আমার মৃত্যুর পরে

আমার মৃত্যুর পরে এর-ওর কথা বলাবলি শেষ হ’লে
হয়তো মাঠের পরে-নক্ষত্রের সভা-শীতরাতে
বলবে, কোথায় গেল?-আমরাও জানি না তো কিছু
এক দিন জন্মেছিল সৃষ্টির হাতে

নরম হলুদ পায়ে ঘাসের ওপর দিয়ে যেতে-যেতে হয়তো শালিক
দু’-মুহূর্ত কী যেন কী আবছা আন্দাজে স্তব্ধ থেকে
বলবে, দেখি না কই তাকে আর-কই-কই গেল?
শালিখদের ডেকে ফেরে-আমাদেরও মাঝে-মাঝে দেখবে সে ডেকে

আসন্ন সন্ধ্যার কাক কোলাহলে ঘরে ফিরে এসে
বলবে, এ-কুয়াশায় দেখেছি যে কত দিন নিজ-মনে হাঁটে
মাঠের ফাটলে খড়ে ঘাসে-ব’সে থেকে শান্তি পায়
কত দিন তাকে আর দেখি না যে মাঠে

নিঃশব্দ পলকে এসে খয়েরি পাখনা দিয়ে ঘাসের শিশির মুছে নিয়ে
আবার মেলবে ডানা মেঠো চিল কুয়াশায় পাতাহীন মাদারের পানে
বলবে সে, দেখছি না কেন-কই গেল?
সন্ধ্যায় জামের নিচে-দেখা যেত না কি এইখানে।

★★★★

(হয়তো বলিবে কেউ): শান্ত রাতে চ’লে গেছে-মনে পড়ে এত মৃদু, এমন নির্জন-
সেই শেষ বার যখন সে চ’লে গেল-আকাশ তারায় ছিল ভ’রে
মাঘের বাতাস জাম আমলকী বনে
এমন নিস্তব্ধ শান্ত-একটি পাতাও যেন পড়ে নি ক’ ঝ’রে!

(হয়তো বলিবে সে-ই): সন্ধ্যার আকাশে আজ উড়ে চ’লে যায়-
মেহেদির ঝাড় ছেড়ে ঝিঁঝিগুলো উড়ে গেছে রাত্রির বাতাসে
(উড়িতেছে কী চঞ্চল)-উড়ে গেছে-কী এক গভীর শান্তি ভ’রে ফেলে মন
মানুষ খুঁজছে এই শান্তির মন ভালোবেসে।

(কেউ-বা বলিবে চুপে): অনেক পুরোনো বই রেখে গেছে-অনেক ধূসর
পাণ্ডুলিপি, লিখতে গিয়ে পিছে ফেলে গেছে-কিন্তু, দেখ, করে নি ক’ কিছুই রচনা
তবু আসো যদি-এক বার দেখে যাও তার সোঁদা সাদামাটা ঘর
কিম্বা ঐ মাঠে যাও, বস যদি-সেই হবে তাকে নিয়ে সবচেয়ে ঠিক আলোচনা।

(কেউ-বা বলিবে এসে): এই নীল জারুল গাছটা ছিল ঠিক তার জানালার পাশে
সকালের তাজা রোদে বাধা দিত, ডালপালাপাতা নিয়ে মিটমিটে ডান্
এ-গাছ সে কিছুতেই কাটতে দেবে না তবু: বাতিক সে সব-চেয়ে বেশি ভালোবাসে
গাছ মাঠ মাছরাঙা ঝিঙেফুল-বাতিকে জীবন তার হয়েছে উচ্ছল অকারণ।

(আবার বলিবে কেউ): খাড়াপাড় পুকুরের গর্তের ভিতরে
দুটো মাছরাঙা ছিল-মাছরাঙা, মাছরাঙা: ছেলেদের খেলবার বলের মন
তবুও সে বাধা দিত-(না জানে কে সেই কথা)-যত বার দুই দণ্ড ফুর্তি লুটতে
গিয়েছি গর্তের কাছে; কী এক রকম যেন ছিল সেই মিনসের মন-

বোলতার চাক এক বছরখানেক ধ’রে পুষেছিল জানালার পাশে-
(বিস্ময়ে উঠিবে বলে কেউ এসে);-কী এক কবিতা, আহা, লিখেছিল মরা ব্যাং বাদুড়ের ‘পরে
(না-না ব্যাঙ্কে টাকা নেই:) খড়ের ছাউনি ঘর-বাবুইয়ের বাসা যেন-উড়ছে বাতাসে
নাক কান ডুবেছিল একরাশ দেনার ভিতরে-

(কেউবা বলিবে শূন্য হাই তুলে): কে-ই-বা সে-তাকে নিয়ে কেন-ই-বা এত কথা, ভাই?
না হয় বাসত ভালো মাঠ গাছ ফড়িং গুবরেপোকা কেঁচো
এখন সে চ’লে গেছে,-অনেক মাটির নিচে-রয়েছে নীরব
খুঁচে আর কী-বা হবে-মড়া-ঘাঁটা ঢের হল-দাও ছেড়ে দাও-

(তবুও বলিবে কেউ): তোমরা পুরুষ সব-আমি এক নারী
(কাজেই সহজে বোঝো) সাক্ষ্য দিতে পারি আমি সবচেয়ে ঢের বেশি-ঢের
মাছরাঙ কাঁচপোকা কিছু নয়,-তার জীবনের সব বিষণ্ণতা ব্যর্থতা নিংড়ে
জীবনে নারীর রূপ-আর তার অসম্ভব রহস্যের পেয়েছিল টের

হয়তো তোমরা তাহা বোঝো না ক’-তোমরা তো বিয়ে করো-সাদা সাধারণ
দৈনিক জীবন চলে-তার ভারে কেটে যাও-নেই ক’ আঘাত
পথে-পথে আবিষ্কার নেই কিছু-মিলনের বেদনায় মন
কুয়াশায় দেখে না ক’ কালো তিল-ম্লান চুল-নির্জন বাঁ হাত।

(হয়তো দু’-জনে ব’সে): ‘রাত্রি ঢের বেড়ে গেছে’…’শিশিরে গিয়েছে ভিজে অশ্বত্থের শাখা-
পউষের হিম রাতে কত কী যে কথা-ঘাসে কত কী যে গন্ধ লেগে রয়-‘
‘শিমুলডালের পিছে ঐ দেখ-চাঁদ কেন শিঙের মতন বাঁকা’…’আমি বুঝি না তা’
‘শিমুলের পাতা কেন ঝ’রে যায়?’…’শিমুল ফুটবে কবে?’…’মাঘে কী ফাল্গুনে মনে হয়’।