পাখিদের কথা ভেবে ডানা মেলে দিই

১.
সে সময় ছিলো, আজো সে সময় বড়ো বেশি সুসময়-
দু’চুমুক খাওয়া কফির পেয়ালা অপেক্ষা কোরে থাকে,
দু’জনের হাতে কড়া সিগারেট পোড়ে জীবনের মতো,
একটি টেবিলে দুই মহাদেশ মেলে ধ’রে পরিচয়।

আলো আর ছায়া ঘরখানা জুড়ে ওড়ে প্রজাপতি যেন,
দুইটি নিরব উপস্থিতির যেন করে পরিমাপ।
স্বপ্ন দ্যাখার পথ খুঁজে খুঁজে দুইজনে আসি ফিরে,
দুইটি হৃদয়ে ভিন্ন ভাষায় স্বপ্নেরা বোনে বাসা।

যেন মাকড়শা, যেন বা তা জাল, আটকে ফেলতে চায়।
বন্ধন মানে তবে কি শুধুই কারাগার শৃংখল?
পাখির জীবন তবে কি সত্যি হবে না মানবপুরে?
হবে না কখনো স্বাধীন, যেমন আদিম জীবনে ছিলা?

অর্ধেক খাওয়া কফির পেয়ালা অপেক্ষা কোরে থাকে,
দু’আঙুলে জ্বলে হাত বদলের চিরপবিত্র ধুন।

২.
তারাদের সাথে কি কথা তোমার? নক্ষত্রের চোখে
যে ছবি দেখবে, ছোঁবে যে প্রবল বাসনার বাঁকা স্রোত,
তা কি শুধু স্বপ্নই থেকে যাবে হবে না জীবনরেখা?

না-ও হতে পারে। কেন না বুঝেছি শুধু এ-মাংশ, হাড়,
এই ত্বক, জিভ, মানবীয় জট, অন্ত্র, পাকস্থলি-
এই শেষ নয়, বুঝেছি বিশদ, এই সব নয়, আরো
আছে এক গাঢ় গভীর আগুন, অথবা শীতল শিলা
অভ্যন্তরে আছে শ্মশানের অগ্নির মতো জেগে,
প্রচুর নিরবে প্রকাশিত তার বিপুল চঞ্চলতা।

৩.
চা, না কফি, হাই? স্মৃতি, না স্বপ্ন, কোথায় মেলেছো পাখা?
সুদূরের কোন পাহাড়বাসীর অবাক বাঁশির সুর
টেনে নিয়ে যায় গৃহকোন থেকে, চোখে ভেসে ওঠে নীল,
চোখে ভেসে ওঠে ঝলোমল নদী পাথর ছড়ানো কূলে।

শুয়ে আছে যেন সবুজ পাহাড়ে রেশমের মতো ঘাসে-
চোখে কি স্বপ্ন? না স্মৃতির খুব গহনে তলিয়ে আছো?
নাকি তুমি ওই পাহাড়ি বাঁশির সুর হয়ে গেছে নিজে।
আমি শুয়ে আছি সবুজ পাহাড়ে রেশমের মতো ঘাসে।

৪.
চা, না কফি, নাকি অবিরল এই স্বপ্ন-আরক পান?
স্বপ্ন-নেশায় বুদ হয়ে থাকা সন্ধার সীমানায়
পাখি হতে চেয়ে আক্ষেপে পোড়ে মানবদেহের খাঁচা
খাঁচা খুলে যদি একবার ওড়া যেতো আকাশের নীলে!
যদি ছোঁয়া যেতো নক্ষত্রের সোনালি আলোর দেহ!

পাখি হয়ে যাই, অথচ খুলতে পারি না দেহের খাঁচা,
ডানা ঝাপটাই অভ্যন্তরে স্বপ্নের ডানা নাড়ি।

৫.
ছুঁয়ে দিলে যদি মনে হয় তারে শুধুই মাংশ, ত্বক,
শুধুই শরীর, শুধু এক বুনোউল্লাস মাখা তনু।
যদি মনে হয় দেহের অতীত কিছু নেই কোনোখানে,
দেহহীন কিছু কখনো মানুষ পায়নি নিজের কাছে।

বস্তুর সাথে মিশেছে শক্তি, পাথর এবং প্রাণ
অনাদিকালের ধারায় করেছে নির্মান বিনিময়।

৬.
বলা ভালো এরে উন্মোচনের প্রাথমিক সরলতা,
পাখিদের কথা মনে রেখে ভাবা ভালো আকাশের রঙ।
কেননা আকাশ চিরকাংখিত, চিরকাংখিত ডানা,
রুপোলি একটি পালকের খোঁজে কেটে গেছে শৈশব,
কেটে গেছে ঘোর রৌদ্রের দিন ডানাহীন, প্রান্তরে।

তাহলে কি শুধু ছায়া খুঁজে ফেরা সৌর সীমানা জুড়ে!
তাহলে কি শুধু বৃক্ষের ডাল বনে বনে খুঁজে ফেরা!

কেন ছায়া চাই? রৌদ্রের খুব মুখখামুখি যদি হোই,
যদি সূর্যের সোনালি শিখায় ঝলসায় এই ত্বক,
সেই তো শোভন। তাই ফুটে থাকি সূর্যের বিপরীতে
সূর্যমুখীর পাপড়ির মতো সুতীব্র অভিলাষ।

৭.
চা, না কফি, না, না- এখন ওসবে নাগাল পাবে না খুঁজে,
মগজের চৌরাস্তা এখন কোলাহলময় নদী।
অন্য তৃষ্ণা কথা বলে খুব রক্তের নির্জনে,
অন্য হৃদয়, অন্য আঙুল, অন্য একটি চোখ
তাকায় তুমুল চোখের ভেতর ভেতর-চোখের দিকে।।

২১.০৫.১৯৯৭ ধানমণ্ডি ঢাকা