শ্মশান সঙ্গীত


অই শোন মুর্খ নর, ভীষণ শ্মশানে,
কেজানি গাইছে অই মরণের গান!
প্লাবিয়া ধরণী, স্বর ছাইছে গগনে,
কঁপিয়া উঠিছে ভয়ে এ নির্জীব প্রাণ!
একভাবে দিবা নিশি গভীর নীরবে
গাইছে সঙ্গীত, জীব আত্মহারা প্রাণে
লক্ষ্য করি সেই স্বর, একে একে সবে
ছুটিয়াছে প্রতিপলে সে সঙ্গীত পানে!


প্রকৃতির মর্ম্মস্থলে পশি সেই রব,
কি এক গভীর তত্ত্ব করিছে বিকাশ!
প্রতি তান বিশ্বব্যাপী, অথচ নীরব,
নীরবে প্রাণের মাঝে মাখিয়া হুতাশ!
এ গানের তালত্রয় “সৃষ্টি-স্থিতি-লয়”
শূন্য-ফাঁক, জ্ঞানাতীত, রহস্য গভীর!
লয় সম, এই স্থান চির মোহময়,
অপূর্ণতা ঢেলে দেয় প্রাণে প্রকৃতির!


বধির মানব, তুমি শুনিবে কেমনে
সংসারের সুখে দুঃখে সদা মুগ্ধ মন!
দেখিলে না,- বুঝিলে না প্রকৃতি-নয়নে
কেন ঝরে অশ্রুবিন্দু শিশির-রতন!
আদি নাই, অন্ত নাই সদা এক ভাবে
কি যে গায়, জীবাত্মার বোধগম্য ভাষ!
দেখি না গায়কে, কিন্তু নীরবে নীরবে
ঢেলে দেয় এ পরাণে অনন্ত উদাস!


অই শোন জল নিধি শুনি সেই তান,
আপনার ক্ষীণকণ্ঠে মৃদু মৃদু গায়,
উলটি পালটি বিশ্ব, আত্মহারা প্রাণ,
অই কণ্ঠে নিজ কণ্ঠ মিশাইতে চায়!
পাপী মোরা,- তাই কাঁদি এই স্থানে আসি,
মনে পড়ে পিতা মাতা শৈশব সখায়!
মনে পড়ে প্রেয়সীর সুধা রূপরাশি,
লুকায়েছে চির তরে এ মহা শয্যায়!


হে হৃদয় শান্ত হও, জ্ঞানের নয়নে
চেয়ে দেখ এই বিশ্ব-সংসারের পানে,
আত্মার ভিতরে তব হবে অনুমান,
নীরব শ্মশানে উঠে কি সঙ্গীত তান!
সমুদ্রের পর প্রান্তে মলিন বদনে
চে’য়ে দে’খ ভানু যবে ধীরে ডুবে যায়-
প্রকৃতি কাঁদিয়া উঠে আকুল পরাণে,
দুর্ভেদ্য তিমির রাশি গ্রাসে এ ধরায়!


অথবা শ্মশান মাঝে কর্দ্দম শয্যায়
অই যে রে মানবের কঙ্কাল ভীষণ,
বৃষ্টিতে ভিজিয়া, দহি আতপ-শিখায়
আপনার ভাগ্য-লিপি করিছে স্মরণ!
অই যে দুর্ভাগা, অই বিটপীর তলে
-কুষ্টাক্রান্ত, বিকলাঙ্গ মুষ্টি ভিক্ষা আশে
বাপিয়া সমস্ত দিন, শোক-অশ্রুজলে
আসিতেছে, ক্ষীণ দেহ নিত্য উপবাসে!


অথবা মনের দুঃখে গভীর হতাশে
পিতৃ মাতৃ হীন অই শিশুর ক্রন্দনে,
যেই ভাব অশ্রু সহ গণ্ডদেশে ভাসে,
দেখিও, সে মহা তান পশিবে মরমে!
কিম্বা সুগভীর রাত্রে ঘোর নিরাশায়,
নিদ্রোথিত বিধবার শোক-তপ্ত-মনে
যে ঝঞ্চা বহিয়া যায়, মুহূর্ত্তেক হায়
ভাবিও হৃদয়ে, স্বর পশিবে শ্রবণে!


বুঝিবে তখন এ সঙ্গীত মহান
নিরাশ্রয় জীবাত্মার প্রেম-নিকেতন!
চির শান্তি সুখপূর্ণ এ নীরব তান,
জাগায় বিস্মৃত স্মৃতি, পবিত্র জীবন!
রবি শশী গ্রহ তারা অনন্ত গগন,
চেয়ে আছে এক প্রাণে সদা উর্দ্ধকাণ!
অই স্থানে জীবাত্মার পূর্ণ সংমিলন,
জীবনের শেষ স্মৃতি, মুক্তির সোপান!