আলোর মেলা

ঐ যেখানে নীল পাহাড়ের নীচে
ভুট্টাক্ষেতের পিছে,
সারি সারি শালের গাছে ঘেরা-
রাঙামাটীর মাঠের উপর ধেনু চরায় রাখাল বালকেরা
কালো-কালো, মোটা সূতোর খাটো কাপড় পরা,
স্বাস্থ্যে শরীর ভরা;
ওরি পাশে- ঐ যেখানে ধোঁয়ার মতন গাছের মাথা জাগে,
একশ’ বছর আগে
আমি ছিলাম ছোট্ট একটি গাঁয়ে-
শীর্ণ একটী গিরিনদীর কোলের কাছে মউলবনচ্ছায়ে।

ক্ষেতের কাজে ধেনুর মাঝে পলাশবনের পারে
নীল পাহাড়ে ঝরণাতলার ধারে-
দিনগুলি মোর বয়ে যেত ঝরণাধারার মত,
মুড়ির মতন বাজত শুধু কানের কাছে সহজ অভাব যত;
গাছে উঠে সাঁতার কেটে, লাফিয়ে পাহাড় থেকে,
হেসে খেলে নেচে গেয়ে হেঁকে,
কাটিয়ে দিতাম বেলা-
জীবন যেন মনে হ’ত খেলা।

পিয়ালবনের পাশে
প্রভাত আস্ত দুধের বন্যা খেলিয়ে নীলাকাশে;
সন্ধ্যা আস্ত নেমে
শালের বনের শাখায় শাখায় থেমে থেমে,
ঝিঝির ঝর বাজিয়ে পায়ে-পায়ে-
আলো-কালোর পাখ্না দুটি বুলিয়ে দিয়ে বসুন্ধরার গায়ে।

বিজলি বলে’ ছোট্ট একটা পাহাড়পারের মেয়ে
ঝরণা হ’তে নিত্যি সেত নেয়ে,
ভরে’ নিয়ে কোলের কলসপানি;
ঘটের বারি মুখের পানে চেয়ে তারি করতে কানাকানি,
কি আনন্দে- মনে হ’ত, আমি তাহা জানি!
দিনগুলি মোর এমনি করে’ কাট্ত কলস্বরে,
পাখী-ডাকা ছায়ায় ঢাকা পাহাড়ঘেরা বনভূমির ‘পরে!

এমন সময় একদা এক সাঁঝে-
সুদূর মাঠের মাঝে,
কোথায় থেকে ভারি একটা আলোর মেলা বস্ল জেঁকে এসে;
হুলুস্থুলু পড়ে’ গেল দেশে।
সবাই বল্লে, যাব যাব- অন্ধকারে লাগেনা আর ভালো,
আলো আলো- দেখব মোরা আলো!

আমার সাথে আরো অনেক জনা
যাত্রা করল মেলার দেশে আলোর ডাকে উদাসী উন্মনা।
গিয়ে দেখি, কি যে চমৎকার-
শোভার বাহার, রঙের বাহার- তুলনা নাই তার!
আস্তে-আস্তে কইনু বারেক- দীপ্তি চেয়ে দাহই বেশী যেন!
সবাই হেঁকে বল্লে অম্নি- ননীর পুতুল! আসতে গেলে কেন?
অপূর্ব সে সমারোহ, অশেষ তাহার কথা-
অনন্ত তার রূপরাশি, অফুরন্ত আবেগ চঞ্চল!
সজ্জাসাজের নাইক অন্ত, যন্ত্রতন্ত্র নানা-
বৃহৎ ক্ষুদ্র বিচিত্র কারখানা;
একে-একে আলোকশিখায় পড়ল আঁখি ‘পরে-
সংখ্যাহারা বস্তুরাশি সুবিন্যস্ত স্তরে স্তরে স্তরে।

শিখে’ শিখে’ পাক্ল মাথা, দেখে’ দেখে’ দৃষ্টি হ’ল ক্ষীণ-
এম্নি করে চলল কেটে দিন
আলোর মেলার দেশে,
নূতন দেখার উৎসাহে আর নূতন শেখার অনন্ত আবেশে;
এমনি হ’ল- দীপ্তি ছাড়া দেখতে পাইনা চক্ষে,
একটুকু তার কম্তি হ’লে থাকেনা আর রক্ষে।
কোথায় গেল ঘরের কথা, ক্ষেতের ফসল, অভ্রনদীর পার,
নীল পাহাড়ে ঝরণাতলার ধার,
বিজলি মেয়ের উজল কালো আঁখি,-
মনের চোখেও লাগল ধাধা অষ্টপ্রহর আলোর মধ্যে থাকি’

আধ শতাব্দী গেল কেটে-
আলোর দেশের জিনিষ দেখে’ আলোর দেশের পুঁথি ঘেঁটে ঘেঁটে
সেদিন রাতে বসে’ আছি মোড়ের উপর জ্বালিয়ে নিয়ে বাতি,
কেতাব খোলা সম্মুখেতে, কথার উপর কথার মালা গাঁথি’
চল্ছি ভীষণ তোড়ে;
এমন সময় হঠাৎ হুহু করে’
পূবে হ’তে এল একটা ঝড়ো’ বাতাস-
নিবিয়ে গেল আলো ক’টা- কি সর্ব্বনাশ।
পুঁথি পড়া বন্ধ একেবারে;
চমকে উঠে চেয়ে দেখি চারিধারে
আকাশ ঘিরে’ চুপটি ক’রে ব’সে আছে কারা?
ওরে ওরে! পূর্ণিমারা যায়নি আজো মারা!
জ্যোৎস্না-মরাল ঐ ত মেলে’ ডানা
কোন্ জননীর স্নেহ নিয়ে পাহারা দেয় শিশুকুলায় খানা।
তারি ডানার শুভ্র পাখাগুলি
চারিধারে আকাশ ভরে’ ফুলের মতন উঠছে দুলি’ দুলি’!
ওরে ওরে, এযে দেখি মাতৃস্তনের স্নিগ্ধ সুধাধার;
এ যে দেখি স্নেহের বন্যা- আকাশ-ভরা লাবণ্যজুয়ার!

এ আলো যে নিবায় না রে- দেই মনের এ যে শুভদৃষ্টি।
মলিন হাতের সৃষ্টি-
দাহভরা দীপ্তি দিয়ে তারেই রেখে দিয়েছিলাম দুরে;
কোন্ বিধাতার আশীর্বাদে আজকে আমার চিত্ত-আকাশ জুড়ে’
বাজে তারি আবাহনের শাঁক-
ক্ষীরোদসাগর হ’তে যেন ডাকেন লক্ষ্মী ঘরের ফেরার ডাক!
এ স্নেহ যে গৃহ চেনায়- এ আলো যে নত করায় মাথা,
এ মধু ডাক ভিজায় আঁখির পাতা।

এক নিমেষে গেল টুটে’ সকল বাধা,
মনে হ’ল, হায়রে অন্ধ! এ দৃষ্টি তুই দিয়েছিলি কোথায় বাঁধা।
পড়ল মনে ফিরে’-
সহজ সুখের শান্তিভরা পল্লীমাকে অমনি ধীরে ধীরে;
পড়ল মনে, সারি-সারি শালের বনে ঘেরা
রাঙামাটির মাঠের উপর ধেনু চরায় রাখাল বালকেরা;
মনে হ’ল- ঘরের কথা ক্ষেতের ফসল অভ্রনদীর পার,
নীল পাহাড়ে ঝরণাতলার ধার,
বিজ্লী মেয়ের উদার কালো আঁখি-
চোখের নেশায় আর কি ভুলে’ থাকি?
ফিরে’ এলাম তাই-
মনের চোখে সেদিন আমার নেশার বালাই নাই।