পথের বর্ণনা

মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছি; সামনে দু’টি পথের বিস্তার
আপাতবিরোধী যেন ঊর্ধ্ববাহু মেলে আছে স্থির।
আমি কোন লক্ষ্যে যাবো, আমি কোন নির্দেশের দিকে
অতিরিক্ত একজন হেঁটে যাবো নিঃশঙ্কচরণ?
এ মোড়ের মধ্যস্থলে ক্ষুদ্র এক খোদিত ফলকে
অদৃষ্টলিপির মত পরস্পর বিরোধী রাস্তার
করুন কষ্টের কথা লেখা আছে কলিত পাথরে।

বামে যদি যাও তবে শোন পান্থ, বামের বিধানঃ
বড়ই ভীষণ রাস্তা ভয়ানক তৃষ্ণার সড়কে
উদ্ভিদশোষক রৌদ্র ঝরে যাবে দারুণ নিয়মে।
সারা পথে হাহাকার। ড্রাগনের নিঃশ্বাসের তেজে
আদিগন্ত বয়ে যাবে একটানা বর্বর বাতাস।
নির্জল নির্মেঘ নীল, যেন এক অনড় নিদাঘ
ক্রমান্বয়ে ঢেলে যায় মহাতপ্ত অনল কলস।
পাখি নেই, পুষ্প নেই, নেই পাতা পতঙ্গ উদ্ভিদ
পরিচিত সূর্য শুধু ধরে আছে মৃত্যুর নিশান।

বিশাল মরুর পরে অকস্মাৎ কুটিল পর্বত
অবশেষে দেখা দিলে দিগভ্রান্ত সম্মুখে তোমার
নির্ভয়ে উঠতে হবে অতিশয় অত্যুঙ্গ শিখরে।
অকম্পিত থাকতে হবে, সাবধান! মায়ার পর্বত
কেবলই কায়িক শ্রমে ক্রমাগত দুঃস্বপ্ন দেখাবে।
কঙ্কাল, কঙ্কাল শুধু, চতুর্দিকে মৃত্যুর আহার;
পাথরের তাকে তাকে পূর্বপথচারীর খুলিতে
নির্দয় বায়ুর বেগ সাংঘাতিক কর্তাল বাজায়।
অবশিষ্ট আবরণ উড়ে যায়। সম্পূর্ণ পুরুষ
উলঙ্গ উঠতে হবে অতঃপর পর্বত চূড়ায়।

শিখর বিন্দুতে গেলে বিপরীত ঢালুর সাক্ষাৎ
পাওয়া যাবে হে বিজয়ী, শান্ত স্নিগ্ধ-সুগম সিঁড়ির
ধাপে ধাপে নেমে যাবে সানুদেশে, প্রার্থিত প্রদেশে
এবং সেখানে গেলে সমতলে বক্ষের বাহার
পার হয়ে বামে যেও, দেখতে পাবে তোমার তোরণ।

দক্ষিণে কি যাবে তুমি, ডানদিকে? দারুণ দক্ষিণ-
এওতো পিচ্ছিল পথ, ঝড়ে জলে তেমনি দুর্গম।
নিষ্প্রদীপ নেমে গেলে সূর্যহীন শীতের সড়কে
দানব হাওয়ার মধ্যে অতিশয় বৃষ্টির শায়ক
প্রাগৈতিহাসিক রোষে সারা দেহে কামড় বসাবে।
বাতাস এমন যেন অবলুপ্ত হাওয়ানের দল
সর্বত্র তাড়িয়ে ফেরে। দিগ্বিদিক তাড়না তাণ্ডবে
বধির বিভ্রান্ত সব। এমন কি নিজের চিৎকার
সেখানে পশেনা কানে। ধুম্রময় দয়ালু বিদ্যুৎ
মুহুর্মুহু লেখে মৃত পূর্বপদচারীদের নাম।

সাপের দেহের মত অতিকায় পিচ্ছিল সড়ক
পার হতে পারো যদি একবার অশনি সঙ্কেতে
সহসা দেখতে পাবে সামনে এক জলের বিস্তার।
এই সে সমুদ্র দ্যাখো, যার নাম মরণপয়োধি।

কোথাও ভাসানো নেই কারো কোনো অর্ণববাহন
কেবল একটি নৌকা পড়ে আছে তীরের বালুতে
একটি সামান্য নাও, এ তরঙ্গে উপযোগী নয়।

তবুতো ভাসাতে হবে দুঃসাহসী দুঃখের ভাসান।

পাল নেই, দাঁড় নেই মস্ত কালো জলের ফানুস
অন্তহীন ফেটে যাবে অন্ধকার তোমার তরীতে।
তিমির ফোঁপানি আর কদাকার হাঙরের মুখ
জাগাবে ভয়ের ব্যাধি, বিবমিষা, সমুদ্রের রোগ।

দলবেঁধে ছুটে এলে দরিয়ার দানবের মুখে
একে একে ছুঁড়ে দিও পরিধেয় তোমার লেবাস:
নিক্ষিপ্ত কাপড় নিয়ে তরঙ্গের নির্বোধ পশুরা
পরস্পর কাড়াকাড়ি করে যাবে উত্তাল সাগরে।

হয়তো তখুনি কিম্বা তারো পরে হে নগ্ন নাবিক
মাছের পেটের মতো দেখা দেবে শাদা পূর্বদিক।
তখন দক্ষিণে দ্যাখো, সূর্যের সামান্য দক্ষিণে
সমুদ্রের সমতলে পর্বতের পাদদেশে স্থির
বন্দরের বহ্নিরেখা, কোলাহল আর সিংহদ্বার।