প্রৌঢ় প্রেম

প্রেম নবীন আমার প্রৌঢ় বয়স, প্রৌঢ় তোমার যৌবন,
তোমাতে আমাতে এক জনমের ব্যবধান।
তোমার জীবনে এখন ও ফলিত ললিতকলার রূপরস,
আমার জীবন শুধু শিল্পের উপাদান।
বৈদ্যুৎময় অণুর গণিত অদ্ভুত
কত নীহারিকা-বীথিকা কঁপায়, আঁধারে ভাসায়
কত সূর্যের অবুদ বুদ্বুদ;
সৌরলোকের ঐন্দ্রজালিক তোমার শাণিত তনিমায়
সহসা গণিতে ক্কণিত করেছে মন্ত্রে,
সংখ্যারাশিরে বেঁধেছে দারুণ ছন্দে।
তারই তরঙ্গ-রঙ্গে তোমার অঙ্গে ফুটেছে গুচ্ছ-গুচ্ছ পারিজাত,
আকাশে আলোকে ঢেলেছে ইন্দ্র লক্ষ-লক্ষ লুব্ধ চপল আঁখিপাত।
তোমার দু’ আঁখি বৈশাখী মেঘে এঁকে দিলো, যেন বাসনার বেগে
ঐরাবত আর উচ্চৈঃশ্রবা দুর্বার,
সে-আঁখিতারার তেরছা চাহনি যখনই আমারে করেছিলো তাড়া,
জেনেছি আমার নেই আর নেই উদ্ধার।
আজও আছে সেই মায়ার আভাস,
অভাবনীয় লাবণ্য,
হায় রে সে আর নয় সে আমার জন্য।
তোমার ললিত বিলোল আঁচলে, আঁচল-ঝরানো বায়ুহিল্লোলে,
আঁচিলে লুকোনো যুগল উতল উচলে,
রূপের রেখার তীক্ষ্ণ ঝলকে, পরশ-রসের উষ্ণ ছলকে
আজও লজ্জার অভিসার, আজও আতিথেয় সৌজন্য,
হায় রে সে আর নয় সে আমার জন্য।

আমার যেটুকু গৌরব আজ সৌন্দর্যের দৌত্যে,
তোমাতে মূর্ত রূপলক্ষ্মীর বরদান;
নবীন আমার প্রৌঢ় বয়স, প্রৌঢ় তোমার যৌবন,
তোমাতে আমাতে এক মৃত্যুর ব্যবধান।
বেঁচে আছো তুমি বেঁচে থাকবারই খুশিতে,
তাই-তো বিশ্ব ব্যস্ত তোমায় তুষিতে;
আছে শৈশব স্বৈরী স্ববশ অবসরে, আছে কৈশোর তব কৌতূহলের
রৌদ্র-রঙিন ঝরনায়,
আছে জীবনের সফল ফসল ব্যস্ত আঙুলে, ত্রস্ত চরণে
বিলসিত ঘর-করনায়।
আর আমি আজ বন্দী হয়েছি ছন্দোবন্ধনে,
ভাষার গুঞ্জনে;
শুক্ল-রাতের একলা জাগার অসম্ভাব্য ভাবায়,
কল্পলোকের আভায়;
আমার ভাবার ছন্দ, আমার ভাষার স্বপ্ন যদি
ঢেউ তোলে কোনো সুদূর আগামী কল্যে,
আমি বেঁচে আছি সেই কলাকৈবল্যে।
আসে যায় যারা নবীন-জীবন-বণিক,
সহজ সুখের ধনিক,
মুক্তদুয়ার উদার তোমার প্রাণের প্রাঙ্গণে
ভ্রমর-কম্পনে;
তাদের হৃদয় জ্বালায় তোমার আঁখির আগুন, আশার আকাশে
যেন উজ্জ্বল সূর্যের শিখা লেলিহান,
তাদের মুখের রেখায় কোণায় রক্তকণায় দুঃসাহসের
উচ্ছ্বাসে জাগে কলরোল;
জ্বলে আর নেবে চঞ্চল শিখা, নাচে আর থামে পলকে-পলকে ঝলমল
আবার তোমার চোখের তারায়;
আমি দূর থেকে দেখি চুপে-চুপে, দেখি সেই শিখা হঠাৎ কখন হারায়,
সজল মেঘের কোমল ছোঁওয়ায়
ছলছল করে আবেশে ছায়াচ্ছন্ন;-
তা-ই নিয়ে, শুধু তা-ই নিয়ে আমি ধন্য।
তোমার সে-চোখে বিকশিত অভিনন্দনে
বাঁধিব ছন্দোবন্ধনে,
আবেগ-লাগানো সিক্ত অধরে, আবেশ-রাঙানো রক্তকপোল,
তনুর অণুর মন্ত্রমুগ্ধ গণিতে
যদি পারি মোর ভাষার ছন্দে ধ্বনিতে,
যদি তার রূপ ধ’রে দিতে পারি একলা-রাতের ভাবায়,
কল্পলোকের আভায়,
সে কোন অনামী অনুকম্পায়ী আগামী কালের জন্য;-
তাহ’লেই, শুধু তাহ’লেই আমি ধন্য।