সুতানটি সমাচার (আত্মজীবনী)

দেখিয়াছ, লোকগুলি ট্রামে-বাসে কী রকম বাদুড়ের ন্যায় ঝুলিতেছে?

-হা বাবা, ইহাই কলিকাতার শহর।

খোকন ভাবিল, বড়ো আশ্চর্য জায়গায় আসিয়াছি।

দুই

পুত্র ও পিতার কথোপকথনে উপন্যাস শুরু হয় এইভাবে। কলকাতার জনারণ্যে হারিয়ে যায় খোকন। খুঁজতেও থাকে নিজেকে। সুখ-দুঃখে সঙ্গী হয় কলকাতা।

মাঝে মাঝে হঠাৎ ক্ষেপে ওঠে। ফেটে পড়ে রাগে-ক্ষোভে। মনুমেন্টের চূঁড়োয় উঠে প্রস্রাবে ভাসিয়ে দিতে চায় রাজভবন, রাইটার্স বিল্ডিং, গোটা শহর। দেখতে চায় কীভাবে কলকাতা ভেসে যায়। ভাসমানদের আশ্রয় কোথায়। ওই আশ্রয়ে কি জনমহল গড়ে ওঠে? জনমহলে কি খোকনের ঠাঁই হবে?

খোকনের কেন ইচ্ছে হয় মনুমেন্টের চূঁড়োয় উঠতে? (তখনো কলকাতায় মনুমেন্টই সবচেয়ে উঁচু।) ফেলে আসা বাংলাদেশ যদি দেখা যায়!! আবাল্য ঢাকার শহর কী করে অচেনা হয়ে যাচ্ছে। অচেনা কলকাতা কীভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছে তাকে। লক্ষ্য করে, কলকাতা কাউকে কাছে টানে না। দূরেও ফেলে দেয় না। কাছে-দূরের ভিতরেই তৈরি হয়ে যায় আপন ভুবন, যে ভুবন একেবারেই নিজস্ব।

তিন

এই নিজস্বতার আদলেই দানা বাঁধবে উপন্যাস। হরেক চরিত্রের আনাগোনা। সম্মিলন। টানাপোড়েন রাজনীতি। খোকন নয়, কলকাতাই উপন্যাসের নায়ক।

চার

বছর ত্রিশ আগে, ছক কেটেছিলুম উপন্যাসের। লেখা হয়নি। চেষ্টা করেছি বার কয়েক, পৃষ্ঠা দশ-বারো লিখে ‘ধুত্তোর’ বলে ফেলে দিয়েছি। কী করে লিখতে হয় উপন্যাস, জ্ঞানগম্যি নেই আদৌ।

আমার মতো ভবঘুরে, এলোমেলো, নিশাচর, মদ্যপ উপন্যাস লিখতে পারে? বাক্য ঠিক রেখে, অক্ষরের পর অক্ষর সাজিয়ে জ্যাক কেরোয়াক কী করে ‘অন দ্য রোড’ লিখেছেন, বেঁচে থাকলে জিজ্ঞেস করতুম।

-ভাগ্যিস মারা গেছেন। বেঁচে গেছি উপন্যাস লেখার দায় থেকে।

লিখিনি বটে উপন্যাস, কিন্তু উপন্যাসের শুরুটা কেমন হবে, ছকটাই বা কী রকম, লিখেছিলুম পিকোলো (অন্তরা দেব সেন) ও অপুর (প্রতীক কাঞ্জিলাল) ‘দ্য লিটল মাগ্যাজিন’-এ। তো, কাহিনীর সারাংশ অনেকের জানা।

পাঁচ

‘তোকে দিয়ে উপন্যাস-টুপন্যাস লেখা হবে না। বরং তোর কলকাতার বিচিত্র জীবনযাত্রা নিয়ে লিখতে পারিস। কিছুই বাদ দিবি না জীবনীতে। সব- ঘটনা মিলিয়েই জীবন। বাদ দিলে জীবনও কাটছাঁট হয়ে যায়। জীবনীতে কখনো ফিলসফি, আঁতলামো ফলাবি না।’- বললেন গৌরদা।

ছয়

যশোরের লোক বলে, যশুরে টান ছাড়তে পারেননি। ‘নাতি খ্যাতি ব্যালা (বেলা) গ্যালো শুতি পারলিম না’- এই টোনে কথা বলেন না ঠিকই, কিন্তু ‘শুতি কোনো কষ্ট হচ্ছি না তো?’

-জানতে চান গৌরদা।

বয়সের বাছবিচার না করেই, দুদিন পরেই জানিয়ে দিলেন, “একটা দেশের অর্থনীতি জানতি হলি, প্রথমে কীভাবি জানবি? বাজারে যাবি। বাজারে নানা রকম মাছ। ক্রেতা কারা। কোন মাছের কত দাম। কোন দামে কারা কিনছে। শ্রেণীটা দেখবি। পুঁটির ক্রেতা কত। ইলিশ-রুই দরদাম না করে কারা কিনছে। সংখ্যা কত। হিসেবটা কষলেই পেয়ে যাবি দেশের মানুষের আর্থিক সঙ্গতি।

বেশ্যাপাড়ায় গিয়েও দেশের অর্থনীতির হালচাল বোঝা যায়। সোনাগাছিতে নানা দরের বেশ্যা আছে। কোন দরের বেশ্যার কাছে কতজন যায়। যারা যায়, কী তাদের পোশাক। চেহারাটাও দেখবি। বাজার ও বেশ্যাপাড়া একটি দেশের অর্থনীতির আসল আয়না, বুঝলি?

-জরিপ করার নামে খবরদার ঘনঘন যাবি না। এক্সপেরিয়েন্সের জন্যে একবারই যথেষ্ট। বেশি গেলে সন্দেহ আছে।”

-গৌরদার এই সাবধানবাণী নিজস্ব নয় নিশ্চয়। এক ছাত্রকে অ্যারিস্ততলও শুনিয়েছেন : ‘বেশ্যার কাছে একবার গেলে অভিজ্ঞতা, একাধিকবার গেলে কুঅভ্যাস।’

কে এই গৌরদা? কী তাঁর পরিচয়?

যুদ্ধের ঘনঘটা চারদিকে। নবেম্বর, ১৯৭১। বাজার করতে গেছি নিউ মার্কেটে। বলাকা সিনেমার সামনে, ফুটপাতে বই সাজিয়ে হকার চিৎকার করছে, ‘কলকাতা এক প্রমোদতরণী হা হা।’ কৌতূহল হয় খুব। পাকিস্তান বেতারে সকাল-সন্ধ্যেয় শাপান্ত করা হচ্ছে ভারতকে। কলকাতাকে।

‘কলকাতা এক প্রমোদতরণী’র লেখক রূপদর্শী। আগে নাম শুনিনি। আরো বই ইতস্তত ছড়ানো। ‘মনের বাঘ’। ‘লোলিটা’। ‘লেডি চ্যাটারলিজ লাভার’। কলকাতা থেকে প্রকাশিত। বাজারের টাকা মেরে দিয়ে চারটি বই কিনলুম। নবোকভের লোলিটা, লরেন্সের লেডি, গৌরকিশোর ঘোষের বাঘ পড়ে যৌন উত্তেজনা হলো, এডাল্ট হলুম। কিন্তু রূপদর্শীর প্রমোদতরণী মেজাজ বিগড়ে দিল। মস্কোপন্থী বিপ্লবী আমরা। ছাত্র ইউনিয়ন করি। প্রমোদতরণী ঘোরতর নকশালবিরোধী। ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে ভরা।

মেজাজ ঝামেলা করলেও লেখার এমনই যাদু, মোহিত হয়ে দুইবার পড়ি। এক দিনেই।

সাত

বেলা প্রায় বারোটা। গা পোড়ানো খটখটে রোদ্দুর। ১৯৭৪ মে’র ২২ তারিখ। দমদম এয়ারপোর্ট। ঢাকা থেকে বিবি (বাংলাদেশ বিমানকে তখন বিবি বলতুম।) ছেড়েছে সকাল আটটায়। দমদমে পৌঁছুলুম সকাল আটটায়। সঙ্গে আমার একটি মাত্র ব্যাগ। তাও কাঁধে ঝোলানো। ব্যাগে দুটি শার্ট, দুটি প্যান্ট। একজোড়া স্যান্ডেল। টুপেস্ট। ব্রাশ। তোয়ালে। একটি পায়জামা। দুই কপি ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’। পকেটে ভারতীয় ষাট পয়সা।

কোথায় উঠবো কিচ্ছু ঠিক নেই। গন্তব্যও অজানা। ষাট পয়সা দিয়ে কী করবো? জল ভাসে চোখে। ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে একদিনও কাঁদিনি। মৃতপ্রায় মাকে ছেড়ে এসেছি, শঙ্কায় অস্থির।

জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ফ্রি স্ট্রিট স্কুলের বাসায়, প্রায় গোটা রাত্রি তাঁর শিয়রে বসে। হাত ধরে ছিলেন আমার। ওই হাত ছাড়িয়ে নিয়ে, তাঁকে কিছুই না বলে, নিরুদ্দেশে যাত্রা।

সকালে বা এক সময় জানতে চাইবেন, কোথায় গেছি। এখনো ফিরছি না কেন। অস্থির হবেন। প্রত্যেকে চুপ। কিংবা আবোলতাবোল বলে বুঝ দিচ্ছেন। চার বছরের হেমা দাদির কোলে বসে জানিয়ে দেবে, ‘খোকন ছেলে নেই, কলকাতায় চলে গেছে।’

মা নিশ্চয় বিশ্বাস না করে ঘরময় চেয়ে থাকবেন, চোখ দিয়ে ইতিউতি খুঁজবেন।

আমি যে জেলে গিয়েছিলুম, মা জানতেন না। বলা হয় তাঁকে- হয় পাবনায়, না হয় চাটগাঁয় গেছি।

জানতেন তিনি, দুরন্ত খোকন কখন কোথায় উধাও হয়ে যায় ঠিক নেই। এক সময় ঠিকই ফিরে আসে, মায়ের কোলে মুখ গুঁজে পলায়ন-অপরাধে শাস্তির অপেক্ষায় থাকে। এক সময় বুকে জড়িয়ে ধরে বলবেন, ‘খবরদার আর যাবু না। গেলি শিকলে ব্যাদে (বেঁধে) রাখপোনে।’ আমার অল্পশিক্ষিতা মা জানেন না, চলে গেলে শিকলে বাঁধা যায় না।

একটার সময় দমদম এয়ারপোর্টে বাংলাদেশ বিমানের কাউন্টার, অফিস বন্ধ হয়ে যাবে।

বসে আছি অফিসে। ম্যানেজার বিরক্ত। কিছু বলছেন না মুখে। একবার চা খাইয়েছেন, দ্বিতীয়বার সাধছেন না। অফিস বন্ধ করলেই চলে যেতে বাধ্য আমি। খুবই ভদ্রতা দেখিয়েছেন, আর কত।

নাম জেনে ঠাঁই দিয়েছেন, এই যথেষ্ট।

নাম শুনে ভয় পেয়েছিলেন প্রথমে। ‘আপনি দাউদ হায়দার? জেল থেকে ছাড়া পেয়েই কলকাতায়? কর্মচারীদের কাছে অন্য নাম বলবেন।’

বিপদের কথা বলি তাঁকে। ‘না, আপনাকে রাখতে পারব না বাসায়, জানাজানি হলে বিপদ হবে। তাছাড়া আমার বউ অসুস্থ (পরে জানি অন্তঃসত্ত্বা)। শাশুড়ি আসবেন কাল।’

ম্যানেজার অতিশয় ডিপ্লোম্যাটিক। উপরন্তু দয়ালু। বললেন, ‘আমার ঘর থেকে যত খুশি ফোন করতে পারেন, তবে কলকাতার মধ্যে। বন্ধুদের ফোন করে বলুন আপনার সমস্যা।’

কলকাতায় আমার বন্ধু!- ও হা, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে গোটা তিনেক চিঠি লিখেছিলুম, উত্তর দিয়েছেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায় ‘সাপ্তাহিক কবিতা’র জন্যে চিঠি লিখেছেন। পাঠিয়েছিলুম। ‘পূর্ব বাংলার শ্রেষ্ঠ কবিতা’য় তরুণ কবিদের মধ্যে আমার কবিতাই বেশি। কেন বেশি, সম্পাদক শক্তি চট্টোপাধ্যায় কৈফিয়ৎও দিয়েছেন।

জানতুম, সুনীল-শক্তি আনন্দবাজার পত্রিকায় চাকরি করেন। ফোন করলুম। অপারেটর বললেন, ‘এখন নেই। বিকেলে চেষ্টা করবেন।’ মনে পড়ল, সাগরময় ঘোষের কথা। ‘দেশ’-এ গোটা কয়েক কবিতা লিখেছি। না, তিনিও নেই।

টেলিফোন বুকেই আনন্দবাজারের লিস্টে নাম দেখি সন্তোষ কুমার ঘোষ। ‘শ্রীচরণেষু মাকে’ পড়েছি। না, তিনিও অফিসে আসেননি।

[লেখাটি বাংলাদেশের সাপ্তাহিক ২০০০ (ঈদ সংখ্যা ২০০৭, বর্ষ ১০) এ প্রকাশিত হয়েছিল।]