পাজি পিটার

শহরের কোণে মাঠের ধারে এক পুরানো বাড়িতে পিটার থাকত। তার আর কেউ ছিল না, খালি এক বোন ছিল। পিটারকে সবাই বলত ‘পাজি পিটার’ – কারণ পিটার কোন কাজকর্ম করে না- কেবল একে ওকে ঠকিয়ে খায়। পিটার একদিন ভাবল ঢের লোক ঠকিয়েছি- একবার রাজাকে ঠকানো যাক। এই ভেবে সে রাজবাড়িতে গেল।

রাজা বললেন, ‘তুমি কে হে? মতলবখানা কি?”

পিটার বলল, “আজ্ঞে, আমি পিটার- ঠকাবার জন্য লোক খুঁজছি।”

রাজা বললেন, “তাই নাকি? লোক খুঁজবার দরকার কি? আমাকের একবার ঠকিয়ে দেখাও না।” পিটার মাথা চুল্‌কাতে লাগল- বলল, “তাই ত’, আমার সরঞ্জাম সব বাড়িতে ফেলে এসেছি।” রাজা বললেন, “বেশ ত’, তোমার সরঞ্জাম সব নিয়ে এস।” পিটার তাই শুনে ভয়ানক খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে লাগল, আর বলল, “দোহাই মহারাজ, অত হাঁটাহাঁটি করলে আমি মরেই যাব।” রাজা বললেন, “তবে এই ঘোড়াটায় চড়ে যা- দেরী করিস নে।” পিটার চিৎকার করতে লাগল, “ও ঘোড়ায় আমি চড়ব না- ঘোড়া আমায় ফেলে দেবে।” কিন্তু সে কথা কেউ শুনল না, তাকে জোর করে ঘোড়ায় চড়িয়ে দেওয়া হল। পিটার ঘোড়াটাকে আস্তে আস্তে মোড়ের কাছে নিয়ে গিয়ে- যেই একটু আড়াল পেয়েছে, অমনি ঘোড়া ছুটিয়ে একেবারে শহরের বাইরে উপস্থিত। সেখানে সাজ-সরঞ্জামশুদ্ধ ঘোড়াটাকে বিক্রি করে, সে পকেটভরা টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরল। এদিকে রাজা-উজির পাত্র-মিত্র সভায় বসে- পিটার আসে না, আসে না- এলই না- রাজামশাই বাইরে খুব হাসলেন- বললেন, “ছেলেটা বেজায় চালাক”- কিন্তু মনে মনে ভারি চটলেন। একদিন পিটার দেখতে পেল মাঠের উপর দিয়ে জমকালো পোশাক পরে ঘোড়ায় চড়ে তলোয়ার হাতে কে যেন আসছে। পিটার বলল, “এই মাটি করেছে! রাজা আসছে।” পিটার দৌড়ে তার বোনকে বলল- “ভাতের হাঁড়িটা উনুনে চড়িয়ে দাও- ফুট্‌তে থাকুক।” এই বলে সে একখানা ভাঙা শিলের উপর হিজিবিজি কি-সব লিখতে বসল। তারপর যেই রাজামশাই তার বাড়ির সামনে এসেছেন, অমনি সে ফুটন্ত ভাতের হাঁড়িটাকে সেই শিলের উপর বসিয়ে বিড়্‌ বিড়্‌ করে কি-সব বলতে বলতে ভাতটাকে কাঠি দিয়ে নাড়তে লাগল। রাজামশাই বললেন, “এ আবার কি?” পিটার বলল, “আজ্ঞে ভাত রাঁধছি।” রাজা বললেন, “সে কি রে? তোর আগুন কই?” পিটার জোড়হাতে বলল, “মহারাজ, আমরা গরিব মানুষ, আগুন-টাগুন কোথায় পাব? সন্ন্যাসী ঠাকুর এই পাথরখানা দিয়েছেন, আর দুটো মন্ত্র শিখিয়ে দিয়েছেন, তাতেই আমাদের রান্না চলে যায়।”

রাজা বললেন, “দে, ওটা আমায় দে- তোকে আমি মাপ করে দিচ্ছি।” পিটার কাঁদতে লাগল, দেখাদেখি তার দুষ্টু বোনটাও কাঁদতে লাগল। রাজা বললেন, “অত কান্নাকাটির দরকার কি? আমি তো কেড়ে নিচ্ছি না, দাম দিয়ে নিচ্ছি। এই নে!” বলে তিনি একমুঠো মোহর ফেলে দিলেন। তখন পিটার তাঁকে একটা যা-তা মন্ত্র শিখিয়ে দিল।

রাজামশাই সেই শিলখানা নিয়ে বাড়ি গেলেন। গিয়ে সকলকে বলে পাঠালেন, “কাল সকালে তোমাদের এক আশ্চর্য ভোজ খাওয়াব।” সকাল না হতেই মন্ত্রী উজির কোটাল সকলে আশ্চর্য ভোজ খাবার জন্য রাজবাড়িতে হাজির। রাজামশাই সেই পাথরটিকে ঘরের মধ্যে বসিয়ে তার উপর প্রকাণ্ড হাঁড়ি চাপালেন, আর পোলাওয়ের চাল, ঘি, মাংস, মসলা সব তার মধ্যে দিয়ে গম্ভীরভাবে মন্ত্র পড়তে লাগলেন। পাঁচ মিনিট গেল, দশ মিনিট গেল, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে গেল, পোলাও আর হল না। সকলে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। রাজামশাই রেগে ঘেমে লাল হয়ে উঠলেন। শেষটায় তিনি লাফিয়ে উঠে কাউকে কিছু না বলে এক তলোয়ার হাতে আবার ঘোড়ায় চড়ে পিটারের বাড়ি ছুটলেন। মনে মনে বললেন, ‘এবারে আর পাজি পিটারকে আস্ত রাখছি নে।’

দূর থেকে রাজাকে দেখেই পিটার এক দৌড়ে শোবার ঘরে গিয়ে লেপমুড়ি দিয়ে শুয়ে রইল। তার বোনকে সে আগে থেকেই সব শিখিয়ে রেখেছিল-সে করল কি একটা খরগোস কেটে তার রক্ত দিয়ে একটা থলি ভরে সেই থলিটা বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখল।

রাজা ঘরে ঢুকেই জিজ্ঞাসা করলেন, “পিটার কই? তাকে শিগ্‌গির ডাক।” পিটারের বোন বলল, “দোহাই মহারাজ, পিটার এখন ঘুমুচ্ছে- সে ভয়ানক রাগী লোক, এখন জাগাতে গেলে আমায় মারবে।” রাজা বললেন, “কিছু ভয় নেই- আমি আছি।”

পিটারের বোন পিটারকে ডাকতে গেল। খানিক বাদেই একটা চিৎকার গর্জনের মত শোনা গেল, রাজা দৌড়ে গিয়েই দেখেন পিটার একটা ছুরি নিয়ে তার বোনকে মারল আর সে বেচারা ঠিক যেন মড়ার মত পড়ে গেল- রক্তে তার কাপড় লাল হয়ে গেল। রাজা বললেন, “তবে রে পাজি পিটার, তোর বোনটাকে শুধু-শুধু মেরে ফেললি?”

পিটার বলল, “মহারাজ, এক মিনিট সবুর করুন।” এই বলে সে একটা ভাঙা শিঙের বাঁশি নিয়ে তার বোনের চোখে মুখে ফুঁ দিতে লাগল। এক মিনিটের মধ্যে মেয়েটা চোখ মেলে বড়-বড় দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে উঠে বসল। রাজা তো অবাক! তিনি বললেন, “এই শিঙেটা আমায় দিতে হবে।” পিটার কাঁদতে লাগল- বলল, “দোহাই মহারাজ, ওটা না হলে আমাদের চলবে কেমন করে?” দেখাদেখি বোনটাও কাঁদতে লাগল, “এবার আমি মারা গেলে কি করে বাঁচাবে? দোহাই মহারাজ, পিটারের মেজাজ ভয়ানক।” রাজা বললেন, “আমার মেজাজ তার চাইতেও ভয়ানক- তোদের যে মেরে ফেলি নি এই ঢের- এই নে- ” বলে এক মুঠো মোহর ফেলে দিলেন।

রাজা বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভাবলেন, ‘এবার যার উপর রাগ করব- একেবারে তলোয়ারের কোপ বসিয়ে দেব।’ বাড়ি ফিরে দেখেন- নিমন্ত্রিত লোকেরা তখনো আশ্চর্য ভোজ খাবার আশায় বসে আছেন। মন্ত্রী বললেন, “মহারাজ, আহারের অন্য বন্দোবস্ত করতে বলব কি?” রাজা বললেন, “কি, এত বড় কথা! আমি করছি একরকম বন্দোবস্ত, তুমি করবে অন্য রকম?” বলেই মন্ত্রীর মাথায় এক কোপ বসিয়ে দিলেন। উজির নাজির কোটাল সব হাঁ-হাঁ করে উঠতেই রাজা ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ করে তাদেরও মাথা কেটে দিলেন। চারিদিকে হুলুস্থূল পড়ে গেল। রাজা বললেন, “ভয় নেই, তোমরা এখন মজা দেখ।” বলে তিনি শিঙেটা মন্ত্রীর মুখের কাছে নিয়ে ফুঁ দিতে লাগলেন। কিন্তু ফুঁ দিলে হবে কি- মরা মানুষ কি আর বাঁচে?

তখন রাজার হুকুমে পেয়াদা পুলিশ দৌড়ে গিয়ে পিটারকে ধরে আনল। একটা মজবুত বাক্সের মধ্যে তাকে বন্ধ করে সেই বাক্স মোটা দড়ি দিয়ে বাঁধা হল। রাজা বললেন, “পাজি পিটার- তোমার শাস্তি শোন- এই বাক্সে ভরে তিন দিন তিন রাত্রি তোমাকে ঐ পাহাড়ের উপর রাখা হবে। সেখানে রোদে পুড়ে হিমে ভিজে তুমি তোমার দুষ্টুমির কথা ভাববে- তারপর তোমাকে এই পাহাড় থেকে একেবারে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হবে।”

পিটার বললে, “আহা, মহারাজের দয়ার শরীর।” পাহাড়ের আগায় বাক্সের মধ্যে শুয়ে পিটার মনে মনে ভাবছে, ‘এখন উপায়?’ আর মুখে চিৎকার করে গান করছে-
‘ধিন্‌ তাধিনা তাধেই ধেই-
স্বর্গে যাবার রাস্তা এই’-

এমনি করে দুদিন গেল। তিন দিনের দিন এক বুড়ো বিদেশী সওদাগর সেখানে এল। সে বেচারা তীর্থ করতে বেরিয়েছে, পিটারের গান শুনে ব্যাপারটা কি দেখতে এল। সওদাগর বলল, “তুমি কে ভাই? স্বর্গের রাস্তার কথা বলছিলে?” পিটার বলল, “আরে চুপ- কাউকে বোলো না, তাহলে স্বর্গে যাবার জন্য কাড়াকাড়ি পড়ে যাবে- মাঝে থেকে আমার স্বর্গে যাওয়া মাটি হবে।” সওদাগর বলল, “ভাই, তুমি একা যাবে কেন? আমায়ও একটু পথ বাত্‌লে দাও না।” পিটার বলল, “সকলের কি তা সম্ভব হয়? এই বাক্সকে মন্ত্র পড়ে এখানে রাখা হয়েছে-  যেমন-তেমন বাক্স হলে হবে না; আজ রাত্রের শেষে স্বর্গের দূত এসে আমায় নিয়ে যাবে। আবার যে-সে দিন হবে না- এমনি তিথি, এমনি বার, এমনি মাস, এমনি নক্ষত্র সব মেলা চাই- এরকম সুযোগ হাজার বছরে একদিন হয়।” সওদাগর বলল, “ভাই আমি বুড়ো হয়েছি, কবে মরে যাই তার তো ঠিক নেই- আমার টাকাকড়ি ঘরবাড়ি সব তোমায় লিখে দিচ্ছি। তুমি আমায় ও বাক্সটা দাও- আমি স্বর্গে যাই।” পিটার বলল, “খবরদার, আমি ছেলেমানুষ বলে আমায় টাকার লোভ দেখিও না।” বুড়ো কাঁদতে লাগল; অনেক মিনতি করে বলতে লাগল, “এই বুড়ো বয়সে তীর্থ ঘুরে কতটুকু আর পুণ্য হবে- এখন না হলে আর আমার স্বর্গে যাবার আশা নেই।” তখন পিটার রাজি হল।

বাক্স খুলে বুড়ো তার মধ্যে ঢুকল, পিটার তার কাছ থেকে বিষয় সম্পত্তি লিখিয়ে নিয়ে বাক্সটা আবার দড়ি দিয়ে বেঁধে দিল। যাবার সময় বলে গেল, “রাত্রের শেষে স্বর্গের দূত আসবে, তখন কিন্তু টুঁ শব্দটি করবে না। তা হলেই আর স্বর্গে যাওয়া হবে না।”

রাত্রে রাজামশাই শান্ত্রী নিয়ে বাক্সটা নেড়েচেড়ে সমুদ্রে ফেলে দিলেন। রাজা ভাবলেন, ‘আপদ গেল।’ দুদিন বাদে রাজা বেড়াতে বেরিয়েছেন- এমন সময় পাজি পিটার জমকালো পোশাক পরে ধব্‌ধবে সাদা ঘোড়ায় চড়ে এসে সেলাম করে বলল, “মহারাজ আমায় সমুদ্রে ফেলে বড়ই উপকার করেছেন। আহা! সমুদ্রের তলায় যে দেশ আছে- সে বড় চমৎকার জায়গা। আর লোকেরা যে কি ভালো, তা আর কি বলব- আমায় কি ছাড়তে চায়? আসবার সময় থলে ভরা কেবল হীরে মণি মুক্তো সঙ্গে দিল।” এই বলেই সে চম্পট দিল।

রাজামশাই হাঁ করে রইলেন। রাজামশাই জানতে চান সমুদ্রের তলাটার কথা! পাজি পিটার যা বলেছে তা সত্যি কিনা- তা হলে তিনি একবার দেখে আসেন।

সন্দেশ-১৩২১