চিঠি-৭

সর্বানন্দ ভবন
বরিশাল
২. ৭. ৪৬

প্রীতিভাজনেষু,

কলকাতার থেকে যে কার্ড লিখেছিলাম তা পেয়েছেন আশা করি। আধুনিক বাংলা কবিতার ধারাবাহিক ইতিহাস লেখার কাজে হাত দিয়েছেন কি?

(১) আমার কাব্যগ্রন্থগুলো আপনি চেয়েছেন। এ পর্যন্ত আমার চারটে কবিতার বই বেরিয়েছে; আমার পঞ্চম কবিতার বই-যার ভিতরে আমার শেষের দিকের অনেক representative কবিতা থাকবে তা এখনও গ্রন্থাকারে বেরয় নি; সে সবের পাণ্ডুলিপিও আমার কাছে নেই-press এ আছে; বই বেরুতে বেশ কিছু দেরি হবে। আপনার চিঠি পেলে আমার দুখানা বই আপনাকে পাঠিয়ে দেব। প্রথম কবিতার বইটি পাঠাব কিনা ভাবছি; সে বইয়ের বিশেষ কোনো importance আছে বলে মনে হয় না। আর ‘বনলতা সেন’ বইটের সমস্ত কবিতাই ‘মহাপৃথিবীতে আছে।

(২) ‘কল্লোল’ ‘কালিকলম’ প্রগতি ইত্যাদির কোনো সংখ্যা এখন আমার কাছে নেই। কলকাতায় কোনো কোনো প্রবীণ সাহিত্যিকের কাছে থাকতে পারে।

(৩) আমার সংক্ষিপ্ত জীবনী ও পরিচয় চেয়েছেন। সম্প্রতি বড়ো ঝঞ্ঝাটের ভিতর আছি; লিখবার তাগিদ নেই। আপনি কি জানতে চাচ্ছেন তাও স্পষ্ট বুঝতে পারছি না।…আমার জন্ম হয়েছিল বরিশালে ১৮৯৯ খৃষ্টাব্দে ফাল্গুন মাসে। পড়েছিলাম B. M. School, B. M. College, Presidency College, University Law Collegeএ। শেষ পর্যন্ত আইন পরীক্ষা দেওয়া হয় নি। অধ্যাপনা করেছি কলকাতায় City colegeএ, দিল্লীর এক College-এ, বরিশালে B. M. Collegeএ। আরো ২/৪ রকম কাজ করেছি ফাঁকে ফাঁকে। এখনও অধ্যাপনাই করতে হচ্ছে। কিন্তু মনে হয় এ পথে আর বেশি দিন থাকা ভালো না। যে জিনিস যাদের যেভাবে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে সবই অসাড়তার নামান্তর না কি? এইবার নতুন পটভূমি নেমে আসুক।

আমাদের পরিবার খুব বড়ো-কিন্তু সাহিত্যপ্রীতি ও রচনারীতির উৎকর্ষ লক্ষ্য করেছি বাবার জীবনে। তিনি অনেক ইংরেজি ও দেশী বই কিনতেন ও পড়তেন, ভালো library ছিল তাঁর; সংস্কৃতি ও সাহিত্য বিষয়ে উৎসাহী যুবা ও প্রৌঢ়দের আনাগোনা ছিল তাঁর গ্রন্থাগারে। বাবা মাঝে মাঝে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিতেন তাদের বিদেশী ও দেশী সাহিত্য। নিজে বিশেষ কিছু লিখতেন না। যে ক’টি রচনা তাঁর পেয়েছি তাতে উচ্ছাস কম-সংহতি বেশি। খুব তত্ত্বজ্ঞানী মানুষ ছিলেন। মা অনেক কবিতা লিখেছেন। সে সব কবিতার শাদা ঝর্ঝরে শব্দনিক্কণ ও আশ্চর্য অর্থসঙ্গতি বরাবরই আমাকে প্রলুব্ধ করেছে; কিন্তু তবুও আমি প্রথম থেকেই অন্য পথ ধরে চলেছি। আমি খুব সম্ভবত জাত সাহিত্যপ্রেমিক। যে আবহাওয়ায় ছিলাম তাতে উত্তরকালে ভালো সাহিত্যরসিক হয়েই মুক্তিলাভ করা যায় না, নিজের তরফ থেকে কিছু সৃষ্টি করবারও সাধ হয়। ছেলেবেলা থেকেই গল্প উপন্যাস-স্বদেশী ও বিদেশী-নেহাৎ কম পড়ি নি। ঔপন্যাসিক হবার ইচ্ছা ছিল, এখনও তা ঘোচে নি। শ্রেষ্ঠ সমালোচনাও অবসরের অভাবে দানা বাঁধতে পারছে না। না পারছি মহৎ নাট্য-সমালোচকের নেতিবাচক নিরাশা ভঙ্গ করে তেমন কিছু নাটক লিখতে। এই দারুণ সংগ্রাম-কঠিন সময়ে নানারকম আধিজৈবিক দায়িত্ব মিটিয়ে যেটুকু সময় থাকে তাতে সাহিত্যের কোনো একরকম অভিব্যক্তি (যেমন কবিতা) নিয়েই যত দূর সম্ভব পটভূমির প্রসার ও গভীরতা বাড়ানো যায় সেই চেষ্টাই করা যেতে পারে। কিছু পরিমাণে এই জন্যই কবিতা লিখতে উৎসাহ পেয়েছি। কিন্তু সব চেয়ে বেশি প্রেরণা পেয়ে লিখেছি এই কারণে যে আমার যুক্তিধর্মী মানস আধুনিক সময়ের সমস্ত সঙ্গ ও অহেতুকতার সংস্পর্শে এসে কবিমানসের দৃষ্টি-উজ্জ্বলতায় রূপান্তরিত হতে চেয়েছে (হয়তো হয়েছে)। ব’লে। এর পর বলতে হয় কবিমানস কী, কবিতা কাকে বলে? এ নিয়ে অন্যত্র আলোচনা করেছি, করব। আজ সময় নেই।

প্রথমেই ‘কল্লোলে’এ কবিতা ছাপিয়েছি বল্লে ঠিক হবে না, কিন্তু ‘কল্লোলে’ই প্রথম কবিতা ছাপিয়ে ভালো লেগেছিল। ‘কল্লোলে’র যুগে আমি কলকাতায় থাকতাম। ‘কল্লোলে’র শ্রেষ্ঠ লেখকদের সঙ্গে প্রায়ই দেখা, কথাবার্তা হত। কিছুকাল পরে ‘কালিকলম’ বেরুল; ‘কালিকলমে’র দিক-নিরূপক ছিলেন প্রেমেন্দ্র ও শৈলজানন্দ। মোহিতলাল ‘কালিকলমে’ কবিতা লিখতেন। ‘কালিকলম’ অফিসেই নজরুল ইসলামকে প্রথম দেখেছি। ভালো না মন্দ, বড়ো বা ছোটো কী এক যুগ ছিল সেটা? যাই থাক না কেন, ইস্কুল পড়বার সময় যেমন প্রমথ চৌধুরী, সত্যেন দত্ত, প্রভাত মুখুয্যে, ফরাসী ও রুশ গল্পের ‘ছায়াবলম্বনে’র ওস্তাদ সূপকার চারুবাবু ও মণি গাঙ্গুলি-ও পরে অন্য গ্রামে-শরৎ চাটুয্যেকে অন্তৰ্জীবনে বিজড়িত করে নিতে হয়েছে, ‘কল্লোলে’র যুগে তেম্নি সমালোচকদের পেয়েছি আর-একরকমভাবে, অনেকটা নাগালের ভিতরে; মানসপরিধি থেকে পূর্বজেরা তখন সরে গিয়েছেন খানিক দূরে-অনেক দূরে; -রবীন্দ্র বঙ্কিম ও বাংলা সাহিত্যের প্রাক্তন ঐতিহ্যও ধূসরায়িত হয়ে গিয়েছিল বড়ো বড়ো বৈদেশিকদের উজ্জ্বল আলোর কাছে। বাংলা সাহিত্যে ‘কল্লোল’-আন্দোলনের প্রয়োজন ছিল। সাহিত্য ও জীবনের ঘুরুনো সিড়ি দুয়ে-মিলে এক হয়ে এক পরিপূর্ণ সমাজসার্থকতার দিকে চলেছে মনে হয়; ‘কল্লোলে’র সাময়িকতা সেই সিড়ির একটা দরকারি বাঁক।

‘কল্লোল’ ‘কালিকলম’ ক্রমেই বিস্রস্ত হয়ে যাচ্ছিল।

বুদ্ধদেব বসুর ‘প্রগতি’ এল নতুন সম্ভাবনা ও উৎসাহ নিয়ে। ব্যক্তিগতভাবে ‘প্রগতি’ ও বুদ্ধদেব বসুর কাছে আমার কবিতা ঢের বেশি আশা নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল। সে কবিতাগুলো হয়তো বুদ্ধদেবের মতে আমার নিজের জগতের এবং তাঁরও পরিচিত পৃথিবীর বাইরে কোথাও নয়; স্পষ্টতাসম্ভবা তারা; অতএব সাহস ও সততা দেখবার সুযোগ লাভ করে চরিতার্থ হলাম-বুদ্ধদেববাবুর বিচারশক্তির ও হৃদয়বুদ্ধির; আমার কবিতার জন্য বেশ বড়ো স্থান দিয়েছিলেন তিনি ‘প্রগতি’তে এবং পরে ‘কবিতা’য় প্রথম দিক দিয়ে। তারপরে-‘বনলতা সেন’এর পরবর্তী কাব্যে আমি তার পৃথিবীর অপরিচিত, আমার নিজেরও পৃথিবীর বাইরে চলে গেছি বলে মনে করেন তিনি। ‘নিরুক্ত’ ও ‘পূর্বাশা’র সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্য মনে করেন আমার শেষের দিকে কবিতায় আমার পারিপার্শ্বিক চেতনা প্রৌঢ় পরিণতি লাভ করেছে। এ পারিপার্শ্বিক অবশ্য সমাজ ও ইতিহাস নিয়ে। কিন্তু আরো দু-চাররকম চেতনা আছে, আজও যাদের কবিতায় শুদ্ধ করে নিয়ে নির্ণয় করে দেখতে আমি ভালোবাসি। সমাজ যত বিশুদ্ধ, বৈজ্ঞানিক ও কল্যাণকৃৎ হোক না কেন, প্রেম, প্রকৃতি, সৃষ্টিপ্রপঞ্চ সম্পর্কে শেষ আত্মপ্রসাদ কোনো ঐকান্তিক কবি বা মনীষীর জীবনে ঘটে কি? ঘটে নি তো আমার জীবনে। সমাজ ও ইতিহাস সম্পর্কেও আমার কবিতা চেতনা হয়তো দেখিয়েছে, আরো বড়ো চেতনায় উত্তরপ্রবেশ চেয়েছে, কিন্তু সেই জ্ঞানদৃষ্টি কি পেয়েছে যা সমাজকে নতুন পথ দেখাতে পারে? কিন্তু কোন্ কবি তার কবিতায় সেই অমোঘ ‘বিজ্ঞানদৃষ্টি’র প্রভাবে সমাজ ও পৃথিবীকে নতুন পথ দেখিয়েছে- কবি-লক্ষিত যেই পথ বেয়ে মানুষ তার প্রাণের আকাঙ্ক্ষিত সমাজ পেয়েছে? প্রয়াণের প্রথম দিন থেকে শুরু করে আজও আমরা সে সমাজ পাই নি। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি-দিব্যতা-যা নতুন শুদ্ধ সমাজ মানবকে দান করতে পারে-এই দৃষ্টিদিব্যতার দিক থেকে তা হলে কি অতীতের সমস্ত শ্রেষ্ঠ কবিই বিফল? কিংবা সমস্ত শ্রেষ্ঠ কবিই কি অধিক সার্থকতায় অবিচ্ছিন্ন সময়ের সমবেত চেষ্টায় বিজ্ঞান ও নিঃশ্রেয়স সমাজ গড়ছে? তা হয়তো গড়ছে (এ প্রয়াসের পথে কোনো শেষ কৈবল্যলোকও নেই হয়তো) যেমন সমস্ত শ্রেষ্ঠ মনীষী অর্থশাস্ত্রী ও সঠিক বিষয়ালোকিত সেবক ও সাধকেরা গড়ছে। আধিজৈবিক উপায়ে এরা যেমন করে গড়ছে সমাজস্রষ্টা কবিতা সে সফলতার দাবি করতে পারে না হয়তো-কিন্তু অন্য এক শ্রেষ্ঠ সাধকতা রয়েছে তার-যেখানে শুদ্ধ সমাজসৃষ্টির শুভেচ্ছা বা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিরীতির শুদ্ধতা (যা ও-রকম সমাজ রচনা করছে, যদিও সে সমাজ আজও পাচ্ছি না আমরা) সব কিছু হয়েও আরো কিছুর অপেক্ষা রাখে যা বিষয় ও বিষয়-বিচারের উজ্জ্বলতাকে ভাবপ্রতিভার সাহায্যে কবিতার স্বতন্ত্র আভায় পরিণত করে।

আমার আধুনিক কবিতা এই সব ব্যাপারের থেকেই উৎসারিত হতে চাচ্ছে।

জীবনানন্দ দাশ


[পত্রের উদ্দিষ্ট অজ্ঞাত। ‘ময়ূখ’ জীবনানন্দ-স্মৃতি সংখ্যায় মুদ্রিত।]