সংবর্ধনা-সভায়

দূরে থেকে, কাছে থেকে- যারা মোরে বাসিয়াছে ভালো
যারা এই চিত্তপুরে জ্বলিয়াছে প্রদীপের আলো
স্নেহের দক্ষিণ দানে, উপেক্ষিয়া অক্ষমতা তার,
কম্পিত শিখার স্পর্শে তাদের জানাই নমস্কার
আজিকার এই আরাত্রিকে; ধূমাঙ্কিত মসীরেখা
যদি পড়ে থাকে দীপে, সে তাহার ললাটেরই লেখা।
চঞ্চল চপল বায়ু, বুঝিয়া বা না-বুঝিয়া হোক-
যদি কোনো দিন সেই অতি শীর্ণ দীপের আলোক
নিবাইতে চেয়ে থাকে, প্রদীপ্তির অপরাধ-জ্ঞানে,
তারে প্রয়োজন মানি শিখামুখে সশ্রদ্ধ সম্মানে।
প্রসন্নতা যাচি তারই- জানাই বিনীত নমস্কার;
শুধু স্নেহে নহে জানি, বায়ুস্পর্শে জীবন যে তার।
এ দীপ মাটিরই দীপ, চিরদীপ্ত সূর্যচন্দ্র নয়;-
গৃহেরই পরিধি মাঝে সীমাবদ্ধ তার পরিচয়;
স্নিগ্ধ পরিজন-মুখে একান্তে ঘনায়ে তুলি ছায়া,
বান্ধবজনের চোখে এ যে গো মেলিতে চাহে মায়া!
বেপথু অন্তর নিয়ে নব-বধূ যদি সে আলোকে
স্বামীর সোহাগচিহ্ন পরি লয় স্নিগ্ধ কালো চোখে,
দরিদ্র চরখা কাটে, তরুণীরা পড়ে রামায়ণ,
একান্ত নিষ্ঠায় যদি গৃহী স্মরে নিত্য নারায়ণ
গৃহ-তুলসীর মূলে, পূজার কাঁসর ঘণ্টা বাজে,
শঙ্খের উদার স্বরে শিহরি সে মরি যায় লাজে ।
অঙ্গনের আশে-পাশে যদি-বা সঙ্কোচ শঙ্কা মানি
কভু সে মেলিয়া থাকে কুষ্ঠিত কাতর দৃষ্টিখানি,
আপনারে লয়ে সে যে আপনি মরিতে চাহে নিবে
কী জানি, কোথায় কেবা প্রগলভের অপরাধ দিবে!
-দিতে চেয়েছিল যাহা- পারিলাম, নাহি পারিলাম,
দীপের জীবন-রাত্রে, বুঝিয়াছি, অতীত ত্রিযাম।
শীত-পাণ্‌ডু প্রতিভায়, ক্লান্তিহরা আ-শীত বাতাসে
মনে হয়, যাত্রাশেষী রাত্রি তার ভোর হয়ে আসে
এবারের মতো! ধূসর পূর্বাশা-তীরে অতি ধীরে
এখনি উদিবে উষা জ্যোতির্ভাণ্ড বহি দীপ্ত শিরে;
তারই হাতে দিয়ে যেতে পারি যদি এই ক্লান্ত আলো,
ভাবিব, বাঁচিনু আমি- ভাবিব যে ভাগ্য মোর ভালো!