিব যে বেঁচে এর চেয়ে নাই ফাঁকি।

তুমিও আমারে ভেবো না সেদিন, আমার দুঃখ ভার;
এতটুকু ব্যথা নাহি আনে যেন কোন দিন মনে কার।
এ মোর জীবনে তোমার হাতের পেয়েছিনু অবহেলা,-
এই গৌরব রহিল আমার ভরিতে জীবন-ভেলা।
তুমি দিয়াছিলে আমারে আঘাত, তারি মহা-মহিমায়,
সবার আঘাত দলিয়া এসেছি এ মোর চরণ ঘা’য়।
তোমারে আমার লেগেছিল ভাল, আর সব ভাল তাই-
আমার জীবনে এতটুকু দাগ কেহ কভু আঁকে নাই।
তোমার নিকটে পেয়েছিনু ব্যথা তারি গৌরব ভরে,
আর সব ব্যথা খড়কুটা সম ছিঁড়িয়াছি নখে ধ’রে।

তুমি দিয়েছিলে ক্ষুধা,
অবহেলে তাই ছাড়িয়া এসেছি জগতের যত সুধা।
এ জীবনে মোর এই গৌরব তোমারে যে পাই নাই,
আর কারো কাছে না-পাওয়ার ব্যথা সহিতে হয়নি তাই।
তোমার নিকটে কণিকা না পেয়ে আমি হয়েছিনু ধনী-
আমার কুটীরে ছড়াছড়ি যেত রতন মানিক মণি।

তাই সেই শুভক্ষণে-
মোর পরে তব যত অন্যায় আনিও না কভু মনে।
আমারে যে ব্যথা দিয়েছিলে তুমি, তাতে নাহি মোর দুখ,
তুমি সুখে ছিলে, মোর সাথে রবে সেই স্মরণের সুখ।
আর একদিন আসিও সজনী, মোর কন্ঠের ডাক;
যতদিন তুমি না আসিবে যেন নাহি হয় নির্ব্বাক।
এ মোর কামনা পাখী হ’য়ে যেন এই বালুচরে ফেরে;
যেন বাজ হ’য়ে গগনে গগনে মেঘের বসন ছেঁড়ে।
এই কথা আমি ভ’রে রেখে যাই খর-তটিনীর জলে;
যেন দুই কূল ভাঙিয়া সে চলে আপনার কল্লোলে।
আর একদিন আসিও সজনী, এ আমার অভিশাপ-
যত দিন যাবে পলে পলে এর বাড়িবে ভীষণ তাপ।
এই বাসনার ইন্ধন জ্বালি সাজালেম যেই হোম,
কাল-নটেশের চরণের তালে জ্বলে যেন নির্ম্মম।
যেন তারি দাহ সপ্ত আকাশ ভেদিয়া উপরে ধায়,
চন্দ্র সূর্য্য মুরছিয়া পড়ে তারি নিশ্বাস ঘা’য়।
যেন সে বহ্নি শত ফণা মেলি করে বিষ উদ্গার,
তারি দাহ হ’তে তুমি যেন কভু নাহি পাও উদ্ধার!-
যতদিনে তুমি এই বালুচলে নাহি আস পুন ফিরে,-
আজি এই কথা লিখে রেখে যাই বালুকার বুকে চিরে।