সেদিন এ-ধরণীর

সে-দিন এ-ধরণীর
সবুজ দ্বীপের ছায়া- উতরোল তরঙ্গের ভিড়
মোর চোখে জেগে ধীরে-ধীরে হ’ল অপহত-
কুয়াশায় ঝ’রে-পড়া আতসের মতো!
দিকে-দিকে ডুবে গেল কোলাহল,
সহসা উজান জলে ভাঁটা গেল ভাসি,
অতি-দূর আকাশের মুখখানা আসি
বুকে মোর তুলে গেল যেন হাহাকার!
সেই দিন মোর অভিসার
মৃত্তিকার শূন্য পেয়ালার ব্যথা একাকারে ভেঙে
বকের পাখার মতো শাদা লঘু মেঘে
ভেসেছিল আতুর, উদাসী!
বনের ছায়ার নীচে ভাসে কার ভিজে চোখ
কাঁদে কার বাঁরোয়ার বাঁশি
সে-দিন শুনিনি তাহা,-
ক্ষুধাতুর দু’টি আঁখি তুলে
অতি-দূর তারকার কামনায় তরী মোর দিয়েছিনু খুলে!
আমার এ-শিরা-উপশিরা
চকিতে ছিঁড়িয়া গেল ধরণীর নাড়ীর বন্ধন-
শুনেছিনু কান পেতে জননীর স্থবির ক্ৰন্দন,
মোর তরে পিছু-ডাক মাটি-মা,- তোমার!
ডেকেছিল ভিজে ঘাস- হেমন্তের হিম মাস, জোনাকির ঝাড়!
আমারে ডাকিয়াছিল আলেয়ার লাল মাঠ- শ্মশানের খেয়া-ঘাট আসি!
কঙ্কালের রাশি
দাউ-দাউ চিতা-
কত পূর্বজাতকের পিতামহ-পিতা,
সর্বনাশ ব্যসন-বাসনা,
কত মৃত গোক্ষুরার ফণা,
কত তিথি, কত-যে অতিথি,
কত শত যোনিচক্রস্মৃতি
করেছিল উতলা আমারে!
আধো আলো- আধেক আঁধারে
মোর সাথে মোর পিছে এল তা’রা ছুটে
মাটির বাঁটের চুমা শিহরি উঠিল মোর ঠোঁটে- রোমপুটে!
ধু-ধু মাঠ- ধান-খেত- কাশ-ফুল- বুনো হাঁস- বালুকার চর
বকের ছানার মতো যেন মোর বুকের উপর
এলোমেলো ডানা মেলে মোর সাথে চলিল নাচিয়া!
-মাঝ-পথে থেমে গেল তা’রা সব,
শকুনের মতো শূন্যে পাখা বিথারিয়া
দূরে- দূরে- আরও দূরে- আরও দূরে চলিলাম উড়ে,
নিঃসহায় মানুষের শিশু একা, অনন্তের শুক্ল অন্তঃপুরে
অসীমের আঁচলের তলে!
স্ফীত সমুদ্রের মতো আনন্দের আর্ত কোলাহলে
উঠিলাম উথলিয়া দুরন্ত সৈকতে,
দূর ছায়াপথে!
পৃথিবীর প্রেত-চোখ বুঝি
সহসা উঠিল ভাসি তারকা-দর্পণে মোর অপহৃত আননের প্রতিবিম্ব খুঁজি!
ভ্রূণ-ভ্রষ্ট সন্তানের তরে
মাটি-মা ছুটিয়া এল বুক-ফাটা মিনতির ভরে,-
সঙ্গে নিয়ে বোবা শিশু- বৃদ্ধ মৃত পিতা
সূতিকা-আলয় আর শ্মশানের চিতা।
মোর পাশে দাঁড়াল সে গর্ভিণীর ক্ষোভে,
মোর দু’টি শিশু আঁখি-তারকার লোভে
কাঁদিয়া উঠিল তার পীন স্তন, জননীর প্রাণ।
জরায়ুর ডিম্বে তার জন্মিয়াছে যে-ঈপ্সিত বাঞ্ছিত সন্তান
তার তরে কালে-কালে পেতেছে সে শৈবাল-বিছানা, শাল-তমালের ছায়া।
এনেছে সে নব-নব ঋতু-রাগ- পউষ-নিশির শেষে ফাগুনের ফাগুয়ার মায়া!
তার তরে বৈতরণী-তীরে সে-যে ঢালিয়াছে গঙ্গার গাগরি,
মৃত্যুর অঙ্গার মথি স্তন তার বার-বার ভিজা রসে উঠিয়াছে ভরি।
উঠিয়াছে দূর্বা-ধানে শোভি,
মানবের তরে সে-যে এনেছে মানবী!
মশলা-দরাজ এই মাটিটার ঝাঁঝ যে রে-
কেন তবে দু’দণ্ডের অশ্রু- অমানিশা
দূর আকাশের তরে বুকে তার তুলে যায় নেশাখোর মক্ষিকার তৃষা!
নয়ন মুদিনু ধীরে- শেষ আলো নিভে গেল পলাতকা নীলিমার পারে,
সদ্য-প্রসূতির মতো অন্ধকার বসুন্ধরা আবরি আমারে।