বিষ বিরিক্ষের বীজ

১. গন আদালত পর্বঃ

রাখালঃ ভায়েরা আমার। হানাদার শত্রুর কবল মুক্ত
আজ প্রিয়তম দেশ, মুক্ত আজ বাংলার আকাশ।
স্বাধীন আজ বাংলার মাটি, জল, বনানী, মানুষ-

সকলেঃ জয় বাংলা, জয় বাংলা, জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

রাখালঃ শেষ আজ গোলামির হাজার বছর। সেনাদল
পরাজিত, বন্দি আজ সুশিক্ষিত বিপুল বাহিনী।
খাদার ভেতরে হাতি যেরকম ভগ্ন, ম্রিয়মান,
যে রকম পেড়ির ভেতর আটকে যাওয়া মোষ-

অথচ এরাই কি না করেছে এ্যাদ্দিন। অস্ত্রহীন
হাজার হাজার নিরুপায় মানুষের হৃদ্পিণ্ড
ঝাঁজরা হয়েছে। বেয়োনেটে ছিন্নভিন্ন শিশু, নারী
হয়েছে ধর্ষিত- পিতার সামনে, স্বামীর সামনে।
উহ্ কি বিভৎস সেইসব দিন। সেইসব রাত!

ভয়ংকর বিভীষিকা কালো মৃত্যুর পাখনা মেলে
উড়েছে শহরে, গ্রামে, জীবনের নিবিড় নিসর্গে।

কীভাবে ভেসেছে লাশ দরিয়ার বাঁকে বাঁকে, খালে,
দেখেছো তোমরা সব। দেখেছো গোপন আশনাই
আমাদের কারো কারো- শত্রুর শিবিরে তারা গেছে
লোলুপ লোভের জিভ আহলাদে চাটতে চাটতে।
বিশ্বাসঘাতক তারা, কুলাংগার রাজাকার, শান্তি-

এই সে কুকুর, এই সেই আক্কেল মোড়ল, তার
সব কুকর্মের কথা তোমরাই ভালো জানো৷ জানো
কিভাবে সে পাকসেনা সঙ্গে নিয়ে এসেছিলো গ্রামে,
লাশের উপরে লাশ পড়ে ছিল কুমার পাড়ায়।

আগুনের লকলকে জিভ ছাই কোরে দিয়েছিলো
সাতপুরুষের বসতির স্মৃতি। সোমত্ত মেয়েরা
কি রকম তছনছ হয়ে গিয়েছিলো সেনাদের হাতে;
তোমরা তা জানো সব। দাউ দাউ জ্বলছে আগুন
রক্তে শিরায় শিরায় মোচড়ায় আজদাহা ক্রোধ-

গৌরবঃ প্রতিশোধ, প্রতিশোধ নিতে হবে- প্রতিশোধ নেবো।

সকলেঃ নিতে হবে একবাক্যে আজ জনমের প্রতিশোধ।

রাখালঃ বলো, বলো ভাইসব বিচারে কী শাস্তি হবে এর?

গুরু ছোটোঃ সাত গ্রামে আক্কেল মিয়াই ছিলো আমাদের মাথা।
তার জমি বর্গাভাগে করে না এমন চাষা আছে
কয়জন এই গায়ে? ভিক্ষে হোক বা বন্ধকি হোক,
হোক চড়া সুদ, বিপদে তোর কাছে কে পায়নি
টাকা কড়ি? তারেই তো বটগাছ মেনেছি আমরা।
মানুষ দাঁড়ায় এসে চিরকাল বড়ো গাছ, বড়ো
ছায়ার নিচেয়, আস্থাভরে নাও বাঁধে শক্ত ডালে।
যার ডাকে এক ভাঁড়ে পানি খায় কুকুর বেড়াল,
একসাথে বসে এলাকার গেরস্ত, সাধু বা মুচি।
যার কাছে ছায়া চেয়ে বাড়ায়েছিলাম নত হাত,
তারই দুহাত কিনা লুটে নিলো আদোরের সব।
পায়ের তলায় পিষে যেন মাটিতে মিশায়ে দিলো-

মিয়া সাব, কি দোষে আমার পোলারে দিলেন তুলে
সেনাদের হাতে? উঠায়ে নিলেন ঘরের যুবতী
বউ, মেয়ে? আমারে ফিরায়ে দেন আমার সংসার।

গৌরবঃ আবেগের কথা থাক, অনেক হয়েছে দায়দেনা।
কয়েক পুরুষ ধ’রে আমাদেরে জোঁকের মতোন
শুষে শুষে শাঁস রক্ত নিয়ে গেছে সব। চড়া সুদে
বিপদে সাহায্য দিছে, বিনিময়ে নিয়েছে জমিন।
আমরা হয়েছি জমিহারা, ঠিকা কামলা, মজুর-
এই যে আক্কেল মিয়া, কটু জমায়ে রেখেছো?

পণ্ডিতঃ শাস্ত্রের বচন কভু মিথ্যা নাহি হয়।
সম্মুখে প্রমান এই জানিবে নিশ্চয়।।
পাপকর্ম জেনো সবে অগ্নি নিয়ে খেলা।
এখনি সতর্ক হও, আছে, আছে বেলা।

রাখালঃ আক্কেল মিয়ার দেখি নিচু হয়ে আসছে মাথাটা।
কোথায় সে তাজ, ঝাণ্ডা? কোথায় সে দ্বিনের খোয়াব?
কোথায় পিতারা আজ? বেজন্মা কুকুর, কই তারা?

ভাইসব, জানাও কার কি অভিযোগ আছে, আছে
কার কি নালিশ। গনআদালত রায় দেবে আজ,
রাজার বিচার হবে জনতার মুক্ত আদালতে।

পাচু বিবিঃ আমার পোলারে কে না চেনে এই গাঁয়ে? বোবা, কালা,
সেগুন গাছের মতো টান টান জোয়ান মরদ।
চোদ্দ পুরুষের ব’য়ে আনা অভাবের গেরস্থালি,
গতর খাটায়ে তার চাকা সচল রাখতে হয়।
ঠ্যাকা বেঠ্যাকায় কবে কার বাড়ি খাটনির কাজ
করে নাই পোলাড়া আমার? আষাঢ়ের শেষ দিন
মিয়াসাব রাজাকার পাঠায়ে নিলেন তারে বেঁধে।

বোবা কালা- কিছুই বোঝে না, খালি জন্তুর নাহান
চারপাশে চায়। ইশারায় আমারে কি যেন কয়,
আমি তার মানে বুঝি নাই বড়ড়া আপসোস মনে।
বাজান, বাজান, তুই চেয়েছিলি বোঝাতে কি কথা?

ছয় মাসের পোয়াতি বউ ঘরে, আলুথালু দেশ-
বাজান, বাজান, চেয়েছিলি কোন কথা বোলে যেতে।

আট দিন বাদে মসজিদের ইমাম সাব এলো,
কানের নিকটে মুখ নিয়ে ফিস ফিস কয়ঃ শোনো,
তোমার পোলার লাশ ভাসে হিতাল বনের ধারে।
কাকপক্ষি উঠায়ে নিয়েছে চোখ, শরীর খেয়েছে
লবনপানির মাছে, শেষ দ্যাখা দেখে এসো যাও।

এরচে’ খোদার আসমান পড়তো মাথায়!
আমি এ-কথা শোনার আগে যদি হতাম বধির,
বাজতে ইস্রাফিলের শিঙ্গা তামাম দুনিয়া জুড়ে!
সে-দৃশ্য দ্যাখার আগে কেন আমি অন্ধ হলাম না?
এই চোখে অসহায় চেয়ে চেয়ে দেখলাম তারে।
কপালে হলো না গোর পোলাটার এমনি নসিব,
শোকের ঝাপটা লেগে প্যাট প’ড়ে গেল বউটার।
তারপর কোথায় হারায়ে গেলো জীবনের স্রোতে-

আমি চাই মিয়ার লাশও ওম্নি ভাসুক নদীতে,
শেয়াল শকুনে খাক, আর তার বউ পোলাপান
সে দৃশ্য দেখুক। সাত গেরামের মানুষে বলুকঃ
জানো, কপালে কবর জোটে নাই আক্কেল মিয়ার-

দীপংকরঃ ওই ইবলিশ, আমার বাপের জ্যান্ত শরীর থেকে
চামড়া ওঠায়ে দিয়েছিলো ডলে লবন, মরিচ-গুঁড়েল।
বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে তুলে ফেলেছিলো চোখ।
তারপর তার হাত পা বেঁধে ফেলে দিয়েছিলো গাঙে।
আমার চোখের সামনেই তারে মেরেছিলো বানচোত-
ওর গা’র থেকে চামড়া খসাও লবন ছিটাবো আমি।

রূপবানঃ কাসার থালের মতো টকটকে রাঙা চাঁদ,
মাগো, কোন শত্রু প্যাটের ভিতরে নড়ে?

নিজের রক্তের মধ্যে কোন পাপ বড়ো হয়!
লোহুতে শরীর ভাসে- কুমিরের মতো দাঁত,
সারি সারি, কামড়ায়, গরম নিশ্বাস লাগে
চোখে মুখে- টকটকে রাঙা চাঁদ ওঠে, মাগো
কোন শত্ৰু, প্যান্টের ভিতরে কোন শত্রু নড়ে?

রাখালঃ কার কি হয় এ মেয়ে? মনে তো পড়ে না,
এই গাঁয়ে আগে এরে দেখেছি কখনো!
চেনো কেউ? জানো এর ঠিকানা সাকিন?
আহা! গ্রহন লেগেছে যেন পূর্ন চাঁদে-

মোংলাইঃ কর্মকার বাড়ির এ মেয়ে, বড়োই সুশীলা, নম্র,
ও-ই একা ও-বাড়ির একমাত্র জীবিত এখন।
পুরুষ কজন বুলেটে ঝাঁজেরা হয়ে পড়েছিলো
বাড়ির উঠোনে আঁটচালা ঘরে আগুন লাগিয়ে
ছোট ছেলেমেয়ে দুটো আর বুড়িটারে ঝলসায়ে
মেরেছিলো। একে নিয়ে রেখেছিলো সেনাদের ক্যাম্পে।
গতকাল প্রথম দেখেছি তাকে বেসামাল বেশে-
সরেস পেয়ারাটারে ঠুকরে খেয়েছে যেন কাক।

রূপবানঃ বড়ো চেনা লাগে মুখখানা- গোল রাঙা চাঁদ-
ছুঁয়ো না, ছুঁয়ো না- হোক শত্রু, তবু সে আমার রক্ত,
আমার নিশ্বাস। আমার গহিন স্বপ্নের শিকড়ে
ছিলো তার আদিবাস- না, না, তারে ছুঁয়ো না, ছুঁয়ো না-

গৌরবঃ নাটক থামাও। এতো কি শোনার আছে?
আমরা সবাই জানি, খুনি সে, ঘাতক।
তার হাত মৃত্যু হয়ে ঢুকেছিলো ঘরে,
অগনিত যুবতীর স্বপ্ন ভেঙেছিলো,
আর ছাই হয়েছিলো মাথা গুঁজবার
একমাত্র ঠাঁই। জোদ্দার সে, শ্রেনীশত্রু।
তার রক্তে ধোয়া হবে পবিত্র বিশ্বাস
আমাদের সমতামন্ত্রের ঋজু বেদী।
চলো, এ-কটিকে হত্যা কোরে তারপর
ওই উঁচু বটের শাখায় বেঁধে রাখি।
সবাই দেখুক এসে বিশ্বাসঘাতক
দালালের পরিনতি, তার পুরস্কার।

সকলেঃ তাই হোক, তাই হোক- তবে তাই হোক-

পণ্ডিতঃ হত্যা ডেকে আনে আর এক হত্যাকাণ্ড।
এক রক্ত অন্য এক রক্তপাত আনে।।
মানুষেরে শাস্তি দিতে রয়েছে ঈশ্বর।
আইন কানুন আছে, আছে আদালত।

গৌরবঃ না- না- না এসব নিয়ম গুলো যুদ্ধ ময়দানে।
একদিন আগে, ওরা যদি যুদ্ধে হারাতে পারতো
এই আমাদের- চোখ তুলে, ভীতুলে, চামড়া ওঠাত গা’র।
পশরের ঘোলা জলে ভেসে যেতো এই দেহগুলো,
কাক আর শকুনের খোরাক হতাম অনায়াসে।
তবে আমরা কোরবো ক্ষমা ঘৃনিত শত্রুকে?
না-না ক্ষমা নেই, ক্ষমা কোনো মানবিক গুন নয়,
বরং তা অন্যায়, অক্ষমের অলস সান্ত্বনা মাত্র।
ক্ষমা হলো সেই ক্ষত, সভ্যতা পচেছে যার দোষে
বড়ো তাড়াতাড়ি। পণ্ডিত মশাই, পাঠশালা ঘরে
আপনিই শিখায়েছিলেন দু’চার অক্ষর, আর
যা কিছু শিখেছি এই পৃথিবীর পাঠশালা-পথে।
আপনি নিষেধ কোরে কষ্ট কেন পাবেন হৃদয়ে?

যুদ্ধ ময়দানে একটাই চিরায়ত শুদ্ধ বিধি
সমূলে বিনাশ করা শত্রু, রক্তের বদলে রক্ত।
এর কোনো বিকল্প কল্পনা নেই, নেই অন্য পথ-
ভাইসব, একপাশ ফাঁকা কোরে দাও, এইখানে
শ্ৰেনীশত্রু, দালাল খতম করা হবে- তৈরি হও।

রাজাকারঃ আমরা জানি না কিছু, আমরা তো নির্দেশ মেনেছি

১ম রাজাকারঃ যে হুকুম মিয়াসাব দিয়েছেন শুধু সেই মতো
বলেছি, করেছি আর করেছি, বলেছি, তিনি সব।

২য় রাজাকারঃ না শুনে মিয়ার কথা বাঁচা দায়, এই এলাকায়।

৩য় রাজাকারঃ কে আছে বাপের ব্যাটা, কার ক’টা মাথা আছে জমা-

রাখালঃ চোপ শয়তান। আমরা কি এসেছি আকাশ থেকে?
এই তো তোদের মিয়া, হাত বান্ধা, জঘন্য আসামী,
আছে এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে কখন বেরিয়ে যাবে
মরন বুলেট তার অপেক্ষায় টান টান হয়ে।
আক্কেল মিয়ার কি বলার আছে আর কোন কথা?

রূপবানঃ মাগো, আকাশে চিৎকার দিয়ে ওঠে নীল ফেরেস্তারা-

আক্কেলঃ বাবাগো সকল, আমারে কি মেরে ফেলতে চাও?
গায়েবের মালিক আল্লাহ মালিক সে দুনিয়ার,
মানুষের জীবন মরন তার হাতে-

গৌরবঃ থামো, পড়ো না ধর্মের দোহাই, ওসব জানা আছে।
ধর্ম হলো নিগুঢ় আফিম, মানুষের বোধ বুদ্ধি
ভোঁতা কোরে রাখে। মানুষ বিশ্বাসে তাই বুঁদ হয়ে
ভুলে যায় পৃথিবীর নিয়মকানুন, রীতি-নীতি।

আক্কেলঃ তোমরা দ্যাখোনি সেই বিধর্মের জুলুম-জামানা,
হিন্দুদের অত্যাচারে পেরেশানে ছিলা মোসলেম।
আর তাই আল্লাহর তরফ থেকে পাকিস্তান নামে
এক দেশ দুনিয়ায় হয়েছিলো নাজেল সেদিন।
সেই দেশ কেড়ে নেবে, ভেঙে দেবে, বহুদিন থেকে
সুপ্ত ইচ্ছা ভারতের- মুজিবর বুঝলো না, ফাঁদে
বাড়ায়ে দিলো পা। মুসলমানের দেশ হেফাজতে
দুশমনের বিরুদ্ধে আমরা লড়েছি তাই। শোনো-

রাখালঃ দুশমন? কারা দুশমন? তোমার গাঁয়ের ছেলে,
প্রতিবেশী, পুরুষ পুরুষ ধরে সুখেদুখে যারা
স্বজনের মতো, একই জবান, তারা দুশমন?
আর ভিনদেশি, ভিন্নভাষী বর্বর দস্যুর দল
তারাই আপন? ধর্ম সব? এই মাটি, এই দেশ
এরা কিছু নয়? দালালের বাচ্চা, শালা রাজাকার-

মোংলাইঃ এই শয়তানের মাথার মধ্যে এখনো রয়েছে
পাকিস্তানি ভূত- আছর কাটেনি, আছর কাটেনি।

রূপবানঃ দ্যাখো, দ্যাখো, নীল ফেরেস্তারা আসে, আহা কি সুবাস!
চারদিক ম ম করে- রাঙা টকটকে চাঁদ, দ্যাখো
সুতো ছেড়া তসবির দানার মতোন আকাশের
লক্ষ লক্ষ তারা- তারা ডাকে, তারা ডাকে, উহ্ মাগো-

আক্কেলঃ আল্লাহতালার নামে জেহাদ করেছি। তার ধর্ম,
তার শরিয়ত বাঁচায়ে রাখতে কোতল করেছি
বিধর্মী, বিরুদ্ধাচারী। বেশরম জেনানা যেসব
তারাই পেয়েছে শাস্তি, আল্লার ইচ্ছা, সব-

মোংলাইঃ আল্লাহতালার ধর্ম সে কি তোর বাপের নাকি রে?
শয়তান, আমাদের ধর্ম নাই? নাই ভালোবাসা?
আন্ধার যুদ্ধের মাঠে আল্লাহর নামে আমরা কি
ঝাঁপায়ে পড়িনি রাজাকার, খানসেনাদের ‘পরে?

তোর আল্লা কোথায় এখন? কোথায় তোর সে ধর্ম?
আল্লা আমাদের পক্ষে তাই এই বিপুল বিজয়,
এই মাটি থেকে আজ তাই জালেম, কাফের, ভণ্ড
বিতাড়িত, বিতাড়িত মোনাফেকি, অধর্ম, অন্যায়।

রাখালঃ চুপ করো- অনর্থক তর্ক কোরে লাভ নেই কোনো।
তোমরা দুজনে যাও, সামনে এগোও, ওই দ্যাখো
তিনজন লোক আসছে এদিকে, ঘাড়ে রাইফেল।
কারা ওরা! থানা সদরের কোনো নির্দেশ নয়তো!

গৌরবঃ চিনতে পেরেছি, ঠিক, ওরা থানা কমাণ্ডের লোক।
শালনা অপারেশনে এক সাথে লড়েছি আমরা,
তোমরা সুন্দরবনে মূলঘাঁটি পেতেছো তখন।

তিনরাত তিন দিন নাওয়া-খাওয়া নেই, নেই
সামান্য বিশ্রাম- মাটি ওলোট-পালোট করা আহা
সে এক লড়াই বটে, আসল লড়াই যার নাম।

রাখালঃ বাদাবনে বোসে সেই খবর শুনেছিলাম। কীযে
কষ্টে আমরা তখন- চারদিক ঘেরাও দিয়েছে
নৌবাহিনী, খাদ্য নেই, জঙ্গলের ফলমূল খাই।
বুনো মশা আর বাড়ে পোকের কামড়ে জান শেষ,
সাপ কে’প, কুমির, বাঘের ভয় তখন ছিলো না।
বিশ্বাস হয় না আজ ওভাবে মানুষ বেঁচে থাকে-

নবাগতগনঃ জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

সকলেঃ জয় বাংলা, জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

(নবাগতদের একজন একখানি চিঠি দেয়
রাখালকে। রাখাল নিরবে চিঠি পড়ে।
উৎকণ্ঠিত নিরবতা। দূরে পাখি ডাকে।
গোরুদের হাম্বা রব শোনা যায়।)

রাখালঃ ভাইসব, নির্দেশ এসেছে আসামী পাঠাতে হবে
থানা সদরের হাজতখানায়। আর চলবে না,
আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া চলবে না আর।
সকল বিচার হবে- হতে হবে আদালতে-

গৌরবঃ আদালত! আদালত কেন? না- না, যুদ্ধের বিচার
হতে হবে যুদ্ধময়দানে। আসামীর সাক্ষী দিতে
কে যাবে মহকুমায়, কে জানাবে তার অপরাধ?
বিচারক, উকিল, মুহুরি কিভাবে জানবে তারা
প্রকৃতই অন্যায় করেছে কারা, কারা অপরাধী?

এ-সিদ্ধান্ত ঠিক নয়, এ-নির্দেশের ভেতরে আমি
অন্য এক কণ্ঠস্বর শুনি, অন্য এক ষড়যন্ত্র
টের পাই। ভাইসব, মুরুব্বিরা আছো, ভেবে দ্যাখো,
আমরা গাঁয়ের মানুষ, কজনে সাক্ষী দিতে যাবা
মহকুমা সদর শহর? মাস দুই গেলে পর
দেখবো আক্কেল মিয়া ফিরবে খালাশ হয়ে বাড়ি।

১ম নবাগতঃ সবার মঙ্গল চেয়ে এ- নির্দেশ হয়েছে ঘোষনা।
এখন স্বাধীন দেশ, সরকার আসীন হয়েছে,
প্রতিষ্ঠা করতে হবে আইন, কানুন, প্রশাসন,
কাজেই নিজের হাতে তুলে নেয়া চলবে না কিছু।
আমাদের কাজ শেষ, স্বাধীন হয়েছে মাতৃভূমি-

গৌরবঃ কাজ শেষ! সবেমাত্র স্বাধীনতা পেয়েছে স্বদেশ,
এখনো রয়েছে বাকি প্রকৃত যুদ্ধের সবটুকু,
আসল যুদ্ধের শেষ সত্যি হয়নি এখনো।
দালাল, বদর, রাজাকার, লেবাস পাল্টেছে তারা,
অনেকেই মিশে গেছে বিজয়ের বিপুল মিছিলে।

রাখালঃ তাদের খুঁজতে হবে, উপড়াতে হবে বিষ-দাঁত,
ঘৃন্য বিষৰক্ষর একটি কুটিল চারাও যেন
অগোচরে না থাকে বাংলার ঘিঞ্জি আনাচে কানাচে,
না পারে থাকতে যেন একটিও পা-চাটা কুকুর।

এই ভাঙা ভিতে আবার তুলবো ঘর মায়াময়,
আবার সাজাবো নীড় শস্যময় সমৃদ্ধ স্বদেশ।

গৌরবঃ কিভাবে তা সম্ভব বলো, কিভাবে? আমি তো দেখছি
এখনি স্বপ্নের সাথে বাস্তবের বেঁধেছে বিরোধ,
এখনি নৌকোর সাথে বনিবনা হয় না মাঝির।
মাঠ চায় দিগন্তের খোলা নীল বিশাল আকাশ,
অথচ প্রাসাদ টানে অন্ধকারে কেবলি গুহায়।

১ম নবাগতঃ নেতারা কেন্দ্রে আছে, আমাদের চেয়ে তারা বেশি
বুঝদার। সবদিক ভাবছেন তারা, দেখছেন
সব কিছু- নোতুন দেশটি তার হাজারো সমস্যা-

রূপবানঃ কার পাপ নড়েচড়ে প্যাটের ভিতরে?
নীল ফেরেস্তারা বোলে দাও, বোলে দাও,
কোন শত্রু বড়ো হয় আমার শোনিতে?

২য় নবাগতঃ কে এই মেয়েটি?

রাখালঃ বীরাঙ্গনা, আমাদেরই গ্রামের মেয়ে। কেউ নেই-

গৌরবঃ সমবেত বন্ধুগন, সংগ্রামী সাথিরা শোনো, শোনো,
যুদ্ধের আইন থাকে ময়দানে যোদ্ধাদের হাতে।
কার হাতে তুলে দেবো সে-পবিত্র অগ্নি-আমানত?
ক্ষমতা কি তুলে দেবো পাকিস্তানি পুলিশের হাতে?
থানায় ফাঁড়িতে যারা নয় মাস মদদ দিয়েছে?
যোদ্ধাদের বিজয়ী ক্ষমতা তুলে দেবো বৃটিশের
লাল ইমারতে? আদালত যার নাম! কৃমি কীট
শঠ তস্করেরা যেইখানে গেড়েছে গভীর খুঁটি-
তা হলে প্রয়োজন ছিলো এই রক্তপাত? এই
ইতিহাস ওলোট-পালোট করা অমল উচ্ছাস?

১ম নবাগতঃ নেতৃত্ব অমান্য করা যোগ্য কোনো যোদ্ধা বা কর্মীর
কখনো কৃতিত্ব নয়। নির্দেশ অমান্য হলে তার
ফলাফল জানা আছে আশা করি, বিস্তারিত
বলা নিপ্রয়োজন। আসামীরা সদরে পৌঁছাক।
জরুরী নির্দেশ আছে আরো- অস্ত্র জমা দিতে হবে।

সকলেঃ অস্ত্র জমা দিতে হবে!!!

২. বীরাঙ্গনা পর্বঃ

সোনাভানঃ সব মখলুকাতের সেরা তুমি কোরেছে মানুষ,
বুকের মাঝারে তার দিয়েছে মমতা। পাখিরা কেমন
ভুলে যায়, উড়ে যায় আকাশের ওপার আকাশে।
তরুদের শোক নেই ঝরা পাতাদের জন্যে কেউ
করে না বিলাপ। আমার মনের মধ্যে কেন তবে
উথালপাথাল করে? ডুকরায়? কী যে এক কষ্ট
গক্ষুর সাপের মতো গলাডা পেচায়ে রাখে। আমি
চোখের সামনে দেখি নীল জল, যেন তারা মেঘ-
মেঘের নাহান ভাঙেচোরে, কতো কি যে হয়। কেন
একখানা মুখ, অবুঝ দুইডা চোখ মনে পড়ে?
এতো কান্দন কেন যে আসে! আমার বাজান সোনা,
সোজন- সোজন-

পাচু বিবিঃ আহারে! হাজার বিলাপে কি ফিরে তারে পাবি বোন?
যে যাবার সে তো গেছে। কতো, কতো যে মায়ের বুক
খালি হয়ে গেলো আজ- হায়রে মরন স্বাধীনতা!
সে বছর সেই যে মৌসোনা বিলে ধান কাটাকাটি,
পোলাড়ার বাপ মরলো যেবার-

রূপবানঃ মরনের কথা আর বালো না লো দোহাই তোমার।
শোনো, শোনো, ওই শোনো নীল ফেরেস্তারা ডাক দেয়-
দিন নাই, রাত নাই- ডাকে- ডাকে। কয় কি হেয়ায়
জানো? দিয়ে দে, দিয়ে দে। আমি বলিঃ কি এমন
কাঞ্চন মানিক, যা চায় আল্লার ফেরেশতা এসে?

তা হলে কি আমার আন্ধারে যার সদা নড়াচড়া,
জীবন কাঁপানো বসবাস আমারই মর্মস্থলে,
আমার রক্তের মধ্যে, আমারই দেহের ছায়ায়
বেড়ে ওঠে আমারই শত্রু যে আমার মগ্ন চিতা-
তারে চায়? তারে চায় আকাশের নীল ফেরেস্তারা?

পাচু বিবিঃ মাথাডারে খেয়েছিস, গেছে সব উল্টোপাল্টা হয়ে।
ও পাপ ফেলে দে বোন, ওই বোঝা পারবি না তুই
বয়ে নিতে উঁচু নিচু জীবনের এই ভাঙা পথে।
কি বা প্রয়োজন! যখন গাছটা আছে ফল পাবি,
ফের তোর শাখায় শাখায় ধরবে মুকুল, কুড়ি।
ফেলে দে ও-বোঝা, ওই ভার পারবি না বয়ে নিতে-

রূপবানঃ হোক পাপ, হোক শত্রু, তবু সে-তো আমার শরীর,
আমার আত্মার মধ্যে স্তুপ হয়ে যে ছিলো এদ্দিন,
যে ছিলো আমার স্বপে-জাগরনে ছায়ার মতোন,
ছিলো রেনু- আজ সে-ই ফুল হয়ে ফুটেছে ভেতরে।
কোথা থেকে এসেছে পরাগ কবে মনে রাখে কোন
ফলবতী তরু? আমার কি দোষ তবে, তোরা কও?
এ-আমার স্বাধীনতা, এ-আমার যুদ্ধের সন্তান।
পোলারে শেখাবো আমি স্বাধীনতাযুদ্ধ তোর বাপ-
ফেরেস্তারা ফিরে যাও, ডেকো না আমারে আর কেউ,
দেবো না, দেবো না আমি, যাও- যাও- যাও-

সোনাভানঃ লাউডগাটার মতো লক লক উঠছিলো বেড়ে,
ফুটছিলো কেবল নোতুন পাতা ডগমগ রঙ।
আহারে মরন যুদ্ধ! দিয়ে গেলি শোকের পাথার,
দিয়ে গেলি বিহানবেলায় এনে অমানিশা রাত।

ফুরায়ে গিয়েছে চোখের জল, তবু কান্দন থামে না-
পাখি ভুলে যায়, গাছেরা করে না শোক কোনোদিন,
হায়রে মানুষ! কেবল তুমিই ভুলতে পারো না,
বুকের ভেতরে স্মৃতি জ্বেলে কাতরাও, কাঁদো। মাগো …

পাচু বিবিঃ শোনো গো বোনেরা, কান্দনে কি ফল পাবা কিছু, কও?
একজনে হারায়েছো তরতাজা সেয়ানা ছোয়াল,
আর জনে প্যাটে নিছো পাপ। খোদার কালাম বিনা
মানুষের জন্ম হয় না জায়েজ, আছে রীতিনীতি।

আমিও তো হারায়েছি আমার জোয়ান ছেলে- কই?
এক ফোঁটা পানি পড়ে নাই চক্ষু থেকে, কাঁদি নাই।
কানলে কি হয় বোন? এ-জীবনে কান্দনের সুখ
পাই নাই কোনো দিন, পাষানের নাহান এ-বুক।
আল্লাহতালার খেলা দেখি, দেখি বান্দার জীবন
হাতের মুঠোয় রেখে কতো খেলা খেলতে সে পারে!

রূপবানঃ মজ্জার ভেতরে জ্বলে ওঠে অগ্নিগিরি, পুড়ে যায়-
পুড়ে যায় মাথার ভেতরে গেরস্থালি। না-হওয়া
সংসার আমার- দরোজা খুলে দি, দেখি এক বাঘ,
রাঙা চোখ, চৌকাঠ সমান উঁচু, সামনে এগোয়-
পায়ে যেন শিকড় গজায়, নড়ে না, চড়ে না, ঠায়
গেঁথে থাকে- গরম নিশ্বাস পড়ে চোখে মুখে- মাগো

তছনছ হয়ে যায় সাজানো বাগান, কখন যে
সূর্য ওঠে, ডুবে যায়, জানতে পারি না কিছু তার।
কেবল বুঝতে পারি দেহটারে উল্টায়-পাল্টায়,
ছেঁড়ে নোখে দাঁতে আর হাতুড়ি বাটালি দিয়ে যেন
হাড়-মাংশ খোঁড়ে এক কাঠমিস্ত্রি, শরীরের মধ্যে
অবিরাম আমি যেন শব্দ পাই করাতকলের।

তারপর খুলে যায় আকাশের গোপন দরোজা,
বাহারি রঙের ফুল ফুটে আছে অজস্র, অঢেল।
সেই রঙ কোনোদিন দেখি নাই, কীযে শোভা তার!
কী যে ঘ্রান! মনে হয় এখনো সে গন্ধ পাই আমি-

পাচু বিবিঃ আলাপ-বিলাপ রাখো, ভাবো, যেদিন কাটাচ্ছো
তার আসল সরল কথা। চেয়েচিন্তে কাটলো দুদিন,
খাবার কিছুই নেই ঘরে। সারাদিন খালি পেট।
কান্নায় বিলাপে জুড়োবে না পাকস্থলি, তার জন্যে
অন্য কিছু দিতে হবে সরল সহজ ডাল ভাত।

কেন যে দিছিল খোদা মানুষেরে এমন আজাব!
এমন সুন্দর চিজ, দুনিয়ার সেরা, অথচ সে
দিনরাত ব’য়ে নিয়ে চলে এক দুরারোগ্য ব্যাধি;
ক্ষুধা- ক্ষুধা- খাদ্য ছাড়া যার অন্য নিরাময় নেই।

সঙ্গে চলো, ক্যাম্পে যেয়ে দেখি কিছু জোটে কিনা পেটে।
আক্কেল মিয়ার বাড়ি ছিলো ধানভর্তি বিরাট কোলাচ,
সবারই হক আছে ওই ধানে, জমি তো খোদার,
মানুষে ফালতু কয় এই সব আমার, আমার।
আহা, কতো কি যে কয়, ভাবে, এই রঙিলা মানুষ!
পাটের বিবির লাহান এই যে শোকের উৎসব,
গরীবের মানায় না- চলো, চলো, বেলা যায়, চলো-

৩. শুড়িখানা পর্বঃ

রাঙ্গামিয়াঃ বঙ্গবন্ধুর ডাকে লাখে লাখে কাতারে কাতারে
ভেতো বাঙ্গালিরা নেমে আসলো পথের পরে,
হাতে অস্ত্রপাতি, শত্রুঘাতী যুদ্ধ হল শুরু,
ছোকরা পোলাপানে এবার মানলো না আর গুরু।
লড়াই চলতে থাকে, দখল রাখে হানাদারের দল,
অস্ত্রপাতি অনেক বেশি উন্নত কৌশল।
মারে বাঙ্গালিরে, গেরাম ঘিরে, হিশেব কিতেব নাই
গেরামের পর গেরাম পোড়ে, গেরস্থালি ছাই।
নদীর বাঁকে বাঁকে, ভাসতে থাকে হাজার হাজার লাশ,
বুকের মধ্যে থাকতে চায় না কেনো মতেই শ্বাস।
সে তো অচিন পাখি, খাঁচায় রাখি কষ্টেশিষ্টে বেঁধে,
আজরাইলের মরন ফলা হেথায় সেথায় বেঁধে।
শোকের সময় তো নেই-

মোংলাইঃ রাখো ওইসব পুরোনো প্যাচাল, থামো তো,
আরো দুই ঠিলে এই দিকে আনো, নামো তো।
বোসে আছো যেন সেরাজদুল্লা,
দাও গোটা কয় গুল ও গুল্লা,
কাঁচা ছোলা দিতে এবারো ভুল্লা-
হবে না তোমার কিছুই হবে না, বুঝেছো?
ঘরের মাঝে তো বেতাল আগুন পুষেছো!
আছো বেশ খুব ছেনালির ঘোরে,
ও-ই সব দেবে ছারখার কোরে।
একদিন উঠে টের পাবে ভোরে
দেহের খাঁচাটি প’ড়ে আছে শুধু বিছেনে,
আর সব দিয়ে লুচি বানিয়েছে সে ছেনে।

বকুলিঃ আহারে আমার উপদেশদাতা রসের নাগর,
কানায় কানায় টলমল যেন মধুর ভাণ্ড।
রসিক আমার জোয়ারের নায়ে রঙিন বাদাম
তুলে দিয়ে বুঝি বসতে চাইছো হালখানা ধ’রে?

মোংলাইঃ সে আশা কি আর মানায় এখন, বলো তো মানায়?
ওই দেখছো না, হালের মাসিটি কেমন তোমার
জোয়ারের নায়ে পাল তুলে দিয়ে নেশায় ঝিমায়।
কি যে সুধা ওরে গিলিয়েছে আহা! এক ফোঁটা যদি
পেতাম তবে এ জীবন ধন্য মানতাম আমি।
মন্দ কপাল! শিকের হাঁড়িটি ছিড়ে পড়লেও
সামনে পড়ে না, পড়ে তা মাথায় ভেঙ্গে খান খান।

বকুলিঃ এতো মধুমাখা জিভখানা নিয়ে বনে-জঙ্গলে
যুদ্ধের মাঠে বারুদ পোড়াতে কিভাবে রসিক?
মরন বুলেট কিভাবে চালাতে খানেদের বুকে?
শুনেছি তোমার হাতেই মরেছে উনিশটা খান
মুরগির মতো ঠ্যাং উল্টিয়ে ছটফট কোরে-

মোংলাইঃ হাহ্ হা! সেসব যুদ্ধের কথা থাকুক এখন।
আমার পেয়ালা ভরে দাও তুমি তোমার শরাবে,
হতে চাই আজ আমিও মাতাল-নৌকোর মাঝি।

বকুলিঃ আহা, আহা, শোনো, শোনো হয়ো না উতল।
বাহিরে আগুন আমি, অন্তরে শীতল।।
আমি যে বিষের নেশা জানে সর্বজন।
সাপ কোপ জন্তু ভরা আমি এক বন।।
আমার ভেতরে তুমি হারাবেই পথ।
যেমন হারায়ে ছিলো খানেদের রথ।।

রাখালঃ লোকমুখে শুনেছি সে কথা, ভুলায়ে ভালায়ে তুমি
নৌকায় উঠায়েছিলে একদল শত্রু খানসেনা।
রাজাকার, তা-ও ছিলো দুই চারজন। তারপর-
তোমার মুখেই শুনি সে কাহিনী, শুরু করো তবে।

মোংলাইঃ তার আগে কথা আছে, এই যে দেখছো সুধাভাণ্ড,
আর ওই দ্যাখো জ্বলন্ত আগুন দাঁড়ানো সামনে।
বোসো সকলেই, পান হোক, বিজয়ের শুভরাত
হোক উদযাপন। বকুলি, যতো ভাণ্ড আছে সব
একে একে আনো, লড়ায়ের ক্লান্তি আজ ধুয়ে ফেলি।

গৌরবঃ কিসের বিজয়? কিসের উদযাপন আমাদের?
বঙ্গবন্ধু, যার ডাকে অস্ত্র হাতে নিয়েছি তখন,
নিয়েছি মুঠোয় তুলে দুঃসাহস প্রাত্যহিক প্রান-
শত্রু শিবিরে এখনো বন্দি সেই প্রানপ্রিয় নেতা।

রাখালঃ উতলা হয়ো না, পৃথিবীতে আজ কোনো শক্তি নেই
আটকে রাখতে পারে আমাদের প্রানের নেতাকে।
অপেক্ষায় থরো থরো বাংলার মাটি ও আসমান,
বাংলার জলের ধারা, ঘাস, ফুল প্রতীক্ষায় আছে-
আছে, কখন আসবে ফিরে, কখন স্বাধীন এই
মাটিতে রাখবে সে পা, শ্বাস নেবে স্বাধীন বাতাসে
তার অপেক্ষায়, আছে তার পথের উদ্দেশে চেয়ে।

পিতার অবর্তমানে যোগ্য সন্তানেরা যেরকম
জ্বেলে রাখে স্বপ্ন তার, আমরাও ঠিক সেইভাবে
ছিনিয়ে এনেছি সূর্য, বিজয়ের রক্তমাখা ভোর।

গৌরবঃ তোমাদের বোঝাতে পারি না, আমি পারি না দ্যাখাতে,
আশংকারা কুরে খায় আমার মগজ। আমি দেখি,
টের পাই, কি যেন ঘটছে খুব গভীর অতলে।
তোমরা বিশ্বাস করা এ-বিজয় চূড়ান্ত হয়নি-

যেই অস্ত্র কাঁধে নিয়ে প্রান্তরের পথে, রনাঙ্গনে,
শক্র হননে ছিলাম ক্ষমাহীন সুতীব্র সৈনিক,
ক্ষুধা পেটে, ঘুম নেই চোখে শুধু স্বপ্নের ঝিলিক।
সেই অস্ত্র হাতে নিয়ে আমরা নামতে চাই আজ
বিধ্বস্ত দেশের সকল নির্মানে। অথচ এখনি
অস্ত্র জমা দিতে হবে! ভাবো, একবার ভেবে দ্যাখো।

মোংলাইঃ বড় বেশি দুর্ভাবনা তোমাকে বিরক্ত করে, তুমি
বীজ ছড়িয়ে দিয়েই মেতে ওঠো ফসল বণ্টনে।
যে নেতারা যুদ্ধমাঠে আমাদের করেছে চালনা,
অনর্থক কেন ভাবো আজ তারা করবে অহিত?

রাখালঃ তর্ক থাক, এসো, আনন্দের উদযোগ নিই সবে।
নয় মাস কষ্টে কষ্টে তেতে আছে মাথার মগজ,
এসো তাকে সাফ করি, ধুয়ে ফেলি কষ্টের কালিমা-

বকুলিঃ সকলের কষ্ট ধোয়া যায় না রাখাল দাদা, জানো,
সব কষ্ট মোছেও না। এ- তো নয় জলের দাগ যে
রোদ্দুরে শুকিয়ে যাবে কোন এক শীতের সকালে।

মোংলাইঃ থাক, থাক, কষ্ট নিয়ে কষ্টাকষ্টি এবার থামাও।
সুধাভাণ্ড অপেক্ষায়, কখন ছোঁয়াবে তাতে ঠোঁট!
কখন ভুলবে এই জীবনের স্থুল মন্দ-ভালো!
বকুলি বকুল ওগো, শোনাবে না তোমার কাহিনী?

বকুলিঃ কাহিনী শুনতে চাও, আমার কাহিনী?
মনে তবে ভাবো এক নদীর জীবন।
কতো মাঠ, কতো ঘাট ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়,
কতো যে প্রান্তর, বন, কত লোকালয়,
পেরিয়ে কতো না বাঁক তবে তো সাগর।

হয়তো বা নদী বোঝে সাগরের মানে,
আমার হলো না বোঝা জীবন সাগর।
এতো বাঁক পেরোলাম এতো ঘাট ছুঁয়ে,
সবখানে দেখি একহাজামজা খানা।
বন্ধ সে জলের মাঝে বৃথা খুজি পথ,
বৃথা খুঁজি জীবনের পরম সাগর।
তাই তো এ-বদ্ধ জলে ঢেউ তুলি আমি-

রাখালঃ এ কাহিনী! এ তো জানি আমরা সবাই।
কিভাবে ডুবিয়ে ছিল সৈন্যসহ নাও,
তাই বলল। শুনেছি তো লোকমুখে, আজ
তোমার মুখেই চাই শুনতে সে কথা।

গৌরবঃ থাকো তোমাদের বিজয় উৎসব নিয়ে, আমি যাই।
ক্যাম্পে এসে হত্তে দিয়ে প’ড়ে আছে গ্রামের মানুষ,
খোরাকির চাল নেই কোনোমতে খুটি চালা দিয়ে
মাথা খুঁজে আছে তারা পোড়া ভিত, বিরান সংসারে।
পাশ্ববর্তী বন্ধু দেশে শরনার্থী হয়ে যারা ছিলো,
ফিরছে সবাই তারা, তাদেরও খাদ্য দরকার।

রাখালঃ সেই ভালো, আনন্দ জমে না যদি মন থাকে বৈরি,
ওদিকটা সামলাও তুমি, আমরা ফিরছি পরে।

রাঙ্গামিয়াঃ বুঝলে রাখাল দাদা, তোমরা তো যুদ্ধে চ’লে গেলে,
এদিকে তখন কী-যে লটোঘটো, দোকান চলে না।
কে খাবে তামাক তাড়ি’ বেঘোরে জীবন চ’লে যায়,
পরানটা হাতে নিয়ে ঘোরে সকলেই দিনরাত,
খবর আসতে থাকে, এই আসে, মিলিটারি আসে!

তারপর ঠিকই মলে একদিন, সাথে দেখি
আমাদের আক্কেল মোড়ল। আমার বুকের ‘পরে
রাইফেল তাক কোরে কয়, শালা মুক্তি, হিন্দু হ্যায়?
আমি বলি, মুক্তি নেহি বন্দি হ্যায়, হুজুরের মর্জি,
এই সুরা-টুৱা বেচি-টেচি- আপনারা খিদমত
পাবেন আমার কাছে, যা যা দরকার এনে দেবো।

আহারে! গেরামটারে উল্টেপাল্টে দিয়ে সাহাবাড়ি
ঘাঁটি গেড়ে বসলো খানেরা। কলস কলস তাড়ি
দিয়ে আসি রোজ সন্ধেবেলা, মাঝেমধ্যে কোনোদিন
বকুলিরে রেখে আসি। সে-যে কী দোজখ! সাতদিন
তারপর বিছানায় প’ড়ে থাকে, উঠতে পারে না।
শেষে এক ফন্দি কোরে পূর্ণিমার জোঘার জোয়ারে
বকুলি ডুবিয়ে দিলো সৈন্যভর্তি বিরাট সে-নাও।
দুটো লাশ পেয়েছিলো বাকি সব দরিয়ার পেটে-
এদিকে কেমন যেন সন্দ সন্দ টের পাই গ্রামে,
চামে ভাবি, বিয়ে কোরে ফেলি বকুলিরে, নষ্ট মেয়ে,
পথে ঘাটে ম’রে যাবে, থাক, আমার ঘরেই থাক।
মানুষ কি আর মরা মাছ যে সে নষ্ট হয়ে যাবে!
ও তো সমাজের কথা- সেই থেকে পেতেছি সংসার।

মোংলাইঃ তিন কাল চ’লে গেছে এখন উঠেছে জেগে চর,
ময়ুরপংখি এ-নাও কি কোরে যে বেয়ে যাবে তুমি!
নিচেয় কঠিন বালি, পালে কি হাওয়া পাও আজো?
সারাদিন থাকো তো ছিলুমে মজে বোম ভোলানাথ-
আর পাখিটি তোমার উড়ে উড়ে ফুলে ফুলে ঘোরে।

রাঙ্গামিয়াঃ সেতো অতি সত্যি কথা, ওর হলো প্রজাপতি মন,
সারাদিন এ ফুলে ও ফুলে বসে পান করে মধু,
তারপর ফিরে আসে নীড়ে তার আমার শাখায়-
সত্যি বড়ো ভালোবেসে ফেলেছি এ নবীন বাঁশরী।

বকুলিঃ যে কেউ বাজায় তারে, সুর তোলে মনের মতোন,
তুমি শুধু দেখেশুনে ধুয়েমুছে তুলে রাখো তারে।
আমার মতোন কোরে আমারে কি বাজাবে না কেউ?
কোনদিন সার্থক নদীর মতো পথ কেটে কেটে
যেতে পারবে না ওগো মায়াময় সংসার সাগরে?
এই মজা পুকুরের জলে আর কতোদিন রবো?

মোংলাইঃ এই তো হাজির সামনেই এক বেগবান নদীস্রোত,
নোঙর ওঠাও, খুলে দাও গিঁট বুড়ো বটগাছ থেকে।
আমার জলের ধারায় ভাসাও ময়ুরপংখিখানা,
আমি সেই নদী সমুদ্রে যার মিশে গেছে অবয়ব।

বকুলিঃ মিষ্টি কথায় ভুলছি না গো ভুলছি না,
রসিক নাগর বাঁধন আমার খুলছি না।
প্রলোভনেও নোঙরখানা তুলছি না,
একটুখানি ঢেউ দিলে আর দুলছি না।

বকুলিঃ রূপবান, যা বোন, ঘরের ভিতরে যা। সানকিতে
দ্যাখ চাট্টে পানিভাত আছে লংকা ডলে খেয়ে ফ্যাল,
ইচ্ছে হলে শুয়ে থাক, বারান্দায় চাটাই বিছানো৷

শোকে তাপে দিকহারা হয়ে গেছে মাথা ঠিক নেই।
আহারে, কি জমজমাট সংসার ছিলো মিস্ত্রি বাড়ি!
আজ খালি পড়ে আছে শূন্য ভিটে, স্মৃতি, হাহাকার-

দীপংকরঃ রাখাল-দা, এখুনি যেতেই হবে, অবস্থা খারাপ।
ক্যাম্পে গোলাগুলি শুরু হয়ে গেছে নিজেরা নিজেরা,
একদিকে গৌরবের দল, ধোনাইদা অন্যদিকে-

রাখালঃ কি ঘটনা খুলে বল, কারো গায়ে লাগেনি তো গুলি?

দীপংকরঃ না, তবে চলছে বেপরোয়া। ঘটনা হয়েছে এই-
আক্কেলের ধানের কোলাচ কেটে দিয়ে সব ধান
ভাগ কোরে গ্রামবাসীদের দিয়ে জচ্ছিলো গৌরব।
তখন ধোনাই এসে বাধা দেয়, তারো দল ভারি,
বলে, এইভাবে ধান বিলুবাট কোরে দিলে পরে
আমরা কি খাবো? আমাদের চলবে কি ভাবে? বলে,
সরকারি রিলিফ এলে কিছুই যাবে না করা।
আর গৌরবদা বলে, জমিন খোদার, এই ধানে
সকলের আছে হক, তা ছাড়া না খেয়ে আছে লোকে।

রাখালঃ তাহলে তো পরিস্থিতি খারাপ খুবই, চলো যাই।

মোংলাইঃ চলো, সময় পেলো না আর গ্যাঞ্জাম লাগাতে, শালা-

রাঙ্গামিয়াঃ ও বকুলি বুঝিস কিছু?
ছুটছে কে যে কাহার পিছু?
মক্কেলে চায় কিছুমিছু-
ঝড়ের হাওয়ায় ভাঙলো সবি
রইলো না আর উঁচু নিচু।
কথায় বলে, পোলাপানরে
নেই দিতে নেই দৈয়ের হাঁড়ি,

রাখালঃ এ-যে দেখি বৃন্দাবনে শ্রীরাধা ও কৃষ্ণের আলাপ,
এরপর হবে নাকি নিগুঢ় রসের কামলীলা?
আমি তবে হয়ে যাই কুঞ্জবনে নিবিড় তমাল।
কিন্তু সে কাহিনী তুমি- কই বললে না? সেই নৌকো-

রূপবানঃ নৌকো নেই শুধু জল, চারিপাশে অথৈ জলরাশি
খলবল ছুটে যায়, কে আমারে পার কোরে দেবে?
কে আমারে নিয়ে যাবে শুকনো মাটির ওই তীরে?

রাঙ্গামিয়াঃ গোলমাল মোটে করিস নে ছুড়ি, চুপ হয়ে বোসে থাক,
সারাদিন তোর বক বক শুনে মাথার কম্মো শেষ।

রূপবানঃ কথা যে ফুরোয় না গো, এতো কথা জমা হয়ে থাকে!
এতো মেঘ ওড়ে! বাজ পড়ে মাথার ভেতর, মাগো-

মোংলাইঃ মাথার মধ্যে বাজ পড়ে নাকি? হা হা,
দারুন, দারুন, ঘটনাটা বেশ, হি, হি,
আমি তবে হোই বৃষ্টির জল, হো হো-

রূপবানঃ হাসো কেন? হাসো কেন? কোথা থেকে আসে এতো হাসি?
আমারে ঝুলায়েরেকে সমাজের ফাঁসির দড়িতে
তোমরা উল্লাস করো! হাসোও খিলখিল- ঝিলমিল,
ঝিলমিল করে চোখের নদীর জল কি সুন্দর!
তোমরা দেখতে পাও? কিরকম কষ্টের ছোবলে
নীল হয়ে গেছে আজ আমার জীবন- ফেরেস্তারা,
ও আমার নীল ফেরেস্তারা, নিয়ে যাও, নিয়ে যাও-

রাখালঃ আহ্ হৈচৈ কোরো না এখানে, যাও, ক্যাম্পে চলে যাও,
দ্যাখো সেইখানে কিছু খাওয়া-দাওয়া পাও কিনা।

রূপবানঃ আবার আমারে ক্যাম্পে নিতে চাও তোমরা সবাই!
হায় মরনের ক্যাম্প! ফের সেই হাবিয়া নরক!
নীল ফেরেস্তারা, আমারে উঠায়ে নাও আসমানে,
আমারে উঠায়ে নাও, নিয়ে যাও, তুলে নিয়ে যাও-
খেতে তো ছাই পারবে না কেউ
করবে কেবল কাড়াকাড়ি।

বকুলিঃ অত সব প্যাচ ঘোচ বুঝি না কিছুই,
আমার কেবলি ইচ্ছা নদীটারে ছুঁই।
শত পথ পাড়ি দিয়ে যেই নদী যায়,
জীবনের শান্তি হয়ে সাগরে হারায়।

৪. অস্ত্র সমর্পন পর্বঃ
(দুজনের সাথে পাঁচজন কোরে মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু তাদের মুখ বাঁধা।)

রাখালঃ বঙ্গবন্ধু ফিরেছেন দেশে। তখন বলেছিলাম
পৃথিবীর কোনো শক্তি পারবে না আটকাতে তাঁকে।
সত্যি হলো সেই কথা। দ্যাখো আজ বাংলার আকাশ
রঙিন হয়েছে আনন্দ উল্লাসে, পাখিদের কণ্ঠ
গেয়ে ওঠে সুমধুর বিজয়ের গান। ঝরাপাতা,
তারাও খুশিতে ওড়ে ডানা মেলে পাখির মতোন।
তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে আজ অস্ত্রসমর্পন-

গৌরবঃ ভাবতে পারি না আমি, কোনোভাবে মেলাতে পারি না!
বঙ্গবন্ধু এ বাংলার মাটি যাকে নির্মান করেছে,
বাংলার কৃষক, জেলে, সর্বহারা, শোষিত শ্রমিক,
যার কণ্ঠে কথা বলে ভুখানাঙ্গা পীড়িত মানুষ,
যার হাত ভেঙে দিলো বনেদি বাড়ির মাতবরি,
সে বলছে অস্ত্র জমা দিয়ে যার যার কাজে যাও!

বিশ্বাস হয় না। এর মধ্যে আছে অন্য ষড়যন্ত্র,
অন্য চতুরতা আছে সুগোপনে, আছে অন্য চাল।
যুদ্ধের পুরোটা নয় মাস পাকিস্তানি কারাগারে
বন্দি আমাদের প্রানপ্রিয় নেতা। যুদ্ধ মাঠে
অন্য মাথা চালনা করেছে সেই উত্তাল প্লাবন,
নায়ের হালের বৈঠা ধরে ছিলো অন্য এক হাত।

সে-দৃশ্য দ্যাখেনি নেতা, দ্যাখেনি সে দীপ্ত জলোচ্ছাস,
মানুষের সর্বশেষ সহন ক্ষমতা, তার ঋজু
ফিরে দাঁড়াবার তেজ, বিপুল তিতিক্ষা-ত্যাগ আর
সমুদ্রের জলের মতোন একাকার একাত্মতা।

এ-কথা নেতার নয়, তাঁর মুখ দিয়ে অন্য কেউ,
অন্য কোনো মতলববাজ কৌশলে বলিয়ে নিচ্ছে।
বেহুলার লোহার বাসরে ঢুকে গেছে কালসাপ,
তা-না হলে বঙ্গবন্ধু, তাঁর কণ্ঠে একি কথা শুনি!

রাখালঃ ঠিকই তো শোনো। যুদ্ধ শেষ, কি হবে অস্ত্রে এখন?
যুদ্ধে বিধ্বস্ত স্বদেশ, প্রয়োজন এখন নির্মান।
এখন কি ঠিক হবে অনর্থক অস্ত্র কাঁধে ঘোরা?
অস্ত্র জমা দিয়ে চলো হাত দি দেশগড়ার কাজে-

গৌরবঃ যুদ্ধ শেষ! যুদ্ধ শেষ! বার বার এক কথা বলো!
সব যুদ্ধ হয় না যুদ্ধের মাঠে, আঁরো যুদ্ধ আছে।
কেবল মাঠের যুদ্ধ হলো শেষ, এখন লড়াই
জীবন-গড়ার, শোষনহীন সাম্যের জীবন।
ন্যায়, শ্রম আর যোগ্যতায় দৃপ্ত আনন্দ জীবন-

বেনিয়া বৃটিশ আর পাক-লুটেরার প্রশাসন
টুকটুকরো কোরে ভেঙে দিতে হবে। গ্রাম জুড়ে
সামন্ত-সমাজ-রীতি জগদ্দল পাথরের মতো
হাজার বছর ধরে চেপে আছে মানুষের ঘাড়ে,
দিতে হবে আজ তারো শিকড়ের মূলগুলো কেটে।

কেরানি পয়দা আর আমলা নাজেল করা এই
উপনিবেশিক প্রতারক শিক্ষানীতি, দিতে হবে
সমূলে উৎখাত কোরে এইসব ভাওতা ভনিতা।
যোগ্যতার মানদণ্ড হবে শুধু মেধা আর শ্রম-

রাখালঃ রাতারাতি হয় না কিছুই, শোনো, শোনো, শান্ত হও,
জমা দাও অস্ত্রপাতি। সরকার স্বাধীন এখন,
লক্ষ প্রান দিয়ে গড়া স্বাধীনতা বিফল হবে না।

গৌরবঃ রাতারাতি কিছুই হয় না জানি কখন কোথাও,
রাতারাতি হয় শুধু ষড়য, প্রাসাদে প্রাসাদে
ক্ষমতার জন্যে কামড়া কামড়ি, চক্রান্তের খেলা।
তা-না হলে এতো মেঘ কেন দেখি স্বপ্নের আকাশে।
কেন এতো শেয়াল কুকুর দাঁত বের কোরে ঘোরে
চারপাশে আমাদের, কেন এতো লোভ, প্রতারনা!

আক্কেল মোড়ল, দ্যাখো শত্রু সে, দালাল, খুনি, তবু
তার পক্ষে লোক আছে এখনো এ গাঁয়ে, আছে তার
সম্পদের নিরাপত্তারক্ষী। সেদিন তোমরা জানো
তার ধান অনাহারি লোকদের দেওয়া গেল না,
নিজেদের মধ্যে হলো গোলাগুলি-তীব্র মতান্তর।

সুদীর্ঘ দিনের অভ্যস্ত জীবন ভেঙে ফেলে দিয়ে
অনভ্যস্ত এক নতুন জীবন গ’ড়ে তোলা, শোনো
সে ভীষন কঠিন লড়াই- লড়াই নিজের সাথে,
আপন রক্তের মধ্যে বেড়ে ওঠা স্বভাবের সাথে।
যুদ্ধ শেষ, যুদ্ধ বোলে তুমি আসল যুদ্ধের
মাঠ থেকে ফিরিয়ে রাখতে চাও পরিতৃপ্ত চোখ।

তবে কি বলতে চাও তুমি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ
আমরা অমান্য কোরে অস্ত্র জমা দেবো না এখন?
প্রানপ্রিয় নেতৃত্বের কাছে হব বিশ্বাসঘাতক?

প্রবল জলের বিপরীতে কতিপয় খড়কুটো
আমরা দাঁড়াবো ফিরে? তা হয় না, তা হয় না, শোনো,
এখনো সময় আছে স্থির হও, মাথা ঠাণ্ডা করো।

হা বিশ্বাস, হায় স্বপ্ন! মাথাটা কি পদ্মার ইলিশ
যে তাতে বরফ দিয়ে কোনো এক বাজারে উঠাবো?
তারপর দেখেশুনে কিনে নেবে মগজ-ক্রেতারা!

আমার সিদ্ধান্ত স্থির। যতোদিন শেষ না হয় এ
জীবন বদলানোর কঠিন লড়াই, ততোদিন
এ-হাতে দেখবে এই ক্ষমাহীন নির্মম ইস্পাত-

রাখালঃ অস্ত্র জমা দেবে না তাহলে? এই তবে শেষ কথা?
নেতার নির্দেশ করবে অমান্য? বিশ্বাসঘাতক-

গৌরবঃ জবান সামলে কথা বলো, বিশ্বাসঘাতক কারা
সে কথা বলবে ইতিহাস অনাগত ভবিষ্যতে।

রাখালঃ আর ইতিহাস কেন? এখনি তো দেখছি নমুনা,
সদ্য স্বাধীন হয়েছে দেশ, হাজারো সমস্যা তার,
অথচ এরই মধ্যে অন্তর্ঘাত, বৈষম্য, বিভেদ
শুরু হয়ে গেছে। বাস্তববর্জিত এক অন্ধ স্বপ্নে
মাথা কুটে মরছো তোমরা- ওই স্বপ্ন ভুল, ভুল।

গৌরবঃ সকল মানুষ দুবেলা দুমুঠো খেতে পাবে, আর
যার যার মেধা ও শ্রমের যোগ্যতায় পাবে কাজ।
দালান না হোক, হবে সকলের জন্যে কুঁড়েঘর,
রোগে ভুগে পথে ঘাটে মরবে না মানব সন্তান-
এই স্বপ্ন যদি হয় ভুল স্বপ্ন, তবে এই ভুল
পবিত্র ফুলের মতো বুকে করে রাখবো আমরা।

রাখালঃ সে তো আমরাও চাই, আমাদেরো উদ্দেশ্য সমতা।
গরীবের ডালভাত, মোটা কাপড়ের বন্দোবস্ত
করছি আমরা, রিলিফ আসছে, হচ্ছে বিতরন।
না খেয়ে কেউ কি মারা গেছে? বলো, তোমরাই বলো?

গৌরবঃ এই এক কুপথ্য- রিলিফ! ভিক্ষুকের মেরুদণ্ড
থাকে না কখনো, ক্রমশ সে হয়ে যায় সরীসৃপ।
কল্যানের নাম কোরে মেরুদণ্ড হরন চলছে,
কি বিপুল আয়োজন তার, কি বিরাট যজ্ঞ আহা!

রাখালঃ অজ্ঞদের এ-রকমই ভাবনাচিন্তা, তারা থাকে
কল্পনার সুউচ্চ মিনারে বোসে, আর মনে ভাবে
রয়েছে মাটির কাছাকাছি। তত্ত্ব দিয়ে সমাধান
হয় না জটিল বাস্তবের, আঁতলামি হয় শুধু।

গৌরবঃ সেজো না সৌখিন মূর্খ। তোমরাই বাস্তববর্জিত-
এই গায়ে যে ধান মজুদ ছিলো বিভিন্ন গোলায়,
গ্রামশুদ্ধ লোকের তা ছয় মাস খোরাকি পোষাবে,
অথচ মজুতদার পুষে রেখে তোমরা বিলাচ্ছো

রিলিফ-লাঞ্ছনা, সরীসৃপ জীবনের তবারক।
ঘাভর্তি শরীরটাকে ঢেকে দিচ্ছো রঙিন পোষাকে-

স্বপ্নহীনতাই দেখি আজ পায় স্বপ্নের মর্যাদা,
অযোগ্যরা হয়ে ওঠে স্বপ্নদ্রষ্টা, কর্নধার মাঝি।

রাখালঃ ভাঙনের শব্দ পাচ্ছি, গন্ধ পাচ্ছি প্রতিবিপ্লবের,
অস্ত্রসমর্পন তা হলে কি করছো না তুমি আজ?

গৌরবঃ আমার এ-অস্ত্র আমি সমর্পন করেছি আগেই,
সমতামন্ত্রের কাছে সমর্পিত এ- অস্ত্র আমার।

৫. ক্যাম্প পর্বঃ

শীলভদ্রঃ পাঁচশো কম্বল এসেছিলো, বেছে বেছে ভালোগুলো
তোমরা নিয়েছে। পচা শাড়িগুলো দিলে আমাদের।
এক সের চালও দিলে না, নিজেরাই নিলে সব।
এই নাকি তোমাদের স্বাধীনতা? মন্ত্র, স্বপ্ন, সাধ?
এই নাকি বিচার আচার তোমাদের? এই নাকি
আমার সোনার বাংলা, মায়া মমতায় ভরা?
ভাত ভুলে দৈনিক আটার রুটি, এই স্বাধীনতা!
কোনো দরকার ছিলো এই স্বাধীনতা আমাদের?

মোংলাইঃ প্যাচাল পেড়ো না, গম তো পেয়েছো? যাও, বাড়ি যাও।
যতো সব ঝামেলা খ্যাচাল। তুই ব্যাটা ছুঁচো শীল,
তোর আবার স্বাধীনতা কি! চটির আবার ফিতে!
ঘরে বোসে বস্তা বস্তা গম পাচ্ছো বিনা কামকাজে,
আর কতো, কতো চাও? এ- কি রাজার ভাণ্ডার নাকি?

রাখালঃ শোনো ভাই জিনিশটা বোঝো, গত নয় মাস ধ’রে
দেশটারে লুটেপুটে খেয়ে গেছে পাক হানাদার,
কিছু নেই, কেবল ছোবড়াডারে ফেলে রেখে গেছে।
এই তো অনেক পাচ্ছো, টেনেটুনে পরান বাঁচাও।
সবুজ বিপ্লব শেষ হলে রিক্ত নিস্ব কৃষকের
আর কোনো চিন্তা নেই, মিটে যাবে সব জ্বালাপোড়া।

মোংলাইঃ বন্ধু দেশ বাদ পড়ে গ্যালো, তারাও কি কম কোরে
নিয়েছে উশুল? ফাকা কোরে দিয়ে গেছে লোকালয়।
হাজার বছর ধরে লুটপাট চলছে কেবলি,
সুযোগ পেয়েছে কি বসাবে থাবা, কেড়ে নেবে সব-

দীপংকরঃ আমার কী হবে এখন রাখাল দাদা? আমার তো
দুনিয়াপুরিতে আর থাকলো না কেউ, সব গ্যালো-
স্বাধীনতা নিয়ে গ্যালো সব। এই ক্যাম্প উঠে যাচ্ছে,
শুনলাম ক্যাম্প ছেড়ে সকলেই চ’লে যাবে বাড়ি!

আমি যাবো কোনখানে? কোথায় আমার বাড়ি, ঘর?
বিরান পৈতৃক ভিটে শূন্য খা-খা প’ড়ে আছে ধু-ধু।
হায় স্বাধীনতা! হায় স্বাধীনতা! নিয়ে গেলি সব-

পাচুবিবিঃ এতো কি বিলাপ করো? বাঁচা-মরা কারো হাতে নাই,
যে যাবার সে তো চলে যায়, বন্ধ থাকে না কিছুই।
ভাঙা ভিতে ঘর ওঠে, শুকোয় চোখের জল, দুঃখ?
সে-তো মানুষের ছায়ার মতোন, সাথে সাথে থাকে।

দুনিয়াজাহানে আমার তো কেউ নেই, ছেড়ে গেছে সব।
প্যাটের ছেলের মতো সুচোখে দেখবো তোরে, চল,
আমার সাথেই চল, পোড়া কপাল রে আয়, আয়-

রাখালঃ এই তো মায়ের মতো একখানা কাজ হলো বটে,
শাবাস, শাবাস! মিটে গ্যালো সব সমস্যা তোমার।
ইচ্ছে হলে ক্যাম্প ছেড়ে বেলাবেলি আজি যেতে পারো-

দীপংকরঃ যুদ্ধমাঠে এক স্বপ্ন অহর্নিশি তাড়াতে আমাকে,
স্বাধীন দেশের মাটি কেড়ে নেবে সব ভেদাভেদ,
সকলের চাওয়া-পাওয়া মিলেমিশে এক হবে,
জন্মের মতোন ঘুচে যাবে দূরত্বের কাঁটাতার-
সেই স্বপ্ন শেষ হবে, ভেঙে যাবে মাঝগাঙে এসে
সওদা বোঝাই নাও, বুঝিনি এতোটা তাড়াতাড়ি।

পাচুবিবিঃ চিরকাল পৃথিবীতে মানুষের নিয়তি এমন,
দুযোগ দুভোগ ছাড়া একসাথ হতে সে পারে না-
সুখের বাতাস পেলে ভেঙে যায় খানখান হয়ে।

ধোনাইঃ কথাটা জানানো দরকার, শোনো সকলেই বলি,
আক্কেল মিয়ার জমিজমা আমার দায়িত্বে থাক,
এ-বছর দ্যাখাশোনা আমিই করতে চাই, আমি।
চাষবাস করো যারা দ্যাখা কোরো সময় মতোন।

মোংলাইঃ সে-কি কথা! হাজার একর জমি একা নিতে চাও?
পুরোটা একাই নিলে অন্যদের কি হবে গতিক?

ধোনাইঃ রেশন ডিলারি পেলে, দুই দুটো হাটের আদায়,
আর কতো? ঠিক আছে, বিশ বিঘে বর্গাভাগে নাও,
বিঘে প্রতি পাঁচ মন কড়ালির ধান দিও তুমি
শীতকালে। কবিকে ঐইবার আমিই আনাবো।

গুরুছোটোঃ বেশ, ভালো কথা, যার হলো অম্লশূল, তারে দিলে
সুবাসিত দাঁতের মাজন! আমি হচ্ছি খাঁটি চাষা,
জমিনের সাথে বাঁধা চিরকাল আমার কপাল।
তোমরা চেনো না কেউ মাটির চেহারা, কোনোদিন
পোয়াতি জমির সাথে তোমাদের দ্যাখা হয় নাই,
অথচ সকল জমি নিয়ে নিচ্ছে তোমাদের হাতে।

ওসব হবে না, জমিনের ভালোমন্দ দ্যাখাশোনা
বুঝবো চাষিরা। তোমাদের কাজ তোমরা চালাও-

রাখালঃ খাঁটি কথা, জমি হলো কৃষকের আপন সন্তান,
সেইখানে অন্যকারো বাহাদুরি চলে না কখনো।
তবে কি পরিত্যক্ত জমির দায়িত্ব, সব দায়
বর্তমানে আমাদের। তোমরাই চাষবাস করো,
কিন্তু হিশেবটা আমাদের কাছে দিতে হবে, বুঝো।

গুরুছোটোঃ বুঝলাম, নাটাইটা হাতে রেখে ঘুড্ডিডিরে বলা,
উড়ে যাও, মুক্ত মনে উড়ে যাও আকাশের দিকে!
গৌরবের কথাই দেখছি ফ’লে যাচ্ছে একে একে-
যে ভূত তাড়াতে গিয়ে প্রান দিলো লক্ষ লক্ষ লোক,
সে ভূত চেপেছে আজ সংগোপনে তোমাদের ঘাড়ে।

ধোনাইঃ তুমিও তিরিশ বিঘে নিয়ে নাও, কথা ওই এক,
শীতকালে বিঘে প্রতি পাঁচ মন কড়ালির ধান।
আর ওই সব নাম ভুলেও নিও না মুখে কেউ,
ওসব দুষ্কৃতকারি, দেশ ও দশের দুশমন।
ওদের ধরিয়ে দাও, তুলে দাও পুলিশের হাতে-

মোংলাইঃ এই তো সেদিন সন্ধেবেলা দিঘির বাঁধানো ঘাটে,
মাথা কেটে নিয়ে গ্যালো মতুল্লা মিয়ার, চিন্তা করো!

তার মতো মাথায়ালা লোক কটা আছে আশেপাশে?
বড় লোক, মানী লোক- শেষ কোরে দিতে চায় ওরা-

গুরুছোটোঃ ধনী, মানী যাই বলো, লোকগুলো ভালো লোক নয়,
মাকাল ফলের মতো রূপরঙ বাইরে বাহার।
কিরকম কদাকার ভেতরের চেহারা তাদের
কে না জানে সেই কথা। কারো কারো সম্পদের গায়
বুকফাটা হাহাকার মাখা, চোখের জলের দাগ,
কারো কারো টাকায় রক্তের ছোপ, বিষের যাতনা।

ধোনাইঃ কি ঘটনা! নেতা হয়ে গেলে নাকি চাষবাস থুয়ে?
কেমন কেমন যেন টের পাই কথার ভেতর
অন্য গন্ধ আসে- সর্বহারা, সর্বহারা মনে হয়।
গৌরবের সাথে যোগাযোগ আছে নাকি ছোটো মিয়া?

গুরুছোটোঃ প্রয়োজন এসে যোগাযোগ কোরে দেয়, প্রয়োজন-
সূর্যটা যখন ঠিক মাথার উপরে থাকে, আর
ছায়া থাকে পা-র নিচে, টের পায় সকলে দুপুর।
চৈত্রের হাওয়া এসে ছ্যাকা দেয় যখন শরীরে,
যখন মাঘের শীত কেঁপে ওঠে হাড়ের ভেতর-
টের পায়, ছেলে বুড়ো সকলেই টের পেয়ে যায়।

রাখালঃ সে কথা সঠিক বটে, তবে কিনা সময় খারাপ,
কে না বোঝে নিজের ভালাই, সুখ, সুবিধা, সুযোগ!
কালবোশেখির ঝড়ে কেউ উড়ায় না নীল ঘুড়ি,
দাঁড়ায় না মুখোমুখি শ্রাবনের উতলা জলের।
কেউ কি এমন বোকা রোদুরে লিখতে চায় নাম
জলের অক্ষরে! আর হাত দেয় কেউটের লেজে!

সকলেই ছায়া খোঁজে, ছায়া চায় ঠাটানো দুপুরে,
বানভাসি হলে খোঁজে খড়কুটো, ফুলের আশ্রয়।
ছায়ার জন্যেই চাই কিছু কিছু শক্ত বড়ো গাছ-
কচুর পাতার নিচে কি আর আশ্রয় মেলে কারো?

ভেবেচিন্তে কথা বোলো, কাজ কোরো নিরব জবানে,
সময়টা ভালো নয়- অসময়ে মেঘ কোরে আসে।

গুরুছোটোঃ সময়টা ভালো নয়- আসমানে উড়ছে শকুন,
মধ্যরাতে ডাকে কাক অমঙ্গল কর্কশ জবানে,
মাটির আশ্রয় ছেড়ে বাইরায় উদ্বাস্তু সাপেরা,
তেমাথায় শেষ রাতে ডেকে ওঠে কাতর কুকুর-

সময়টা ভালো নয়, সময়টা ভালো নয় মোটে,
বাঘেরা হয়েছে দকেহি লোকালয়ে গোরুর রাখাল।

৬. গর্ভপাত পর্বঃ

গৌরবঃ ঘরে কি খাবার আছে? ভাত আছে, ভাত? কতোদিন
অন্নদানা জোটে না কপালে। বাদাড়ে জঙ্গলে থাকি,
মানুষের স্বপ্ন বুকে পথে পথে পশু হয়ে ঘুরি।
খুঁজি শ্রেনীশত্রু, খুঁজি বিপ্লবের বিরুদ্ধ শক্তিকে-

বদলে ফেলতে হবে ঘুনেধরা জীবনের ঘর,
এই জুলুমের সমাজসংসার, তার রীতি-নীতি।
দুই দিন দানাপানি পড়ে নাই পেটে, আছে কিছু?

বকুলিঃ কতোদিন পরে দেখি মানুষডারে, কেমন আছো?
ভাত নেই, আছে খান কয় শুকনো আটার রুটি,
মান্শালে সবার রেজেক থেকে উঠে গেছে ভাত।
না-খাওয়া মানুষেরা গ্রাম ছেড়ে শহরে ছুটছে-
শুনছি খবর, শহরের পথে পথে মানুষের লাশ
প’ড়ে আছে কাফন জোটে না কারো কবর জোটে না।

এই স্বাধীনতা এনেছিলে বলল তোমরা সকলে?
পথেঘাটে জন্তুর নাহান মরবার স্বাধীনতা?
এই জঠরে পাথর বেঁধে রাখবার স্বাধীনতা?

গৌরবঃ দেখছে না, ঠাঁই নেই আমাদের আজকে কোথাও,
লোকালয় হয়েছে নিষিদ্ধ। সাত পুরুষের ভিটে
কবরখানার মতো আললাহীন আন্ধারে ঝিমায়।
পলাতক আসামীর মতো গোপনে গা-ঢাকা দিয়ে
চলি, ফিরি, কা’ধে ঝোলে স্বপ্নবান তাজা হাতিয়ার।

জীবন বদল হবে- এই স্বপ্ন আজ অপরাধ,
যুদ্ধের সাথিরা আজ অনেকেই বিরুদ্ধ শিবিরে,
বন্ধুর শোনিতে ভিজে লাল আজ বন্ধুদের হাত।
ওলোট পালার্ট হয়ে গ্যালো সব-হায় স্বাধীনতা!

বকুলিঃ লোকে বলে, তুমি নাকি রাখালের খুনের আসামী?
তোমার হাতেই নাকি সে হয়েছে খুন, সত্যি নাকি?
অপরাধ নিও না, জানতে ইচ্ছে করে, তাই বলি-

মনে পড়ে যুদ্ধ শেষে ফিরে এলে তোমরা সবাই,
রাখালদা তোমাদের নেতা, মানুষটা বড়ো ভালো।
হাসিমুখে কথা কয় সকলের সাথে, রাতে দিনে
যে কারো বিপদে দেখি বুক দিয়ে ঝাঁপায়ে সে পড়ে-
তারে কেন মারলে তোমরা, কেন, কোন অপরাধে?

গৌরবঃ শ্রেনীশত্রু ছিলো সে-সে ছিলো শ্রেনীশত্রুর দালাল,
গরিবের রক্ত চুষে যারা খায়, যারা বড়োলোক,
সে ছিলো তাদের দলে, তাবেদারি করতো তাদের।

বকুলিঃ শ্ৰেনীশত্রু! শ্রেনীশত্ৰু কি জিনিশ বুঝি না গৌরব,
গরিব ঘরের পোলা, গরিবের বিপদে আপদে
তাকেই তো পেয়েছি নিকটে, পাশে, স্বজনের মতো।
কেন বা সে হতে যাবে গরিবের বড়ো দুশমন?

গৌরবঃ এখানেই ফাঁক, ফাঁকি, তোমরা বোঝা না কিছু তার,
গাছের শিকড় কেটে যদি তুমি পানি ঢালল ডালে,
তাতে কি গাছের কোনো উপকার হয়? নাকি উল্টো?
উল্টো হয় তাতে ক্ষতি, ধংশ হয় বৃক্ষের জীবন!

তেম্নি রাখালেরা অবিকল টিকিয়ে রাখতে চায়
ঘুনেধরা সমাজের বস্তাপচা নিয়মকানুন,
ক্ষমাহীন শোষনের কলকজা, পুরোনো জুলুম।
মৃত্যু তার অনিবার্য, অবশ্যই মরন তাদের,
বন্দুকের নল হলো ক্ষমতার একমাত্র উৎস।
মেহনতী মানুষের মুক্তি ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই-

বকুলিঃ ওইসব তত্ত্বকথা দ্যাখো আমি বুঝি না কিছুই,
ভায়ে ভায়ে গোলমালে মজা নেয় পাড়া প্রতিবেশী,
আর সেই সুযোগের ফাঁকে ঢুকে পড়ে শত্রুপক্ষ-
আমার কেবলি ভয়, কেবলি সংশয় জেগে থাকে,
বিপদের আলামত দেখি আমি চারপাশে আজ।

গৌরবঃ আত্মীয়, স্বজন, পরিজন এসব কিছুই নয়,
শোনো, একমাত্র সত্যি হলো নীতি, আদর্শ-বিশ্বাস
আর সব প্রতারক হেঁদো মায়া, পুরোনো জঞ্জাল।

শরীরে পচন যদি ধরে, কেটে ফেলে দিতে হয়,
ক্ষত কেউ পুষে রাখে না, এটাই প্রকৃত বিধান।

বকুলিঃ গৌরব, একটা কথা বলি? অপরাধ নিও না গো,
এই গাঁর তোমরা সোনার ছেলে, জয়ী মুক্তিযোদ্ধা,
ভায়ে ভায়ে গোলমাল ভুলে যাও, গাঁয়ে ফিরে আসো।
আমি এক নষ্ট মেয়ে, তবু বলি, গাঁয়ে ফিরে আসো,
বাপদাদার বসত ভিটে হাহাকার কোরে কাঁদে।

ফিরে এসে ঘর-গেরস্থালি করা, সংসার সাজাও,
মানুষ সুন্দর তার হাতে গড়া সোনার সংসারে।

গৌরবঃ এ-সব মেয়েলি কথা, বড়ো বেশি সামন্ততান্ত্রিক,
বড়ো বেশি গৃহ-কাতরতা মাখা, ঠাসা কুঁড়েমিতে।
আমার সংসার হলো সংগ্রামের বিশাল দুনিয়া,
লড়ায়ের মাঠ হলো আমার পরম গেরস্থালি।

সাম্যমন্ত্রে উৎসর্গ করেছি আমি আমার জীবন,
আমার সংসার নেই ঘর নেই, নেই পরিজন।
মেহনতী মানুষের মুক্তির পতাকা হাতে নিয়ে
আমি আজ তছনছ কোরে চলি শত্রুর শিবির,
বিপ্লবের আগুন ছড়িয়ে দিই গ্রাম থেকে গ্রামে।

আত্মা থেকে আত্মায় ছড়িয়ে পড়া সে-অগ্নিশিখায়
পুড়ে পুড়ে খাঁটি হব, খাঁটি হবে সমগ্র স্বদেশ।
শোষকের রক্ত দিয়ে তিলক আঁকবে আমাদের
জননী, বধূরা। হবে রক্ত হোলি, হত্যার উৎসব।

বকুলিঃ মাগো, ভয়ে হাত পা সেঁধিয়ে যায় পেটের ভেতর।
এ কি কথা বলো তুমি! এ কি সব তোমার কল্পনা?
শুনে মনে হয় এ বুঝি হাবিয়া দোজখের কথা-

এঙ্গে রক্ত, এত মৃত্যু, এতো কষ্ট, নির্যাতন শেষে
সবুজের মধ্যে আঁকা লালসূর্য পতাকা উড়িয়ে
তোমরা ফিরলে গাঁয়ে, জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু
ধ্বনি দিতে দিতে, এই তো সেদিন, সেদিনের কথা।
যুদ্ধের ঘা শুকোয়নি, আজো মায়েদের চোখ ভেজা,
কোল খালি, পোড়া ভিতে এখনো ওঠেনি সব ঘর,
এরি মধ্যে আবার যুদ্ধের কথা বলছে তোমরা!

গৌরবঃ যুদ্ধ ছাড়া মানুষের অন্য কোনো পথ খোলা নেই,
কখনো সে যুদ্ধ হয় প্রকৃতির সাথে, কখনো বা
নিজেদের মধ্যে জেগে ওঠা খল পশুত্বের সাথে।
অস্তিত্বের যুদ্ধে যায় মানুষের প্রতিটি দিবস-

রূপবানঃ বুবু, রিলিফের ক্যাম্পে গেছিলাম আজ, চেয়ে দ্যাখো
কি সুন্দর শাড়ি দিছে একখান জমাট বুননি,
দ্যাখো, টিয়েবোড়া সাপের মতোন কি বাহারি রঙ!
চাল দেয় নাই, দিছে গম। কয়, চাল নাই, শেষ।
শেষ তো হবেই সব গেছে নেতাদের বাড়ি বাড়ি।
খাটাশ আটার রুটি খেয়ে আর পারি না লো বুবু-
পেটের পোলাডা বোধহয় শুকায়ে মরেছে পেটে,
নড়ে না চড়ে না, কাল মেরে পড়ে থাকে প্যাটখান।

ওমা! এ দেখি গৌরব দাদা, কখন এসেছে গাঁয়ে?
ভালো আছো? কত কথা শুনি মানুষের মুখে মুখে-

গৌরবঃ থাক, থাক, মানুষের কথা থাক, তুমি ভালো আছো?

যুদ্ধের জ্বলন্ত স্মৃতি সাথে নিয়ে ঘোরো প্রতিক্ষন,
মাঝে মাঝে মনে হয়- কথাটা জানায়ে রাখি আজ,
তোমার সন্তান হলে তার নাম রেখো স্বাধীনতা।
তুমি হবে সেই গরবিনী মহান জন্মদাত্রি-

রূপবানঃ কী যে কও তুমি! খানেদের বাচ্চা পেটে নিয়ে ঘুরি,
কতো আকথা কুকথা কথা কয় লোকে মুখের উপর।।
গেরস্তবা দূর দূর করে, কোথাও আশ্রয় নেই-

গৌরবঃ সেকি কথা! কে তোমারে গাল দেয়, কোন বানচোত?
অপবাদ দেয় কারা, বলো, তাদের কলিজা ছিঁড়ে
আমি বাজারের কুত্তা দিয়ে খাওয়াবো সত্যি সত্যি,
কসায়ের ছুরি দিয়ে কেটে নেবো সবটুকু জিভ।
স্বাধীন স্বদেশে যদি বীরাঙ্গনার লাঞ্ছনা হয়
তবে তার উপযুক্ত শাস্তি দিতে কাঁপবে না হাত।

রূপবানঃ ওইসব কথা থাক, মেনে নিছি কপালের লেখা।
কিছুতে কিছুই আর হয় না এখন, চেয়ে চেয়ে
শুধু দেখি, শুধু শুনে যাই পিছে ফিরে তাকাই না।
নীল ফেরেস্তারাও এখন আর ডাকে না আমায়
দুনিয়ার ফেরেস্তারা ডাকে আজ বেহায়া জবানে।

ঠিক আছে সন্তানের নাম আমি থোবো স্বাধীনতা।
হায় স্বাধীনতা! স্বাধীনতা! বলো একি স্বাধীনতা?

পুলিশঃ এক চুল নড়বে না কেউ, ফেলে দাও অস্ত্রপাতি,
এতোদিনে পেয়েছি তোমাকে আমি হাতের মুঠোয়।
এলাকার পাঁচ পাঁচজন গন্যমান্য বড়োলোক
হত্যা করেছে, হত্যা করেছে মুক্তিযোদ্ধা রাখালকে।
খুনি ডাকাত এবার তোর পালা, শালা শয়তান-

রূপবানঃ না, না, ওকে আটকাতে চেও না তোমরা, ছেড়ে দাও,
ছেড়ে দাও ওকে, ওযে আমাদের লোক- উহ্ মাগো-

পুলিশঃ মুহূর্ত বিলম্ব নয়, যেতে হবে এখনি সদরে।
ওহ্! নয় মাস দালালির অভিযোগে আজো আমি
কোনঠাসা হয়ে আছি, এতোদিনে এসেছে সুযোগ।
চাই কি পেয়েও যেতে পারি প্রমোশন এইবার-

গৌরবঃ একজন বিপ্লবীকে বন্দী কোরে কোনো লাভ নেই,
হাজার হাজার, তরুনের হৃদয় জ্বলছে আজ।
সে-আগুনে পুড়ে খাক হয়ে যাবে সকল শোষক,
স্বৈরাচারি সব জুলুম, বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক-
জয়, মেহনতী মানুষের জয়-

পুলিশঃ চল শালা, বিপ্লব পাছায় ঢোকাবো এবার, চল-

রূপবানঃ ওকে ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও- উহ্ মাগো, আ-আ

বকুলিঃ হায়, হায়, একি হলো! রক্তে ভেসে যাচ্ছে, এতো রক্ত!

৭. ক্ষমা পর্বঃ

আক্কেলঃ আল্লাহ মেহেরবান, তার ইচ্ছা ছাড়া দুনিয়ায়
হয় না কিছুই, নড়ে না গাছের পাতা। শুকরিয়া
তারই ইচ্ছায় আজ পেয়ে গেছি সাধারন ক্ষমা।
হেহ্ ক্ষমা! ক্ষমা? তুই কে রে ব্যাটা ক্ষমা করবার?

গেরামের খবর কি? ভালো তো সবাই? ঘরবাড়ি
ঠিকঠাক আছে সব? কোলাচের ধানের খবর
জেলে বোসে পেয়েছি সবই জানের ছাদকা, যাক-
এলাকায় সবাইরে খবর পাঠাও, শুক্রবারে
বাদ জুমা আমার কাচারি ঘরে আসবে সবাই।
সকলের দোয়া চাই, নির্বাচনে দাঁড়াবো এবার।

কবিঃ সাধারন ক্ষমা পেয়ে ফিরে এলো আক্কেল মোড়ল,
আর হত্যা, অস্ত্র মামলায় গৌরব গ্রেপ্তার হলো।
পুলিশের বুটের লাথিতে উঠোনে ছিটকে পড়ে
গর্ভপাত ঘটলো রূপবানের। ধুলো, মাটি, রক্তে
মুখ থুবড়ে থাকলো তার অপরিপূর্ন সন্তান;

যার নাম স্বাধীনতা রাখা হবে ভেবেছিলো ওরা-
জন্মের আগেই মারা গেলো অভাগার স্বাধীনতা।

(২২.০৬.১৯৯৭ রাজাবাজার, ঢাকা)