দ্বিজেন্দ্র-বিয়োগে

সমুদ্রমন্থনদিনে দেবাসুরে নিল ভাগ করি
সিন্ধুর যা-কিছু রত্ন; বেলাভূমে ছিল সেথা পড়ি
একখানি শুক্তি শুধু; বিধাতা দিলেন তাহা নরে-
হাসি-অশ্রু যুগ-মুক্তা গাঁথা যার গোপন গহ্বরে।
ছল-ছল স্বচ্ছশোভা অশ্রুমুক্তা স্বভাব-কোমল-
মানবের চক্ষে-চক্ষে ফিরিতে লাগিল ভূমণ্ডল;
হাস্য ছিল সঙ্গোপনে- ঢল-ঢল লাবণ্যসম্ভার!
তুমি কবি, আহরিয়া সুদূর্লভ সেই উপহার,
সমর্পিলে মহা হর্ষে মর্তবাসী আর্তজন লাগি-
হাসিল তমসাতীরে অকলুষা উষা যেন জাগি;
সাহিত্যের কুঞ্জে-কুঞ্জে কণ্টকে ফুটিল পুষ্পরাশি-
বঙ্গবাসী প্রাণ পেল হাসি সেই বঙ্গভরা হাসি!

কিন্তু হায়! কে মুছিবে নিয়তির অব্যর্থ লিখন-
দরিদ্র বাঙালি-ভাগ্যে আনন্দ যে ঐশ্বর্য-স্বপন!
তাই আজি বঙ্গাকাশে সহসা নিবিল ধ্রুবতারা,
আনন্দের পূর্ণচন্দ্র অকস্মাৎ হল জ্যোতিহারা;
বসন্তে জাগায়ে দিয়া কোকিল কোথায় গেল চলি
‘গৃহস্থের খোকা হোক’- কাঁদিল সে ‘চোখ গেল’ বলি!
এ যেন কৌতুক-নাট্যে প্রথমাঙ্কে যবনিকা টানি
নিবাইল দীপালোক শুনাইল অস্তিমের বাণী!
রঙ্গরসে সারা বঙ্গ মাতাইয়া যেন অর্ধপথে-
বঙ্গ-বৃন্দাবন-চন্দ্র আরোহিলা অক্রূরের রথে।
যে দিয়াছে এত সুখ- সেও এত দুঃখ দিতে জানে-
হায়রে দুর্ভাগা দেশ! আনন্দ কি সহে তোর প্রাণে!

ঐ শোন, লক্ষ কণ্ঠ তোমারে ডাকিছে ফিরে আজি-
ঐ দেখ, লক্ষ চক্ষু বরষিছে তপ্ত অরাজি!
আপনি স্বদেশ-লক্ষ্মী- হের, আজি শূন্য কোল নিয়া,
কবিবর, তোমাপানে অশ্রুনেত্রে আছেন চাহিয়া!
এরি মাঝে মর্ত্যে তব কর্তব্যের হইল কি শেষ?
‘সকল দেশের রানী’ আজিও যে চিনিল না দেশ!
‘স্বর্গ আমার’ বলি- গর্বভরে ডাকে কয় জন-
‘মানুষ হবার লাগি’ গৃহে-গৃহে কই আয়োজন?
শিখিয়া বিলাতি বুলি, বাংলা ভুলিতে আজো সাধ,
গণ্ডমূর্খ ‘চণ্ডী’ করে লণ্ডভণ্ড হিন্দুধর্মবাদ!
এখনো এ দগ্ধদেশে ছদ্মবেশে ফিরে ‘নন্দলাল’-
ফিরে এস, ফিরে এস- সাহিত্যের আনন্দ-দুলাল!
শতাব্দীর দুঃখদৈন্য জর্জরিত যাহার হৃদয়,
হাস্য যে অমৃত তার- অবসন্ন আত্মার অভয়!
তুমি সেই অমৃতের কবি, ঋষি, মহাপ্রচারক,
দেশভক্ত মহাকর্মী, জননীর অক্লান্ত সাধক;
তুমি শুধু কবি নই, কবিরাজ তুমি ধন্বন্তরি-
মুমূর্ষ বাঙালিদেহে তুমি দিলে জীবনী সঞ্চরি
সঞ্জীবনী হাস্যমন্ত্রে; পাংশুমুখে ফুটি উঠে হাসি,
উঠি বসে শীর্ণ রোগী- গৃহে বাজে আনন্দের বাঁশি।
কিন্তু কবি, অসমাপ্ত রয়ে গেল সমারব্ধ কাজ-
‘এমন চাদের আলো, মরি যদি’- তাই সত্য আজ!
যাও তবে কবিবর, ‘সুরধামে’- ‘মহাসিন্ধুপারে’;
তোমারি অমৃত-গীতি শান্তি দিক আজি সবাকারে।