পাশার বাজি

বন্দী মারাঠী মুক্তি লভিল? মোগলে জিনিল ছলে!
আরাংজেবের চিত্ত ভরিল হিংসার হলাহলে;
গর্জ্জি’ উঠিল দানবের দূত,
চক্ষে ঝলিল রোষ-বিদ্যুৎ,
মোয়াজেমে আজই ভেজি’ দাও খৎ- ছলে না পারুক, বলে
বাঁধিয়া আনুক অধম কাফেরে তক্ত-তাউস-তলে।

বাদশা-আদেশ বুকে বাধি’ দূত উঠিল অশ্বযানে-
ছিলা-ছেঁড়া তীর ছুটে’ চলে যেন- না চাহি’ কাহারও পানে।
ওমরাহ যত আগ্রা নগরে
নীরবে ফিরিল যে যাহার ঘরে;
সেদিনের মত দরবার হ’ল চুরমার সেইখানে,
বুকে বাধি’ খৎ ছুটে’ চলে দূত, বিরাম নাহিক জানে।
* * * *
দ্বারে বিজাপুর ঈর্ষা-আতুর, বাহিরে প্রলয়-ঝড়
মোগলের মেঘে উঠিয়াছে জেগে ঘনাইয়া অম্বর!
ক্ষুব্ধ শিবাজী রায়গড়শিরে
ভাবিতেছে বসি’ সন্ধ্যাতিমিরে,
শতবার করি’ ডাকি’ ভবানীরে মাগিছে বিজয়-বর;
কয়দিন হ’ল মোগলের হাতে গিয়াছে সিংহগড়!

প্রতাপগড়ের ছাদে বসি’ হোথা বিষ জীজাবাই-
হাতীর দাঁতের চিরুণীতে চুল বাঁধিতেছে সন্ধ্যায়।
সম্মুখে দূরে পশ্চিম কোণে
দৃষ্টিটি তার ধায় আনমনে,
সিংহগড়ের উর্দ্ধে যেখানে সূর্য অস্ত যায়-
আরক্ত-আভা ডিম্বের মত গম্বুজ-কিনারায়।

সহসা কি ভাবি’ উঠিলা জননী- বেণী বাঁধা রহে বাকী,
সিপাহীরে হাঁকি করিলা আদেশ- ‘শিবাজীরে আন ডাকি’;-
রায়গড় মাঝে যেখানে সে থাক্,
যা-কিছু করুক- খাক্ বা ঘুমাক্-
জরুরী তলব- এখনি সে আসে শত কাজ ফেলি’- রাখি’- ।
মুখপানে চাহি’ ভাবিল সিপাহী- মা আজ ক্ষেপিল নাকি!

জননী-আদেশে নিমেষে পুত্র দুয়ারে দাঁড়াল আসি’
‘কৃষ্ণা’য় চড়ি’ বীরবেশ পরি’ ললাটে ভ্রূকুটিরাশি!
বন্দিয়া মার চরণ দু’খানি
কহিলা পুত্র যুড়ি দুই পাণি-
‘যে আদেশ হয় কর মা জননী- মনে বড় ভয় বাসি’
আশিষ-হস্ত বুলায়ে ললাটে মা কহিলা মৃদু হাসি’

‘বড় সাধ মনে- পুত্রের সাথে খেলিব আজিকে পাশা- ‘
‘মার সাথে বাদ’- কহিলা শিবাজী- ‘খেলাও সর্বনাশা!’
অনিচ্ছা তার মনে-মনে মানি’
কহিলা জননী বিদ্রুপ-বাণী-
‘মার সাথে বাদ ঘটিবে খেলায়! এ দেখি যুক্তি খাসা!’-
মনে-মনে শুধু ডাকিলা- ‘ভবানি! পূরাও মনের আশা!’

চকিতে জননী বিছাইলা ছক পাষাণশিলার পর-
সুরু হ’ল খেলা- ডাকিল পাষ্টি কড় কড়- গড় গড়!
ফেলে জীজাবাই যত বড় দান,
মৌন শিবাজী তত ম্রিয়মাণ-
পাকা ঘুঁটি হারি’ শঙ্কিত প্রাণ- থর থর কাঁপে কর-
যত যায় খেলা, তত বাড়ে রোখ্,- ক্রমশঃ ভয়ঙ্কর!

জিনিয়া তনয়ে পড়ে শেষ পাশা কড়-কড়-গড়-গড়-
হাঁকে জীজাবাই বিজয়মত্ত- ‘কি পণ ধরিবি ধর্’!
ধীরে কহে শিব- ‘তোমার তনয়,
যতই বল’ মা, রাজা আর নয়-
যা আছে তা লও’- দ্বাদশ গড়ের নাম করি’ পর-পর;
হাঁকি কয় রাণী- ‘চাহি নাক কিছু- শুধু সে সিংহগড়!’

‘আর কি অ হয়! কহিল শিবাজী- করে হানি’ নিজ শির,
সিংহগড় যে অভেদ্য আজি- নিজে উদীভান বীর
বসায়েছে থানা তাহার উপরে,
অটল পাহারা দিবসে দু’পরে,
অসংখ্য সেনা ফিরে তার পরে করে ধরি’ ধনুতীর।’
‘শাপে জ্বালাইব রাজ্য তোমার’- উত্তর জননীর!

‘তবে তাই হোক্, যা করিতে পারি, কৃপায় ভবানী মার’-
‘সেই ত তাঁহার মনের ইচ্ছা’- করে মাতা ঝঙ্কার!
‘অক্ষম বাহু আলস্যে পুষি’
দৈবে যে করে নিজ দোষে দূষী-
সে শুধু কেবল কাপুরুষ নয়- সে ঘোর কুলাঙ্গার,
পাপে জ্বলে’ যাবে ধৰ্ম্ম তাহার, রাজ্য ত কোন ছার!

কম্পিত হিয়া অভিসম্পাতে, ভবানীরে স্মরি’ ডরে,
নানা অনুনয়ে জননীরে শিব লয়ে গেলা রায়গড়ে;
বহু বিতর্ক চিন্তার পর
পত্র লিখিয়া পাঠাইলা চর,
উমরাটি হ’তে আনিতে ত্বরিতে তানাজী মালেশ্বরে-
বাল্যবন্ধু, রাষ্ট্ৰতিলক, গৌরব-ভাস্করে।
* * * *
উমরাটিপুরে সুবেদার-গৃহে সে দিন বাজিছে বাঁশী,
তানজীপুত্র রায়বার বিয়ে; প্রমত্ত পুরবাসী;
নানা আয়োজন, ভারি ধূমধাম;
নৃত্য ও গীত চলে অবিরাম;
দাঁড়াইল বর- বাজিল শঙ্খ, জ্বলিল আলোকরাশি-
এ হেন সময় শিবাজীর দূত সভায় দাঁড়াল আসি’

পাঠ করি’ লিপি বজ্রকণ্ঠে হাঁকিলা মালেশ্বর,
‘নামাও বংশী, থামাও নৃত্য, সাজ খুলে’ ফেল, বর!
কঠিন বিবাহ ঘনায়েছে আজ
তারই লাগি সবে পর’ নব সাজ,
সেই মিলনের শুভলগ্নের সময় অগ্রসর-
রে বরযাত্রী! আগত রাত্রি- হও সবে সত্বর!

লিপির বারতা শুনিলা সকলে সাগ্রহে পাতি’ কান,
হাজার কণ্ঠে ধ্বনিল অমনি শিবাজীর আহবান!
অন্তঃপুরে পুরনারী যত
শুনিলা সে বাণী স্বপ্নের মত,
বিস্ময়-হত হিয়া শত শত, তবু নহে ম্রিয়মাণ,
নব-উৎসাহে উঠিল জ্বলিয়া পদাহত সম্মান।

বারো সহস্র মাওয়ালি সৈন্য সাজিল বারতা পেয়ে,
তাই লয়ে সাথে প্রচণ্ড তেজে চলিলা তানাজী ধেয়ে
রায়গড়ে আসি রাজারে শুধায়-
‘কি আদেশ প্রভু, ঘটিল কি দায়?
উত্তর শুধু করিলা শিবাজী- জননীর পানে চেয়ে,
‘বন্ধু, তোমায় আমি ডাকি নাই- ভবানী মায়ের মেয়ে!

জননী অমনি তানাজীর মুখে ঘুরায়ে প্রদীপখানি,
অঙ্গুলি ভাঙি’ ললাট পরশি’ বালাই লইয়া টানি’
কহিল মধুর-গম্ভীর রবে
‘সিংগড় মোরে জিনে’ দিতে হবে,
বৎস আমার! আজ হ’তে তোরে দ্বিতীয় পুত্র মানি’-
তানাজীর মুখে অপূর্ব্ব সুখে বন্ধ হইল বাণী!

হাঁকি’ পুনরায় কহে জীজাবাই- ‘ছি! ছি! তোরা কাপুরুষ!
বীরের কৰ্ম্ম আপন ধৰ্ম্মে করে সে নিষ্কলুষ।
বেদ ব্রাহ্মণ নিষ্ঠা আচার
ধৰ্ম্ম যজ্ঞ বিবেক বিচার-
চরণে দলিত হেরি’ বারবার, তথাপি হয় না হুস্-
ধিক্কারে ভরা লাঞ্ছনা তোরা মৰ্ম্মে লুকায়ে থু’স!

দেখিস্ না চেয়ে চোখের উপরে কি হয় দিবারাত,
পাপ- সে হাসিয়া পুণ্যের শিরে করিতেছে পদাঘাত;
দরিদ্র দীন মূক অসহায়
ধনীর দুয়ারে আপনা বিকায়,
দম্ভী দর্পী হেলায় ঘৃণায় হেসে করে দৃকপাত-
শুধু গড় নয়, যা-কিছু তোদের গেল যে পরের হাত!

‘তবু বেঁচে থাকা- তবু প্রাণ রাখা পদে পদে সহি’ গ্লানি,
মারাঠার বুকে হেরি’ হাসিমুখে মোগলের রাজধানী!
সাজি’ তারই দাস, তাহারই নফর,
বিলাইয়া দিলি আপনার ঘর,
মসী-অঙ্কিত ললাটের পর তিলকপঙ্ক টানি’-
মহারাষ্ট্রের হেন কলঙ্কে সহিবে কি মা ভবানী’?

‘তাই থাক তোরা লজ্জা লুকায়ে অন্ধ বিবরমাঝে,
থাক্ বারো মাস মোগলের দাস ঘৃণ্য অধম কাজে;
আমি যাই- মোর ফুরায়েছে কাল,
মিছে বেঁচে থাকা হয়ে জঞ্জাল,
আপনার মান পরেরে বিকায়ে লাঞ্ছনাভরা লাজে-
সিংহগড়ের দুর্গে আজিকে মোগল-ডঙ্কা বাজে।’

রুদ্ধকণ্ঠে কহিল তানাজী ‘তাই হবে, তাই হবে,
ফিরায়ে আনিব সিংহগড়ের নিজিত গৌরবে;
শপথ করি অসি ছুঁয়ে আজ,
ঘুচাব রাষ্ট্র-কলঙ্ক-লাজ,
অথবা পরাণ সঁপি’ দিব আজ মরণ-মহোৎসবে-
ক্ষয়-ক্ষতি-লাজ ডুবাইব আজ বিজয়ের তাণ্ডবে!’

পরশিয়া পুনঃ মায়ের চরণ চলি’ গেল বীর ধীরে,
বারে সহস্র মাওয়ালি সৈন্য চলিলা সঙ্গে ঘিরে’।
সিংহগড়ের দুর্গচুড়ায়
সূৰ্য্য তখন স্বর্ণ কুড়ায়,
সন্ধ্যা তাহার রক্ত ছড়ায় ‘ডঙ্গী-শৈলশিরে;
দূরে সেনা রাখি’ চলিল তানাজী পাহাড়ের কোল ভিড়ে’।

তারপর যাহা- ইতিহাস তাহা শোনে নাই কোন’ সালে;
সত্য যাহার স্বপ্নের মত- দীপ্ত ইন্দ্রজালে!
খাৰ্ম্মাপলির পুণ্য-কাহিনী,
হল্দীঘাটের ধন্য বাহিনী-
অপূর্ব্ব কথা- তুলনা পাইনি তবু এর কোন কালে,
ভাগ্য যে লিপি লিখিল সে দিন মহারাষ্ট্রের ভালে!
* * * *
সপ্তাহ পরে এল রায়গড়ে সিংহগড়ের চর;
শুনিল সকলে সভয়ে গর্বে জয় সে ভয়ঙ্কর।
জীজাবায়ে শুধু কহিলা শিবাজী-
জননি, তোমার বাজি লও আজি,
সিংহগড়ের সিংহ গিয়াছে- পড়ে’ আছে শুধু গড়-
তাই লও মাতা, হারায়ে পুত্র- তানাজী মালেশ্বর!’