কথোপকথন ১০

নন্দিনী
আকাশে নীলের উঁকি
অর্থাৎ পুজো এসে গেল।

শুভঙ্কর
পুজোয় বসার দিনও শেষ হয়ে এল।

নন্দিনী
কি পুজোর কথা বলছো?
দেব-দেবী ঠাকুর-দালান?
পাঁড় নাস্তিকের মুখে হঠাৎ এমন হরিনাম?

শুভঙ্কর
নাস্তিকেরও পুজো থাকে
নাস্তিকেরও না-ঈশ্বর থাকে।
চতুরঙ্গ পড়া আছে,
জ্যাঠামশায়েব কথা নিশ্চয় ভোলোনি।

নন্দিনী
ধাঁধার মতন করে কথা বলো কেন?
যখন কবিতা লিখবে, ওসব প্যাঁচানো বাক্য লিখো

শুভঙ্কর
আমার পুজোর মানে প্যান্ডেলে ধুনুচি-নৃত্য নয়।
আমার পুজোর মানে নিমগ্নতা
ব্যক্তিগত ধ্যান,
আত্মানুসন্ধান।
পুজো মানে জানা, বোঝা, পাঠ, অধ্যয়ন।
গ্রন্থের গভীরে বাস। রচনা, জীবনালেখ্য অথবা যে কোন
সৌধচূড়ার মতো নির্মাণ যা সৌররশ্মী ছড়ায় ছিটোয়
সে সবকে গাছপাকা ডালিমের মতো কুরে কুরে
আত্মসাৎ করা।

এত চটুলতা আজ বাতাসকে পাথর করেছে
যার চাপ বইতে গিয়ে পাজর কাৎরায়।
নন্দিনী, বিশ্বাস করো
নিজেকে নিয়ত এক নিঃসঙ্গ পথিক মনে হয়।
অন্য কারো কণ্ঠস্বরে আর গলা মলোতে পারি না

কোথাও কি কথা থেমে আছে?
নেই। তবু আজ
কথা যেন সাবানের ফেনার বুদবুদ।
কোথাও কি শব্দ থেমে আছে?
নেই। তবু আজ
চারিদিকে যত শব্দ, সব যেন দামী রেস্তোরাঁর
চিলি চিকেনের মতো মুহূর্তের সুখাদ্য শুধুই।
যত মত, তত যেন বন্দুক বারুদ।

নন্দিনী
আজীবন এক্সট্রিমিস্ট রয়ে গেলে তুমি।
যখন যেদিকে ঝোঁকো তাকেই পাহাড় করে তোল।
শূন্যতার ময়দাকে থেসে থেসে লুচি বানানোর
আত্মহননকারী খলোয় মেতেছ আজকাল।
অথচ স্বপ্নের ছিলে, স্বপ্নের বাগান ছিল চোখে,
কথা বলতে, খুলে যেত স্বপ্নের প্রকাণ্ড সিংহদ্বার।
শেক্‌সপিয়রের থেকে ধার করে এও বলতে পারি
তুমি ছিলে সেই সব ধাতু যাতে স্বপ্ন গড়া হয়।

জাহাজে নেই দিশারী কম্পাস
যখন আমি শূন্যতার পাকে,
খরার দিন, ক্ষতের রাতগুলো
স্বপ্ন ভরে দিয়েছ থাকে থাকে।

একটু ঝড়ে যখনই কুঁজো আমি
ঝাপটা হাওয়া যখনই ভাঙে বুক,
তোমার কাছে পেয়েছি অবিরত
পল্লবিত হওয়ার স্বপ্ন-সুখ।

ঘরের থেকে বেরোনো এক মেয়ে
যখন ফিরে গিয়েছে ঘরে তার,
শরীরে যেন দুকূল-ছাপা নদী
চেনা মন সেতারে ঝঙ্কার।

বদলে যাচ্ছো, বদলে যাচ্ছো রোজ
কেবলই ক্ষোভ, কেবলই অভিযোগ,
প্রবাহমান সময় থেকে শুধু
উকুন বাছা মস্ত একটা রোগ।

শুভঙ্কর
কী করে ভাবলে তুমি আমি স্বপ্নহীন?
স্বপ্নের মানদণ্ডে আজো এক হাতে ধরা আছে বলে
অন্য হাতে রাজদণ্ড তুলে নিতে পারি।

অজ্ঞতার জয়োল্লাসে যখন হাওয়ার গায়ে হাজারো ফাটল,
পথপ্রদর্শকরূপে যখন অন্ধকে দেখি সর্বাধিনায়ক,
তখনো আমার মুখে শুনতে চাও স্বপ্ন-উপাখ্যান?

নন্দিনী শোনা, জানি কাকে বলে স্বপ্ন,
অন্ধকারেও ফোটায় সূর্যমুখী তা।
কিন্তু আজ যে সূর্যমুখীরই রক্তে
শিকড় ছড়িয়ে দিয়েছে কুটীল ক্যানসার।

শুধু সোরগোল, শুধুই শব্দনিনাদে
চাপা পড়ে যায় মহৎ উচ্চারণেরা।
যেসব মানুষ পাহাড়চূড়োর উপমা
কুঠারে কুঠারে তাদের মূর্তি ছিন্ন।

আমার এসব আর্তিকে ছুঁড়ে ফেলে দাও।
তুমি নিজে যা যা দেখো, শোনো, মেতে থাকো বা
ঘাঁটাঘাঁটি করো, তাদের বলতে পারবে
‘অমৃত পেয়েছি’, মৈত্রেয়ী বলেছিল যা?

নন্দিনী
সারেন্ডার, শুভঙ্কর সারেন্ডার।
তবু বলছি শোনো।
তাণ্ডবের নটরাজ ছাই-পাঁশ মাখা শিব হবে
দেখতে আমি চাইব না কখনো।