সুখের বাসর

নয়ী জমিদার আদিলদ্দীন ধরি সকিনার হাত,
কহিল, ‘চলো গো সোনার বরণী, মোর ঘরে মোর সাথ!
মালার মতন করিয়া তোমারে পরিয়া রাখিব গলে,
পঙ্খী করিয়া পুষিব তোমারে আমার বুকের তলে।
গানের সুরের কথায় তোমারে উড়াব আকাশ ভরি,
আমার দুনিয়া রঙিন করিব তোমারে মেহেদি করি!’
সকিনা কহিল, ‘আপনি মহান, হতভাগিনীর তরে,
যাহা করেছেন জিন্দেগি যাবে ঋণ পরিশোধ করে।
তবুও আমারে ক্ষমা করিবেন, আপনার ঘরে গেলে,
বসিতে হইবে হতভাগিনীরে কলঙ্ককালি মেলে।
আসমান সম আপনার কুল, মোর জীবনের মেঘে,
যত চান আর সুরুয তারকা সকল ফেলিবে ঢেকে।
ধোপ কাপড়েতে দাগ লাগিলে যে সে দাগ মোছে না আর,
অভাগীর তরী ভাসাইতে দিন ভুলের গাঙের পার’

আদিল কহিল, ‘সুন্দুর মেয়ে! থাক চাঁদ মেঘে ঢেকে,
তুমি যে উদয় হও মোর মনে জোছনা ঝলক এঁকে।
মোর ভালোবাসা চান্দের সম, তব কলঙ্ক তার,
শোভা হয়ে শুধু ছড়ায়ে পড়িবে নানা কাহিনীতে আর।’
সকিনা কহিল, ‘পায়ে পড়ি তুমি আমারে বুঝো না ভুল,
কত না বিপদ সায়র হইতে তুমি মোরে দেছ কূল।
তোমার নিকটে জমা রাখিলাম ইহ-পরকাল মোর,
দণ্ডের তরে তোমারে ভুলিলে আমি যেন লই গোর।
তোমার লাগিয়া আমি যে বন্ধু তাপসিনী হয়ে রব,
গহন বনেতে কুঁড়ে ঘরে বসি তব নাম শুধু লব।
ক্ষমা করো মোরে, তোমার জীবনে দোসর হইব বলে,
সাধ থাকিলেও সাধ্য নাহিক আমারি ভাগ্যফলে।’

আদিল কহিল, ‘সুন্দর মেয়ে! তুমি কেন ভয় পাও?
আমার আকাশে তুমি হবে মোর উদয়-তারার নাও।
এই বুক মোর এত প্রসারিত, তাহার আড়াল দিয়া,
দুনিয়া ছড়ান তব কলঙ্ক রাখিব যে আবরিয়া।
এ বাহুতে আছে এত বিক্রম, তার মহা-মহিমায়,
এতটুকু গ্লানি আনিতে পাবে না কেউ অ জীবনটায়।’

‘তবু মোরে ক্ষমা করিও বন্ধু!’ সকিনা কহিল কাঁদি,
‘যারে ভালোবাসি তারে কোন প্রাণে দেব এই দেহ সাধি।’
একটি বিপদ হতে উদ্ধার পাইবার লাগি তার,
আরটি বিপদে পড়িতে হয়েছে বদলে এ দেহটার।
পণ্যের মতো দেহটারে সে যে বিলায়েছে জনে জনে,
কোন লালসার লাগি নহে শুধু বাঁচিবার প্রয়োজনে।
এই মন লয়ে কতজন সনে করিয়াছে অভিনয়,
কত মিথ্যার নকল রচিয়া ফিরেছে ভুবনময়।
সে শুধু ক্ষুধার আহারের লাগি কে তাহা বুঝিতে পাবে?
সবাই তাহারে চিন্তা করিবে নানা কুতসিৎভাবে।
সেই মন আর সেই দেহ যাহা সবখানে কদাকার,
কেমন করিয়া দিবে তারে যেবা সব চেয়ে আপনার।
‘পায়ে পড়ি তব, শোন গো বন্ধু! ছাড় অভাগীর আশা,
আমারে লইয়া ভাঙিও না তব আসমান সম বাসা।’

আদিল কহিল, ‘বুঝিলাম মেয়ে! রজনী হইলে শেষ,
রাতের বাসারে উপহাসি’ পাখি চলে যায় আর দেশ;
সকল বিপদ হইতে তোমারে করিয়াছি উদ্ধার,
আমারে লইয়া তোমার জীবনে প্রয়োজন কিবা আর?’
‘কি কথা শুনালে পরানবন্ধু!’ সকিনা কাঁদিয়া কয়,
‘তীক্ষ্ণ বরশা-শেল যে বিঁধালে আমার জীবনটায়।
এত যদি মনে ছিলো গো বন্ধু, এই অভাগিনী তরে,
তোমার পরান অমন করিয়া এমনই যদি বা করে,
আমারে লইয়া এতই তোমার হয় যদি প্রয়োজন,
আজি হতে তবে সঁপিলাম পায়ে এই দেহ আর মন।
সাক্ষী থাকিও আল্লা রসুল! আপন অনিচ্ছায়,
সবচেয়ে যেবা পবিত্র মম তারে দিনু আমি হায়;
এই দেহ মন যাহা জনে জনে কালি যে মাখায়ে গেছে,
তাই নিল আজি মোর ফেরেস্তা আপনার হাতে যেচে।
বনে থাকো তুমি পউখ পাখালি আমারে করিও দোয়া,
আজ হতে আমি বন্দী হইনু লইয়া ইহার মায়া।
অনেক উর্ধ্বে থাকো গো তোমরা চন্দ্র-সুরুয দুটি,
মোদের জীবন রহে যেন সদা তোমাদের মতো ফুটি।
দোয়া করো তুমি সোনার পতি গো, দোয়া করো তুমি মোরে,
তোমার জীবনে জড়ালাম আমি লতার মতন করে।
এ লতা বাঁধন জনমের মতো কখনো যেন না টুটে,
যত ভালোবাসা ফুলের মতন রহে যেন এতে ফুটে।’

সকিনারে লয়ে আদিল এবার পাতিল সুখের ঘর,
বাবু পাখিরা নীড় বাঁধে যেথা তালের গাছের পর।
সোতের শেহলা ভাসিতে ভাসিতে এবার পাইল কূল,
আদিল বলিল, ‘গাঙের পানিতে কুড়ায়ে পেয়েছি ফুল।
এই ফুল আমি মালায় গাঁথিয়া গলায় পরিয়া নেব,
এই ফুল আমি আতর করিয়া বাতাসে ছড়ায়ে দেব।
এই ফুলে আমি লিখন লিখিব, ভালোবাসা দুটি কথা,
এই ফুলে আমি হাসিখুশি করে জড়াব জীবন-লতা।’

করিলও তাই, সকিনারে দিয়ে রঙের রঙের শাড়ি,
আদিল কহিল, ‘সবগুলি মেঘ এসেছে সন্ধ্যা ছাড়ি।
সবগুলি পাখি রঙিন পাখায় করেছে হেথায় মেলা,
সবগুলি রামধনু এসে দেহে জুড়েছে রঙের খেলা।’
ঝলমল মল গয়নায় গাও ঝলমল মল করে,
ঝিকিমিকি ঝিকি জোনাক মতিরা হাসিছে অঙ্গ ধরে।