পুরীর চিঠি

ধূ ধূ বালির বিথার যেথা মিলায় পারাবারে
আমি এখন রয়েছি সেই পাতাল-পুরীর দ্বারে।
সমুখে নীল জলের রাশি নেই কিনারা কূল,-
ফোটেনা এই কালীদহে রাঙা কমল ফুল।
হীরাকষের কষ মেতেছে তুঁতের রসে রসি’
গড়ায় যেন বিশ্বলোকের ললাট-লিপির মসী।
আসমানী নীল রঙের সাথে জলঙ্গা নীল মেশে,-
জগৎ যেন মিলিয়ে যাবে প্রলয়-মেঘের দেশে!

নীল কাজলের তুলি আমার চোখে বুলায় কে রে!
যে দিকে চাই নিবিড় নীলে নয়ন আসে ভেরে!
মায়া-কাজল মন্ত্র-পড়া ভুল কিছু নেই তায়,-
মায়া-ভুবন মুক্ত হেরি আমার ডাহিন বাঁয়।
পাতাল-পুরীর সিং-দরজায়, উছল ঢেউয়ের পাশে,
ময়াল-সাপের হুড়কা ঠেলে নাগবালারা আসে;
মুক্তা-ঘেরা ঘোম্টা তুলে চোখ্ মেলে যেই তারা,
ভেঙে পড়ে বেলোয়ারী ঢেউ- ফেনা ফটিক-পারা।

* * *

ফেরৎ ঢেউয়ের পথ আগুলে দাড়ায় বাঘা ঢেউ,
সাপ্টে তিমি গিল্তে পারে এম্নি বৃহৎ কেউ!
বলের গর্ব্বে পর্ব্বে পর্ব্বে সাগর ওঠে ফুলে
দিগ্ দিগন্তে অঙ্গ মেলে অট্টহাসি তুলে!-
সরিৎ-পতির হস্তামলক স্তব্ধ বসুন্ধরা,
তিমি-গেল তিমিজিলা আতঙ্কে আধমরা।-
চৌদ্দ মাদল বাজে হঠাৎ,- হৃদয় ওঠে মেতে,-
হরধনুর্ভঙ্গ-খেলা ভঙ্গ-তরঙ্গেতে।

* * *

দক্ষিণের এই দ্বারে স্বয়ং মৃত্যু আছেন বুঝি
চারদিকে তাই যমের মহিষ ঢেউয়ের যোঝাবুঝি,
চারদিকে তাই হাপর চলে, কঁপর হ’য়ে দেখি,
চারদিকে তাই মাথা কোটে স্বর্গলোভী ঢেকি!
ঢেউয়ের পরে ঢেউ চলেছে- শুধু ঢেউয়ের মেলা,
ঢেউয়ের সাথে তলায় কত সাগরিকার ভেলা।
কঙ্কাবতীর নৌকাটি- তাও- এড়ায়নি এই চোখ,-
নেবু-ফুলের ডোর-জড়ানো গলুইটা ইস্তক!

* * *

লাখ্ হাতীর ওই হাল্কা বেয়োয় কার শোভা-যাত্ৰাতে?
বরুণ-পুরীর বাড়ব-ঘোড়া ছুটছে সাথে সাথে!
এরাই বুঝি বাঁধা ছিল কপিল-গুহা-তলে
ছাড়া পেয়ে ছুটল হঠাৎ ঘুণ্টি-মালা গলে!
কোন্ দিকে ধায় নেই ঠিকানা, ঠিক লেগেছে ‘ভুলো’
ভিড় করে তার পিছন নেছে দ্রবিড় কতকগুলো!
ক্ষুদ্র প্রাণীর প্রাণান্ত হয় তরঙ্গ-সঙ্কটে,-
জলোকা আর সঙ্কটা মাছ আছড়ে পড়ে তটে।

* * *

কতই কথা লিখছে সাগর, লিখছে বারো মাস,
উতলা ঢেউ লিখছে সাগর-মথন-ইতিহাস;
দেখছি আমি মুহুর্মুহু জাগছে দিকে দিকে
সাপের রশি সাপের ফণা চিহ্নিত স্বস্তিকে;
উঠছে সুধা, ফুটছে গরল; যাচ্ছে যেন চেনা
আঢ়ক-হাতে লক্ষ্মী!- সাথে লক্ষ্মী-কড়ি ফেনা।
ছন্দে ওঠে মন ভালো;- চল্ছে অভিনয়
দেবাসুরের দ্বন্দ্ব-লীলা দুরন্ত দুর্জ্জয়।

* * *

ঝড়ের বেগে ঝাণ্ডা নিশান ওঠে এবং পড়ে
নীল-জাঙিয়া নীল আঙিয়া অসুরগুলো লড়ে!
হঠাৎ হ’ল দৃশ্য বদল উল্টে গেল পট
ঘাঘরা ঘোরায় কোন্ মোহিনী মাথায় সোনার ঘট!
তারে ঘিরে অপ্সরীরা তয়ফা নেচে যায়
ফেনার চারু চিকণ কারু দুল্ছে পায়ে পায়।
কালীদহের কমল-কলি কালিপেটা পাখী
চরণে তার শুভ্র ফুলের অঞ্জলি দেয় আঁকি।

এই সমুদ্র- ভীষণ, মধুর;- কাছে থেকেও দূর;
জগৎ-পতির গোপন ছবির রহস্য-মুকুর।
এই তো হরি-বাসর-রাতের শয্যা সুবিস্তার,
শেয-তোলানি সোনার মোহর- উষার কিরণ-ভার।
জ্যোৎস্না-রাতে এই সমুদ্র আনন্দ-ফোয়ারা;-
কাল্-অগুরুর পাত্রে ঝরে চন্দনেরি ধারা।
ঢেউয়ের হাজার কুজা হেথায় করছে ঠেলাঠেলি
কুঁজায় সোজা করে যে তায় দেখবে নয়ন মেলি।

* * *

এই সমুদ্র বিশ্বরাজের বিমুক্ত রজপথ,
জগৎ-জয়ের শক্তি-সাধ-মার্গ সুমহৎ।
কঠোর পণের কুঠার দিয়ে মোদের ভৃগুরাম
হঠিয়ে এরে, গড়েছিলেন নগর অভিরাম!
এই সমুদ্র বশে এনে বঙ্গ-যুবরাজ
বিজয় সিংহ পরেছিলেন সম্রাটেরি তাজ।
শ্ৰীমন্ত এ পার হয়েছেন ভয়-ভাবনা ভুলে
অগস্ত্য এ পান করেছেন অঞ্জলিতে তুলে।
এই সমুদ্র,- কান্ত, রুদ্র- বিরাগ এবং স্পৃহা
অঘোর-শয়ান স্বয়ম্ভুদেব- তাঁর প্রতিমা ইহা।
এই সমুদ্র চতুর্মুখের মতন চতুরর্দ্দিকে
মারণ ঘোষে অথর্বে আর শান্তি সামে ঋকে।
এই সমুদ্র অগাধ অকুল দুরন্ত দুর্গম,-
শক্তিমানের সাঁতার-পানি, দুর্ব্বলের এই যম,-
এই সমুদ্র- গণ্ডুষে এ পান করেছি মোরা,
পার হ’তে আজ পাঁতি খুঁজি- অগস্ত্যের আব্খোরা!

এই সমুদ্র রক্ষা করে আপন বক্ষ-নীড়ে
বুদ্ধদেবের পুণ্য-পূত ভিক্ষা-পাত্রটিরে।
মৈত্রী-মন্ত্রে হ’বে যেদিন দীক্ষা সবাকার
মৈত্রেয় দেব বুদ্ধ হবেন- বিশ্বে অবতার;
যুদ্ধ যেদিন লুপ্ত হবে শুদ্ধ হবে মন
সেদিন সাগর ফিরিয়ে দেবে গচ্ছিত সেই ধন;
চতুর্মহাদেশের লোকে তুলবে বরণ ক’রে
প্রেমের কণায় রাজ-ভিখারীর পাত্রখানি ভ’রে।

* * *

এই সমুদ্র!- কুক্ষিতে এর আগুন আছে, বলে,
আমি জানি আঁধারে এর জলে জোনাক্ জ্বলে।
ভেলার আঠা অন্ধকারে জড়ায় যখন আঁখি-
ঘরে যখন ফিরেছে লোক, কুলায়-মাঝে পাখী-
তখন জলে ঢেউয়ের মালায় জলের জোনাক পোকা
তটের সীমায় চূর্ণ হীরা- নেইক লেখা জোকা!
লুটেছি সেই সাপের মাণিক ভয় করিনি ফণা
ধরেছি দুই হাতে লুফে বাড়ব-শিখার কণা।

* * *

এই সমুদ্র-খাম-খেয়ালি,- খেয়ালের এই ধাম,-
পাতাল-পুরীর দ্বারে লেখায় স্বর্গ-দুয়ার’ নাম!
এই সমুদ্র,- মুদ্রা তো ঢের,- রত্ন আছে পেটে,
পেলাম মাত্র রঙীন্ ঝিনুক- বেলার বালি ঘেঁটে।
এই সমুদ্র,- সমূহ ঘুম আছে ইহার হাতে,-
পাচ্ছি প্রসাদ যখন-তখন দিনে এবং রাতে।
এই সমুদ্ৰ কৰ্মী স্বয়ং কাজ-ভুলানোর রাজা-
ত্রিসীমায় এর যে এসেছে কাজ-ভোলা তার সাজা।
লিখ্ব কোথায় পুরীর কথা,- হ’লনা তার লেশ
সাগমের সাত কাহন কথায় পুরীর চিঠি শেষ।