দুজন

‘আমাকে খোঁজো না তুমি বহু দিন- কত দিন আমিও তোমাকে
খুঁজি না ক’; এক নক্ষত্রের নীচে তবু- একই আলো পৃথিবীর পারে
আমরা দু’ জনে আছি; পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়,
প্রেম ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও এক দিন ম’রে যেতে হয়,
হয় নাকি?’- ব’লে সে তাকাল তার সঙ্গিনীর দিকে;
আজ এই মাঠ সূর্য সহমর্মী অঘ্রান কার্তিকে
প্রাণ তার ভ’রে গেছে।

দু’ জনে আজকে তারা চিরস্থায়ী পৃথিবী ও আকাশের পাশে
আবার প্রথম এল- মনে হয়- যেন কিছু চেয়ে- কিছু একান্ত বিশ্বাসে।
লালচে হলদে পাতা অনুষঙ্গে জাম বট অশ্বত্থের শাখার ভিতরে
অন্ধকারে ন’ড়ে-চ’ড়ে ঘাসের উপর ঝ’রে পড়ে;
তার পর সান্ত্বনায় থাকে চির কাল;

যেখানে আকাশে খুব নীরবতা, শান্তি খুব আছে,
হৃদয়ে প্রেমের গল্প শেষ হলে ক্রমে-ক্রমে যেখানে মানুষ
আশ্বাস খুঁজেছে এসে সময়ের দায়ভাগী নক্ষত্রের কাছে:
সেই ব্যাপ্ত প্রান্তরে দু’ জন; চারি দিকে ঝাউ আম নিম নাগেশ্বরে
হেমন্ত আসিয়া গেছে;- চিলের সোনালি ডানা হয়েছে খয়েরি;
ঘুঘুর পালক যেন ঝ’রে গেছে- শালিকের নেই আর দেরি,
হলুদ কঠিন ঠ্যাং উঁচু ক’রে ঘুমাবে সে শিশিরের জলে;
ঝরিছে মরিছে সব এইখানে- বিদায় নিতেছে ব্যাপ্ত নিয়মের ফলে।

নারী তার সঙ্গীকে: ‘পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়,
জানি আমি;- তার পর আমাদের দুঃস্থ হৃদয়
কী নিয়ে থাকিবে বল;- এক দিন হৃদয়ে আঘাত ঢের দিয়েছে চেতনা,
তার পর ঝ’রে গেছে; আজ তবু মনে হয় যদি ঝরিত না
হৃদয়ে প্রেমের শীর্ষ আমাদের- প্রেমের অপূর্ব শিশু আরক্ত বাসনা
ফুরত না যদি, আহা, আমাদের হৃদয়ের থেকে-

এই ব’লে ম্রিয়মাণ আঁচলের সর্বস্বতা দিয়ে মুখ ঢেকে
উদ্বেল কাশের বনে দাঁড়িয়ে রহিল হাঁটুভর।
হলুদ-রঙের শাড়ি, চোরকাঁটা বিঁধে আছে, এলোমেলো অঘ্রানের খড়
চারি দিকে শূন্য থেকে ভেসে এসে ছুঁয়ে-ছেনে যেতেছে শরীর;
চুলের উপর তার কুয়াশা রেখেছে হাত, ঝরিছে শিশির;-

প্রেমিকের মনে হল: ‘এই নারী- অপরূপ- খুঁজে পাবে নক্ষত্রের তীরে;
যেখানে র’ব না আমি, র’বে না মাধুরী এই, র’বে না হতাশা,
কুয়াশা র’বে না আর- জনিত বাসনা নিজে- বাসনার মতো ভালোবাসা
খুঁজে নেবে অমৃতের হরিণীর ভিড় থেকে ইপ্সিতেরে তার।’

কবিতা । বৈশাখ ১৩৫৭