গোপালের পড়া

দুপুরের খাওয়া শেষ হইতেই গোপাল অত্যন্ত ভালোমানুষের মতন মুখ করিয়া দুই-একখানা পড়ার বই হাতে লইয়া তিনতলায় চলিল। মামা জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি রে গোপ্‌লা, এই দুপুর রোদে কোথায় যাচ্ছিস?” গোপাল বলিল, “তিনতলায় পড়তে যাচ্ছি।”

মামা- “পড়বি তো তিনতলায় কেন? এখানে বসে পড়-না।”

গোপাল- “এখানে লোকজন যাওয়া আসা করে, ভোলা গোলমাল করে, পড়বার সুবিধা হয় না।”

মামা- “আচ্ছা, যা, মন দিয়ে পড় গে।”

গোপাল চলিয়া গেল, মামাও মনে মনে একটু খুশি হইয়া বলিলেন, “যাক, ছেলেটার পড়াশুনোয় মন আছে।”

এমন সময়ে ভোলাবাবুর প্রবেশ- বয়স তিন কি চার, সকলের খরব আদুরে। সে আসিয়াই বলিল, “দাদা কই গেল?” মামা বলিলেন, “দাদা এখন তিনতলায় পড়াশুনো করছে, তুমি এইখানে বসে খেলা কর।”

ভোলা তৎক্ষণাৎ মেঝের উপর বসিয়া প্রশ্ন আরম্ভ করিল, “দাদা কেন পড়াশানো করছে, পড়াশুনো করলে কি হয়? কি করে পড়াশুনো করে?” ইত্যাদি। মামার তখন কাগজ পড়িবার ইচ্ছা, তিনি প্রশ্নের চোটে অস্থির হইয়া শেষটায় বলিলেন, “আচ্ছা ভোলাবাবু, তুমি ভোজিয়ার সঙ্গে খেলা কর গিয়ে, বিকেলে তোমায় লজেঞ্চুস এনে দেব।” ভোলা চলিয়া গেল। আধঘণ্টা পরে ভোলারামের পুনঃপ্রবেশ। সে আসিয়াই বলিল, “মামা, আমিও পড়াশুনো করব।” মামা বলিলেন, “বেশ তো, আরেকটু বড় হও, তোমায় রঙচঙে সব পড়ার বই এনে দেব।”

ভোলা- “না, সেরকম পড়াশুনো নয়, দাদা যেরকম পড়াশুনো করে সেইরকম।”

মামা- “সে আবার কিরে?”

ভোলা- “হ্যাঁ, সেই যে পাৎলা পাৎলা রঙিন কাগজ থাকে আর কাঠি থাকে, আর কাগজে আঠা মাখায় আর তার মধ্যে কাঠি লাগায়, সেইরকম।”

দাদার পড়াশনার বর্ণনা শনিয়া মামার চক্ষুস্থির হইয়া গেল! তিনি আস্তে আস্তে পা টিপিয়া টিপিয়া তিনতলায় উঠিলেন, চুপি-চুপি ঘরের মধ্যে উঁকি মারিয়া দেখিলেন তাঁহার ধনুর্ধর ভাগ্নেটি জানালার সামনে বসিয়া একমনে ঘড়ি বানাইতেছে। বইদুটি ঠিক দরজার কাছে তক্তাপোষের উপরে পড়িয়া আছে। মামা অতি সাবধানে বই দু-খানা দখল করিয়া নীচে নামিয়া আসিলেন।

খানিক পরেই গোপালচন্দ্রের ডাক পড়িল। গোপাল আসিতেই মামা জিজ্ঞাসা করিলেন- “তোর ছুটির আর কদিন বাকি আছে?”

গোপাল বলিল- “আঠারো দিন।”

মামা- “বেশ পড়াশুনো করছিস তো? না কেবল ফাঁকি দিচ্ছিস?”

গোপাল বলিল- “না, এই তো, এতক্ষণ পড়ছিলাম।”

মামা- “কি বই পড়ছিলি?”

গোপাল- “সংস্কৃত।”

মামা- “সংস্কৃত পড়তে বঝি আজকাল বই লাগে না? আর অনেকগুলো পাৎলা কাগজ, আঠা আর কাঠি নিয়ে নানারকম কারিকুরি করার দরকার হয়?”

গোপালের তো চক্ষু স্থির! মামা বলে কি? সে একেবারে হতভম্ব হইয়া হাঁ করিয়া মামার দিকে তাকাইয়া রহিল। মামা বলিলেন- “বই কোথায়?”

গোপাল বলিল- “তিনতলায়।”

মামা বই বাহির করিয়া বলিলেন- “এগুলো কি?”

তাহার পর তাহার কানে ধরিয়া ঘরের এক কোণে বসাইয়া দিলেন। গোপালের ঘুড়ি, লাটাই, সুতো ইত্যাদি সরঞ্জাম আঠারো দিনের জন্য মামার জিম্মায় বন্ধ রহিল।

সন্দেশ-১৩৩০