বৈশাখের আকাশ

১.
আমি দেখেছি বৈশাখের আকাশ
এত দিন বসন্ত ছিল
দখিনা বাতাস ছিল
গভীর রোদ ছিল
আর অপরিশ্রান্ত নীল আকাশ
দুপুরবেলা- সমস্ত দুপুর
এত দিন আকাশের চিলগুলোকে কত যে দূর মনে হ’ত
আর পায়রাগুলো যেন শহরের গম্বুজ-শিরও ছুঁতে একমত না
তারাও যেন কোন্ অন্য প্রেমের আস্বাদ পেয়েছে
কোথায় রোদের পেছনে আকাশ- আকাশের পিছে রোদ
মানুষের অগন্তব্য- বিস্ময়ের ভিতর লুকিয়ে গিয়ে
এই পাখিগুলো
সমস্ত আকাশটাকে
জিনের সমুদ্রের মতো ক’রে রেখেছিল
সমস্ত দুপুরবেলা
দুপুরবেলা অনেক ক্ষণ বারান্দার রেলিঙের পাশে দাঁড়িয়ে
পাখিগুলোর এই ব্যবহার দেখে
নিজেকে এত একা মনে করতাম
এই বন্দর- এই শহর- এই কলকাতা এত অবাস্তব মনে হচ্ছে…

২.
এক-একটা পায়রার সাদা ডানা
টেলিফোনের তারের ঢের ওপরে
ঢের-ঢের-ঢের ওপরে
রোদে- নীল আকাশে
কেমন নিমজ্জিত হয়ে গেল!
আছো কেমন!
এর পর ট্রামের লাইনই-বা কী!
আর টেলিফোনের তারই-বা কী!
এ-সব কিছু নয়।
কিন্তু তবু ওদের ভিতর আমি গেঁথে গিয়েছি
ট্রামের লাইনের মতো শক্ত হয়ে
গেঁথে গিয়েছি আমি
(তা-ই আমি)
চিলকে গাঁথতে চেয়েছি
পায়রাকে
(পারি নি)
বেবিলন পারে নি- এশিরিয়া পারে নি
লন্ডন পারে নি- প্যারিস পারে নি
এই সব পুরোনো প্রবল শহরের কলকব্জায়
মানুষ নিজেকে ইটের মতো মনে করেছে
বল্টু নাট সিমেন্টের মতো
কিন্তু পাখিরা এড়িয়ে গেছে…

৩.
বেবিলনে ফাল্গুনের দুপুরের নীলে একটা চিলের গভীর পাখা
আকাশের ওপরে আরও উঁচু আকাশে উঠে গেছে
নিচে রাজমিস্ত্রি নতুন শহর তৈরি করছিল
শত্রুরা পুরোনো শহর ভাঙছিল
নটীরা নাচছিল
শব গলছিল
কী ব্যস্ততা!
হয়তো
শুধু কোনও এক কবি
আমার মতো ব্যস্ততাহীন
তাকে বিমর্ষ হ’তে হয়েছিল
আমার মতো বিষণ্ন হ’তে হয়েছিল তাকে…

৪.
ফাল্গুনের-চৈত্রের দুপুরবেলায়
শহর যখন বিরাট অপরিচ্ছন্ন সেন্টুরের মতো
শহরের প্রাচীরের ওপরে
গম্বুজের ওপরে
কোনও পাখি এসে বসে না যখন
(রোদ থেকে রোদে আকাশ থেকে আকাশে)
আমার জানালার পাশে সমস্ত রাত যে-পায়রা দু’টো ছিল
তাদের তখন আর দেখি না
বুকে এক অবসাদ জেগে ওঠে
বেবিলনে এশিরিয়ায় রোমে দিল্লিতে লন্ডনে প্যারিসে কলকাতায়
বসন্তের দুপুরে
আমাদের জন্য এই অবসাদ রয়েছে
কিম্বা আমার জন্য…

৫.
বৈশাখের আকাশ দেখছি
বৈশাখের দুপুরবেলা পাখিরা তাদের
বসপরাস সমুদ্রের ভিতর চ’লে গিয়েছিল-
যেমন ফাল্গুনে গিয়েছে তারা
চৈত্রে গিয়েছে
কিন্তু এই ঘূর্ণি ছিল কি তখন?
আকাশে মেঘ ক’রে এসেছে
সমস্ত কলকাতার কালো কুটে হয়ে গিয়েছে যেন
ঠাণ্ডার বাতাস
একরাশ চিলের পাখা পৃথিবীকে খুঁজছে
গম্বুজের ওপরে এসে বসেছে তারা
ছাদের ওপর নামছে
পায়রার দল আলিসার ওপর ঝাপটে এসে পড়ছে
ঘরের ভিতর ঘুরছে
মায়ের স্তনের ওপর সন্ততির মতো
অগাধ আতিশয্যে
আরও অন্ধকার খুঁজছে
এমন অন্ধকারের ভিতর আমি একা সমস্ত দিন থাকি
সমস্ত ফাল্গুন- সমস্ত চৈত্রের দিন
কত বছরের কত-কত দিন।
পায়রা চিল তখন আকাশে-আকাশে কত দূরে!…
… …
কিন্তু সে-সব বিমর্ষতার কথা আজ আর তুলব না
আজ এই বৈশাখের অন্ধকার দুপুরে
আমার ঘর ভ’রে এত পায়রা!