কেয়াফল

(বিশ বৎসর পরে)

আবার সেই শ্রাবণরাত, আবার সেই কেয়া!
আবার সেই মাথার ‘পরে গরজি মরে দেয়া;
কাঁপিয়া উঠে কাননতল, ছাপিয়া ছুটে নদীর জল,
হাঁপিয়া উঠে পরানমন অকূলে খুঁজি খেয়া!

শরৎ আসে, শরৎ যায় শেফালি ফুলবনে;
কমল-সরে শিশির মরে- জানি না, কোন ক্ষণে;
পলাশ চলে মলয়-রথে, বকুল ঝরে নিদাঘপথে-
না পেয়ে সাড়া কোথায় তারা হারায় অযতনে!

সকল দ্বার বন্ধ করি রুধিয়া বাতায়ন,
হৃদয় জানে, পাষাণে তারে বেঁধেছি কী কারণ!
উপায়হীন ঝড়ের পাখি কুলায় তলে মাখাটি রাখি
যেমন করে পাখার স্মৃতি ভুলিতে সযতন।

পঞ্চশর মূৰ্ছাগত পঞ্চাশের পারে,
প্রীতির কথা জাগায় শুধু স্মৃতির বেদনারে;
কুসুম গেছে রাখিয়া বাস, কারণ-হারা দীর্ঘ-শ্বাস
আপনা হতে উঠিয়া শুধু মিলায় চারিধারে!

শ্রাবণরাতে বাতাস মাতে, অঝোরে ঝরে জল,
বিদ্যুতের দীপ্ত কশা দেখায় রসাতল;
বেসুরা এই মনের মাঝে বেতাল-তালে মাদল বাজে,
তাহারি ফাঁকে আবার হাঁকে কেতকী-পরিমল!

সকল বাস সহিতে পারি, পারি না কেতকীরে-
হেলায় সে যে ভুলায়ে দেয় ধুলার ধরণীরে!
নিমেষে কোন অজানা টানে হারানো মুখ ফিরায়ে আনে-
সাঁঝের মেঘে ভোরের তারা ফুটায়ে তুলে ধীরে!

চন্দ্রমার নাহিকো বার, বন্ধ আজি খেয়া,
সময় বুঝে উপরে নিচে দ্বিগুণ ঝরে দেয়া।
শিহরি উঠে কাননতল, শিহরি ছুটে নদীর জল,
পুরানো সুরে শিয়রে ফিরে হাঁকিল কে রে কেয়া?

কণ্ঠে আর সে জোর নাই- চিনিনু তবু স্বর,
জীবনভোর বাদলে বুঝি ভেঙেছে কলেবর।
বৃষ্টিভেজা ওষ্ঠপুটে করুণ হয়ে ধ্বনিটি ফুটে-
পিছল পথে চলিতে কাঁপে চরণ থরথর!

উজাড় করি তোমার ডালা সেদিন দিলে ফুল,
মনের ভুলে আঁজল ভরি দিলাম তার মূল,
আজিকে মোর দুঃসময়, তুমি আর সে-তুমি নয়
তবুও ওই কেয়ার বাসে জাগিয়া উঠে ভুল!

এ ঘোর রাতে বাদল-বাতে যেয়ো না তুমি আর,
কে চাহে ফুল? সকল ঘরে বন্ধ দেখ দ্বার;
সৌরভেরও সময় আছে, আদর মিলে সবার কাছে-
সময় গেলে ফুলের হাসি- সেও যে গুরুভার!

অসময়ের সময় শুধু আমারি আছে জাগি,
হৃদয় যায় কাঁপে না আর তুচ্ছ আশা লাগি।
শ্রাবণরাতে কেয়ার বাসে মরণ যদি ঘনায়ে আসে,
তোমার পাশে একটি ফুল ভিক্ষা তাই মাগি।
এ ঘোর রাতে বাদলে বাতে রয়েছি আমি জাগি।