রাজা ও ভিখারিণী


যে ঈশ্বর গড়িয়াছে তোমারে রাজন,
সে ঈশ্বর গড়িয়াছে অই ভিখারিণী!
যে ঈশ্বর গড়িয়াছে সমুদ্র ভীষণ,
সে ঈশ্বর গড়িয়াছে মহা মরুভূমি!
ক্ষুদ্র বালু কণা হতে হিমাদ্রি-শিখর,
অথবা সমুদ্র তলে জীব ক্ষুদ্র প্রাণ,
সকলের স্রষ্টা তিনি দয়ার সাগর,
ছোট বড় তার কাছে সকলি সমান!


এ সৌরজগত দেখ মেলিয়া নয়ন
কাহার মহিমা সদা করিছে প্রকাশ!
চন্দ্র, সূৰ্য, গ্রহ, তারা, নিখিল, ভুবন,
নদ-নদী গিরি-গুহ, সুনীল আকাশ!
জীব, জন্য, জল, বায়ু, অনন্ত প্রকৃতি,
আপন কর্ত্তব্য সবে করিয়া সাধন,
জাগায় মানব প্রাণে কার সুধাস্মৃতি,
বিপদে আপদে তোমাকে করে রক্ষণ!


তার এ ভাণ্ডারে আছে যে সব রতন,
সে সকলে সকলেরি সম অধিকার!
রাজায় প্রজায় নাহি ভেদ কখন,
তবে কেন মোহবশে এত অহঙ্কার?
ধনী ব’লে যত্ন করি পূর্ণ সুধাকর
বিতরে না বেশী সুধা তোমারে রাজন্‌!
কোকিল পাপিয়া শ্যামা বিহগ নিকর
শুধু তর কর্ণে সুধা করেনা বর্ষণ!


আপনি মানব হ’য়ে অপর মানবে
নৃশংসের প্রায় কেন দলিছ চরণে!
ধনের গৌরব তব কত দিন রবে?-
চিরকাল বেঁচে তুমি রবে কি ভুবনে?
আজি যে তোমার দ্বারে দুটি অন্ন তরে
জঘন্য দাসত্ব বৃত্তি করেছে গ্রহণ,
সংসারের আবর্ত্তনে কিছুদিন পরে
হতে পারে সে তোমার প্রভু শ্রেষ্ঠতম!


আজ যেই রাজপুত্র রত্ন অবনীর,
হতে পারে কালি সেই ভিখারী নির্ধন!
চির স্থির কভু নহে তটিনীর নীর,
বিধাতার চির নীতি উত্থান পতন!
কালি যে অরণ্য ছিল আজি সে নগর,
ভীষণ সমুদ্র আজি ঘোর মরুভূমি!
ছিল যেই মহামরু, আজি সে সাগর,
নিয়তির দাস সবি, কে তুমি, কে আমি?


ধনবল জনবল সব মিথ্য। ভবে,
আজি আছে কালি নাই সংসারের রীতি!
এ সংসারে চিরকাল কে রয়েছে কবে,
রাজা প্রজা সকলেরি শেষ এক গতি!
তব সনে ভবে তার পার্থক্য বিস্তর,
অরুচি তোমার ক্ষীর অমৃত মাখনে!
মুষ্টিমেয় শাক অন্নে সে পূরে উদর,
সে নিবসে তরুতলে, তুমি সিংহাসনে!


মাতৃ গর্ভ হতে বিশ্বে লভেছ জনম
একই বেশে তুমি আর অই ভিখারিণী!
শ্মশানে একই বেশে করিবে শয়ন
কোথা রবে তোমার এ ধন রত্নমণি?
তবে কেন অহঙ্কারে আত্মহারা তুমি
জীবনের পরিণাম ভেবেছ কি হায়!
শেষের সম্বল তব চারি হস্ত ভূমি,
অন্তিমে শুইবে যবে সে মহা শয্যায়!


উভয়ের মৃত দেহ রাখিলে শ্মশানে,
কে চিনিবে তুমি রাজা, সে যে ভিখারিণী?
রাজার কি চিহ্ন বল থাকিবে সেখানে,
কে চিনিবে সে দরিদ্রা, তুমি মহাধনী?
তোমার সে চিতা ভস্ম শ্মশান শয্যায়
মিশে যাবে ভিখারীর চিতা ভস্ম সনে!
উভয়ের এক গতি ধনী ব’লে হায়
রবেনা পার্থক্য কিছু সে মহা প্রাঙ্গনে!


সঙ্গে ত যাবেনা তব ধনী ব’লে কেহ,
কে করিবে সে সময় তোমার শুশ্রুষা!
কোথা র’বে দাস-দাসী, দারা-সুত-গেহ,
কোথা র’বে তোমার এ রাজবেশ-ভূষা?
কি পার্থক্য মৃত্যু কালে রত্ন সিংহাসনে
সুরভি কোমল স্নিগ্ধ কুসুমের স্তরে।
অথবা বিটপী তলে কণ্টক শয়নে,
দরিদ্র ভিক্ষুক বেশে মৃত্তিকার পরে!