পুরোনো বইয়ের দোকানে আমি

পুরোনো বইয়ের দোকানে আমি এক-আধটা বই চাই মাঝে-মাঝে সে-সব দোকানগুলো তবু
কেন-যে তামাক টানে সারা-দিন- থুতু ফেলে- পাপোশের ‘পরে মাথা ঘষে সারা-দিন
বিবর্ণ কুমির যেন নীলনদীটির পারে দাঁত মেলে আভাস পোহায়- দিগন্তের
কত শত শতাব্দীর ভূত যেন তাহাদের করতল দিয়ে আইবিস’এর মতো চ’লে যায়
তবু তারা বেঁচে আছে অসীম চর্বি মেখে গায়
‘ওঠো- ওঠো- ইয়াসিন- ধর্মদাস-‘ ‘হুজুর, কী বই চাই-‘ বলো-না রে বাবা
বইয়ের কার্বার ক’রে মানুষ কি তিনটে হয়ে যায় ত্রুবাদুর
তোমাদের স্টলে ঢুকে মন যেন খালাসির শাম্পানে চ’ড়ে উড়ে চ’লে যায়
অন্ধকার রজনীতে যেন এক বডকিন থেকে গ্যাস জ্বলে
ইলিশমাছের গন্ধ- শিরশিরে পরলোক- ছুটেছে চালান-নৌকা- গঙ্গাসাগরের দিকে
সময়-বুড়ির নকশিকাঁথার মাঝিদের গল্পের কবলে
ভুশ ক’রে ডুবে যায়- মাঝপথে- অনন্ত লাটিম যেন ঘুরিতেছে এক সের সাবলীল জলে
শ্লথ কালো বিহঙ্গের মতো আমি লবেজান আত্মা নিয়ে ডানা মেলে একা
ডুবে যাই- ডুবে যাই- গোলকধাঁধার থেকে হঠাৎ গুছায়ে নেব ইস্প্রিঙের মতো ডানা মেলে
চ’লে যাব এই বার আমি- ঢের দূর- শান্তিপুর
কোনও বড়ো অন্ধকার সঙ্ঘারামে- কুয়ালালুম্পুর-
কোনও সিত হোটেলের অন্ধকার কড়িবর্গা খেয়েছে অনেক বোমা
সেখানে গ্যাসের আলোয় আজ হোমা-
পক্ষী নেই- সারা-দিন সূর্যালোকে ঝুলিছে বাদুড়
সেইখানে কালো পাথরের গাভীগ্রাস হয়ে র’ব- মাথার উপর দিয়ে লাথি মেরে যাক-না বাছুর-
অনন্ত বাছুর-
‘তৃণাদপি সুনীচ’ কি হও নাই, হে হৃদয়,
পৃথিবীতে বহু দিন বেঁচে থেকে শতরঞ্চি রক্ষা ক’রে শুনে গেছে অসীম মাথুর-
‘তবু যেন মনে হয়-‘
‘ভিলোঁ?- ভিলোঁ নেই- হল এন্ড স্টিভেন্স-‘
সবুর- সবুর- ধর্মদাস
‘জিওমেট্রি আছে, মোশা- আপনি লিবিন-‘
সবুর- সবুর- সবুর- সবুর- সবুর- সবুর- ইয়াসিন
ভিলোঁ কেন চেয়েছি, জানিস
চল্লিশ বছর পার হয়ে গেছে বহু দিন- চলিতেছে সাড়ে-ছেচল্লিশ
রক্তে যেন চিনি জ’মে গেছে ঢের- মনে হয়
মিঠাইয়ের দোকানের পাশ দিয়ে হেঁটে-হেঁটে তিন যুগ- হয়ে গেছে ঢের বর্ণমালা পরিচয়
মিঠাইটা তোমাদের- অথবা তাদের- আমাদের তরে শুধু ফুটপাথে হেঁটে-হেঁটে শিস!
পুরোনো বইয়ের স্টলে অঙ্ক আর ইস্কুলের-ম্যানুয়েল ছাড়া আর
কিছু নেই- যদিও এ-সব বই- কয়েকটি ছেলেপুলে ঘরে যদি থেকে যেত-
হয়ে যেত আরামচেয়ার- আদমসুমার-
চুরুট জ্বালায়ে এক বাদলের দিনে ব’সে অর্ধনারীদের মতো দু’টো মূল কথা হত ওতপ্রোত
কোনও এক সব-অ্যাস-সার্জনের মতো
নতুন বইয়ের স্বার্থে যেতে হলে জীবনটা আগগোড়া সাব-রেজিস্ট্রার সেই খাস্তগির-সাহেবের মতো হলে হত
সমুজ্জ্বল আলপিন যদি হওয়া যেত পিনকুশনের- মেহগিনি টেবিলের
আমি আর রাম আর যদু আর শ্যাম আর সতীশ যতীশ
চল্লিশ, বিয়াল্লিশ, তেতাল্লিশ, সাড়ে-ছেচল্লিশ
নৌকোর ভিজে কাঠে ব্যবহৃত বিবর্ণ ডামিশ-

দশটা-পাঁচটা নেই আমাদের
সিজন-টিকিট নেই
ট্রামের মান্থলি নেই
… আমাদের তরে কোনও স্বর্ণযুগ নয়
আমাদের পিতৃলোক বহু দিন হয়
লামাদের মতো প্রার্থনার চাকা নেড়ে ঘুরায়ে ঘুরায়ে ঘুরায়ে ঢের
হাওয়ার চেয়ারে চ’ড়ে স্বর্গে উড়ে গেছে কবে দালাইলামার মতো প্রাণের আবেগে

পাণ্ডুলিপি রেখে গেছে সিন্দুকের পরে সিন্দুকের
পঞ্চদশী, মহানির্বাণতন্ত্রের…
সেই সব বিবর্ণ ন্যাকড়ার বাঁধ খুলে- খুলে- খুলে- মনে হয়
নাগার্জুন যেন মোরা
(নিলামের সব-চেয়ে মিঠে দামে হাতুড়িটা ঝন ক’রে ঠুকে চ’লে গেল শেষ বার
লঙ্- লঙ্- লঙ্ লীভ বিফোর রিটায়ারমেন্টের সময় এসেছে
তবু চাকরিটা শুরু করা হল না ক’ আর)

আশ্চর্য জারক এক পাওয়া যাবে- সোনা হবে?- না হলে রাতের শেষ ট্রেনে
মানবাত্মা চ’লে যাবে কলকাতা- চাকরির বাজারের দিকে
আজ শুধু বই পড়ো, হে হৃদয়, পঞ্চদশী, পতঞ্জলি হয়ে গেলে ফিকে
ভিলোঁ আর মালার্মের বোদলেয়ারের থেকে কেউ মরণের আগে
কিছু নিতে পারে শিখে
হে ভারতচন্দ্র, কাশীরাম, ভিলোঁ, ব্লেক, শেকসপীয়র, বোদলেয়ার
তোমাদের ফেলে দিয়ে মাসে-মাসে পঁচিশটা টাকা পেলে এমন কী বেশি লাভ হত
পাঁচটা টাকাও ট্যাঁকে নেই ব’লে তোমরাও পাখি হয়ে উড়ে গেছ
(সমস্ত যেতেছে উড়ে: রিকশা, মোটর, ট্রাম, লেমনেড, ফরসেপ, স্ট্রেচারের দিকে)
যখনই দেখাই মোরা জ্যোতিষীকে ওমনই সে বলে
তোমাদের দু’ হাতের সামুদ্রিক রেখাগুলো ধরাচুড়ো প’রে রায়সাহেবের মতো
হলেও তো হয়ে যেত
সমস্ত জীবন ভ’রে ব্যস্ত থেকে বৃহস্পতি-নক্ষত্রের উর্ধ্বটানে অনেক উপরে উঠেছ তো
সারা-দিন কর্তব্যের ফাঁকে-ফাঁকে এই সব বোধ
কর্নিশের দিকে উড়ে যেতে চায়
সময় যেতেছে উড়ে- লুফে নাও, লুফে নাও: আই. এফ. এ.’র ময়দানে
শশব্যস্ত টিকেটের মতন আমোদ
সময় যেতেছে উড়ে- সময় যেতেছে উড়ে
সারা-কলকাতা জুড়ে কী-যেন-কী-হবে ভেবে আর-এক বার জুড়ে দাও রোদঁ।

কারা যেন বলিতেছে ধনেশপাখির মতো হেঁকে
সেগুনের কুঞ্জে ব’সে মগডাল থেকে
কিংবা যেইখানে গ্যাসের আলোয় রজনীতে
দু’-চারটে পার্শি শাড়ি কাঁপিতেছে বিধাতার শীতে
ঢের দূর অলিন্দের ‘পরে
বৃহস্পতি-নক্ষত্রের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে- স্বর্গীয় পাখি মোরা- দর্জিপাড়ার এই আঁধার চীবরে
তনু ঢেকে যেতে পারি না ক’ সেই মনোহীন শতভিষা-ভগ্নীদের কাছে কোনও দিন
উঁচু-উঁচু মাস্তুলে অনেক শোলার টুপি- আমাদের বিতর্কের পরে রোজ
টেনে দেয় গাঢ় অন্ধকার ড্রপ-সিন

শান্তি- শান্তি- কোথাও গরুর কলাই কিছু সিদ্ধ হয়ে আমাদের তরে যদি স্থির হয়ে থাকে
তা হলে কম্বল টেনে আবার কাটানো যাবে- মাছরাঙাদের মতো গর্তে- শীত-রাতটাকে
হয়তো-বা গান গা’বে বাইরের ট্রামগুলো
সময় যেতেছে- সময় যেতেছে ভেসে
শেচ-বিভাগের থেকে নতুন খসড়া পেয়ে হেসে
সমস্ত কচুরিপানা ঠেলে ফেলে জ্যোতির্ময় ইন্দ্রধনুকের দিকে নিরুদ্দেশে

এই সব মশকরা বুড়ো ট্রাম-ইয়ারের-
তাহলে শীতের রাত হল বেশ গভীর স্থগিত
পাঁচ লাখ ক্লোরোফর্ম-কেস হয়- পৃথিবীতে- রোজ রাতে- তাদের হৃদয়যন্ত্র ঠিক আছে- তারা কেউ ভীত
নয়।- কেন ভয়? দাহ করিবার আগে শুভ্র শক্ত শৃঙ্খলাতে মরাদের চুল আঁচড়ায়ে দেওয়া হয়
নতুন শিশুরা সব চ’লে আসে- খিড়কির দোর খুলে যত সব পুরোনো হাভাতে
হলুদ নদীর জলে লাফ দেয় হাঙরের গ্রাসে
তা না হলে তথাগত পাথরের বেদি থেকে নিজে নেমে আসে
নাও- নাও- তাড়াতাড়ি খিদিরপুরের পথে (ঘেমো ছেঁড়া) ফতুয়াটা গায়ে দিতে হয়
ভেবে দেখ তথাগত বেদি থেকে নেমে এল ঘোড়ার চাবুক হাতে
বিস্ময়- বিস্ময়- গভীর বিস্ময়।