গোবিন্দ দাস

যা দিবার দিয়াছ ত- আর কেন? যাও তবে সরে’-
বাঁচিয়া মরিয়াছিলে, পার’ যদি বাঁচ আজ মরে’!
পিছনে চেওনা আর দেখিবারে মিথ্যা অভিনয়-
ভক্তি-অশ্রু শোক সভা স্তুতিমুগ্ধ বিষন্ন বিনয়,
দেশ-যোড়া লেখনীর আন্দোলন- সবই হবে ঠিক;
হিয়াহীন হাহাকার কালীতে ভরিবে চারিদিক!
জীবনে দিবনা অন্ন, মরণে স্মরণচিহ্ন লাগি’
দানসাগরের ফর্দ্দ হাতে লয়ে শ্রদ্ধা-অর্ঘ্য মাগি’
ফিরিব দেশের দ্বারে, ভিক্ষায় সারিতে শ্রদ্ধা-ক্রিয়া;
তার বেশী চাহিওনা- সে ত মোরা শিখিনি দেখিয়া।

পুষিব বনের পাখী- দিনরাত শুনাইবে গান-
এই সৰ্ত্ত তার সাথে; মোরা শুধু ভরি’ লব কান
অবসর-ক্ষণে কভু। শস্যকণা যদি চাহে প্রাণী-
তবে সে বনেরই জীব- তার তরে লজ্জা শুধু মানি!
দেহান্তে কেন বা তবে আস্ফালন, কেন এ শিষ্টতা?
এ শুধু সৌখীন শোক, এ সেই বিলাস-বান্ধবতা!
দরিদ্রকন্যারে আনি’ আমরণ বঞ্চি’ নিজ ঘরে,
বন্ধুত্বের ঋণ শুধি, জাননা কি, শ্রাদ্ধ আড়ম্বরে!
আজন্ম উচ্ছিষ্ট-পুষ্ট বিড়ালের বিবাহ দি’ যবে
লক্ষ মুদ্রা ব্যয় করি’- তাহারে কি পশুপ্রীতি কবে?

অরণ্যের প্রিয় পিক! শেখ নাই সভ্যতার বুলি,
তুমি শুধু গেয়ে গেছ তেজোতীক্ষ্ণ কণ্ঠখানি খুলি’
স্বভাবসহজ ছন্দে, পূর্ণ করি’ পল্লীর আকাশ-
প্রাণবান প্রতিভার বাণীবিদ্ধ বিচিত্র বিকাশ!
ক্ষুদ্র সুখ ক্ষুদ্র দুঃখ নিত্য ঘিরি’ আছে যা মানবে,
তুমি গাহিয়াছ, তাহা ক্ষুদ্র বলি’ তুচ্ছ নহে ভবে;
এ বিশ্বের বড় যাহা- দৃষ্টিরোধী পর্বতপ্রমাণ,
তাহাই কেবল হেথা নহে নহে নহে মহীয়ান;
বাহিরের বিশালতা বিরাটের মূর্ত্তি নহে কভু,
মনের কণ্টকব্যথা সূক্ষ্ম দুঃখ মানবের প্রভু-
নিত্য নিয়মিত যাহা করিতেছে অজ্ঞাত সৃষ্টিরে,
বাহ আবরণ ভেদি’ অন্তরালে পাঠায়ে দৃষ্টিরে!

দরিদ্র গৃহস্থ চাষী- নিখিলের মৌন অন্তঃপুরে
তোমার স্নেহার্ত্ত ধ্বনি ফিরিয়াছে সুধাস্নিগ্ধ সুরে;-
করুণার মোমে মাখা মমতার সুধা-প্রস্রবণ
সর্বত্র ঝরায়ে দিয়া সৃজি’ নব সৌন্দৰ্য্য-নন্দন।
তুমি গাহিয়াছ, প্রেম রাজ্য ত্যজি’ আছে বনবাসে;-
গৃহস্থের ভাঙ্গা ঘরে, দরিদ্রের পাতার আবাসে;
যেথায় নিভৃত প্রান্তে অরণ্যের প্রশান্ত সীমায়
অমৃতের পুণ্য ফল্গু শব্দহীন ধীরে বয়ে যায়!

যে ‘অতুল’-স্নেহচিত্র আঁকিয়াছ কুটীর-অঙ্গনে,
তুলনা তাহার, কবি! হেরি নাই কভু এ নয়নে;
নিকুঞ্জের পরভৃৎ! শিখিতে পারনি পোষা বুলি,
ধনীর উদ্ধত দর্পে কণ্ঠ তব যায় নাই ভুলি’
সহজস্বভাব-দত্ত প্রকৃতির অজেয় সম্মান,
কুহু কুহু করি’ তাই ধিক্কারি’ করেছ প্রত্যাখ্যান-
যা কিছু অন্যায় মন্দ পড়িয়াছে আঁখির সম্মুখে,
বিনিময়ে বিষদিগ্ধ তীক্ষ্ণ শর পাতি’ লয়ে বুকে!

বাণীর বরেণ্য পুত্র! বাঙ্গালীর কলকণ্ঠ কবি।
আজি তুমি কথাশেষ- মধু অন্তে মুদিত মাধবী।
রোগে শোকে দুঃখে দৈন্যে বুক চিরে’ ছিঁড়ে’ ফেলে’ গলা
শুনাতে চেয়েছ- থাক কি কাজ সে কথা ফিরে’ বলা!
ভাষারে কি দিয়ে গেছ- তাই বা বলিয়া কোন্ কাজ!
শুধু জানি আমাদের ছেড়ে তুমি চলে’ গেছ আজ
কাব্যের অমৃতলোকে- যেথায় দৈন্যের নাহি গ্লানি,
আপনি সাধিয়া যেথা দীন হস্তে দেবী বীণাপাণি
সাজিছেন বর রত্নে, কুঙ্কুম’ ‘কস্তূরি’ করে ধরি’
‘চন্দন’ ও ‘ফুলরেণু বক্ষে পরি’ ত্রিলোকসুন্দরী।

হাসিছেন পদতলে বিমুগ্ধ ভক্তের পানে চাহি’।
সেথায় কি নব গান কোন্ ছন্দে উঠিতেছ গাহি’;-
শুনিতে পাবনা মোরা কিন্তু হায়! আর কেন? থাক্-
যে গেছে সে যাক্ চলে’- মুগ্ধবাণী হউক্ নির্ব্বাক!
কি হবে কথায় মিছে- কথার অতীত সে যে আজ;
প্রগলভ বচনে আর বাড়াব না কলঙ্কের লাজ।