কবি-বন্ধু সত্যেন্দ্রনাথ

হে দীর্ঘ পথের বন্ধু, হে কবি সচ্ছন্দছরাজ!
এ কি অভিনব ছন্দে মৃত্যু-মন্ত্রে বরি’ নিলে আজ
আপন মর্ম্মের মাঝে, সহসা পথের মধ্যখানে!
অতৃপ্ত তৃষ্ণার মত সুর শুধু ঘুরে’ মরে কানে।
রিক্ত-আশা বঙ্গভাষা বিয়োগিন কঁদিছে করুণ
দুর্ভাগ্য দেশের বুকে- মধ্যপথে মুদিত অরুণ!
বিরহের মন্দাক্রান্তা আষাঢ়ের মেঘমন্দ্রমাঝে
গুমরি’ গুমরি’ তাই বাঙ্গলার বক্ষে আজি বাজে।

শুনেছি- বরুণমন্ত্রে বিনা-মেঘে বৃষ্টিধারা ঝরে,
প্রমূর্ত্ত দীপকরাগে কলাবিৎ নিজে পুড়ে’ মরে;
জানিনাক কোন সুরে বন্ধু তুমি বেঁধেছিলে বাঁশী-
রুদ্র পরিণাম যার মূর্ত্তিমান দেখা দিল আসি’
সমগ্র দেশের বুকে অকস্মাৎ বজ্ৰব্যথা হানি’-
বঙ্গসারস্বতকুঞ্জে মূর্চ্ছাতুর নিজে বীণাপাণি!
যাজ্ঞিকের হোমশিখা সমারব্ধ যজ্ঞ-সূচনায়
লাগিল কেবল গৃহে- যজ্ঞ শেষ হ’লনাক হায়!

ভৃঙ্গারে শুকায়ে গেল সমাহৃত পুণ্যতীর্থবারি-
ভক্তের নয়নে শুধু রাখ’ তার শেষ অশ্রুঝারি!
কাব্যের নিকুঞ্জ থেকে কুহু-কেকা লভিল বিদায়,
চোখ গেল- চোখ গেল, ভগ্নকুঞ্জে শুধু বাহিরায়।
কুলিখানি অশ্রুজলে অঙ্কে তুলি’ রাখিল ভারতী-
কে লিখিবে লেখা আর, কে করিবে একান্ত আরতি
নিত্য-নব-নব ছন্দে মন্দিরেতে তুলিয়া ঝঙ্কার-
কভু সহজিয়া ভাষা, কভু সাম কভু বা ওঙ্কার!

আর কেন ছন্দ গাঁথি- বন্ধু গেছে ছন লয়ে সাথে;
মোরা শুধু মন্দভাগ্য পড়ে’ আছি চাহিয়া পশ্চাতে
শুধিতে দুঃখের ঋণ- নেত্রপথ রুদ্ধ অশ্রুজলে-
কবে মিলাইবে তার দৃশ্যপট জবনিকাতলে।
শুধু থেকে-থেকে আজ এক কথা জেগে উঠে মনে,
কেন তুমি চলে গেলে অকস্মাৎ হেন অকারণে!
যাবার সময়, তা যে শুধাবার দিলেনা সময়,
শুধাবার দূরে থাক্- হ’লনাক দৃষ্টিবিনিময়।

দুর্ভাগিনী বঙ্গভূমি- ছিল যে প্রাণের চেয়ে প্রিয়;
যার নাম জপমালা, নামাবলী যার উত্তরীয়
ছিল তব অনুদিন; সে বঙ্গ তেমনি ভাগ্যহীন,
লাঞ্ছিত বিশ্বের দ্বারে, পায়ে-পায়ে পরের অধীন;
তারে কি বলিয়া আজি ছেড়ে গেলে, তাই ভাবি মনে-
সিংহাসন কৈ দিলে? লুটায় সে কণ্টক-আসনে!
রাণী বলে’ ডেকেছিলে- এই কি রাণীর যোগ্য সাজ;
জননী বলিয়া ডাকি’ ঘুচালেন জননীর লাজ?

হে দেশবৎসল! তবু সত্যসন্ধ তোমার সন্ধান
আজি আরো হানে মৰ্ম্মে- তব সত্য কত বড় দান-
যাহা তুমি রেখে গেছ! মুর্ত্তি যত পশ্চাতে লুকায়,
অভাবের অন্ধকার ঝলি’ উঠে দীপ্ত প্রতিভায়।
তাই চোখে পড়ে যত ধরণীর ধুলি আর বালি-
দেশযোড়া অসত্যের পুঞ্জীভুত কলঙ্কের কালী!
তবু যে তোমারে চাই- ভাব নিয়ে ভরে না জীবন-
মাটির মানুষ মোরা, মাটি যে প্রকাণ্ড প্রয়োজন!

কি ফল বিফল বাক্যে; গেছ যদি যাও কবি, যাও-
ফুলের ফসল ফেলি’ এ ধরার, যদি সুখ পাও
নবীন নন্দনে আজি- অম্লান মারে ভরি’ ডালা,
গাঁথিতে নূতন ছন্দে বরদার বর কণ্ঠমালা
হেথা সবি পুরাতন, ধুলিস্লান দৈন্যভারাতুর;
চিত্ত নিত্য অশ্রুনেত্রে চায় হেথা বিয়োগ-বিধুর।
নিষ্পলক মাতৃনেত্রে ঝরে সেথা যে প্রসন্ন হাসি-
তারি স্পর্শে ধৌত হোক ধরণীর সর্ব্ব ধূলিরাশি।