কথোপকথন ১৫

নন্দিনী
এখন রাত ঠিক সাড়ে দশটা। কত্তা আজ ফিরবেন না। জরুরি কাজে জামসেদপুরে। মেয়ে ঘুমিয়েছে। নাক ডাকছে পাশের ঘরে। কণিকার গান শুনিনি কতদিন। একটু আগে। ক্যাসেট ভরে দিয়েছি প্লেয়ারে। আলো নেভানো। বিছানায়। এলোচুল। বুকে বালিশ। যেন ভাসছি অথৈ সমুদ্রের দিকচিহ্নহীনতায়। অনেকদিন পরে এই ডুব। গানগুলোকে আয়নার মতো সামনে রেখে বসেছি প্রসাধনে। পরতে নয়, খুলতে। সাজতে নয়, ছিঁড়তে। মুঠোয় নয়, ছুরিটা মনের খাপে। নিজেকে দেখার সাধ। কিছু রক্ত তো গড়াবেই।

কত কালের সকাল-সাঁঝে
তোমার চরণধ্বনি বাজে,
গোপনে দূত হৃদয় মাঝে
গেছে আমায় ডেকে।

এখনো ঘুমোওনি, জানি। কি করছ? পড়ছ নিশ্চয়ই। কার বই? আমার ব্যাগ থেকে ছিনিয়ে নিলে মিরোশ্লাভ হােলুবের শ্রেষ্ঠ কবিতা। সেটাই? নাকি টমাস মানের চিঠি পত্র? আমিও বই নিয়ে শুয়েছিলাম। চেকভের নাটক। দুচার পাতা পড়েই বন্ধ। আজকাল কি যে হয়েছে! যে কোন বই পড়তে পড়তে যেই না নক্ষত্রের ঝলক তুলল কোন কথা, মরা তাপ লাফিয়ে ওঠে বুকে। জ্যান্ত হয়ে যাই হঠাৎ। শুনি ভিতরের গুরগুর শব্দ। নিজের হারানো কথার খোঁজে হাতড়াতে থাকি দশদিকের শূন্যতা। আসলে নিজের অপচয়কে চিনতে চাওয়া।

পুষ্প বিকাশের সুরে
দেহমন উঠে পুরে
কী মাধুরী সুগন্ধ
বাতাসে যায় ভাসি।

অতীতে হঠাৎ বর্তমানের দরজা খুলে সামনে। চোখ ঝলসে যায় এমন রূপ। তাই নাকি? এত মণিমুক্তার জড়োয়ায় জড়ানো ছিল অতীত? কোথায় ছিল এত ধান শীষ, রোদের তিলক পরা? এত চাঁপার কলির উচ্ছাস তার যে কোন ভঙ্গীমায়? কী ঝকঝকে চোখ। যেন অনিদ্রার নামই শোনেনি কখনো। কত বছরের পুরনো ওড়না, কী মসৃণ তবু। যেন ছিঁড়বার কাঁটা পথ আগলায়নি কখনো। তাহলে সেইসব নখ আর দাঁতের কটকটে ছায়াগুলো গেল কোথায়, যাদের তাড়ায় হাত-পা ছড়িয়ে বসতে পারি নি কোথাও? তাহলে কোথায় গেল মুখোশ পরা সেই হাওয়া, ঝাঁকে ঝাঁকে যার দিকে ছুটে গেছে বিক্ষোভের প্রহর? বন্দুকের শব্দগুলোই বা কোথায়? কোথায় মিশে গেল কামান-ফাটানো নিষেধের ‘না’ ‘না’? সবই যদি ছিল তকতকে মাজা বাসন, তাহলে রাতগুলো কেন ভিজে যেত অঝোর বৃষ্টি-বাদলে?

উন্মাদ পবনে যমুনা তর্জিত,
ঘন ঘন গর্জিত মেহ।
দমকাত বিদ্যুত, পথতরু লুণ্ঠিত,
থরথর কম্পিত দেহ।

আজকের এই রাতটা ফুরালে কাল এটাও হয়ে যাবে অতীত। বদলে যাবে নিমেষে। মিশে যাবে বরাভয় মুদ্রার মতো কোন অসীম চিহ্নে। দুবছর পরে আবার যখন ডাক পড়বে সাক্ষী দেওয়ার, তখন এরই গায়ে ঝলসাবে পূর্ণিমার আভা। অথচ সত্যি কি তাই? আজকের এই রাতের কোনখানেই তো নেই যোজনগন্ধা প্রান্তরের চলচ্চিত্র। সব তো নিঃসাড় এখানে। সব তো গভীর কূপের ভয়ঙ্কর কালো জলের মতো স্থির। ভাসছি কেবল একা আমি। বিছানায়। শোবার খাটে। বড় গাছের মচকানো ডাল। কিংবা পচে যাওয়া প্রকাণ্ড গুঁড়ির ভগ্নাংশ। ড্রেসিং টেবিল, ফ্রীজ, ওয়ার্ডরোব, টিউবলাইট, ব্রোঞ্জের নটরাজ, মাটির বুদ্ধ, রাজস্থানের টেরাকোটা, কাশ্মিরী কার্পেট, কত মায়া দিয়ে ঘিরে রেখেছে। তবুও পরবাস। তবুও আমি অন্য কোথাও।

ভরাব না ভূষণ ভারে,
সাজব না ফুলের হারে-
প্রেমকে আমার মালা করে
গলায় তোমার দোলাব।

ঠিক কী ভাবছি এখন বলতে পারবে? না। আমিও পারব না। আমি এখন ভাসতে ভাসতে স্থির। স্থিরতার ভিতরেই আমার সাঁতার। সাঁতার মানে প্রশ্ন। প্রশ্ন মানে পাওয়া না- পাওয়ার হিসেব। যোগফল মিলবে না জেনেও হিসেব। যেমন ধরো আমার এই সংসারের হিসেবে তুমি কোথাও নেই। অথচ একান্ত আমার জীবনের গোটা আকাশটাই তুমি। ধরো এই গানগুলোকেই। আমার কাছেই শুধু তুফান। লুকোনো আলোর ভাঁজ খোলা। যেন আত্মপরিচয়ের পাসপোর্ট। আত্মনির্মাণেরও উপকরণ যেন ঢেউ তুলে তুলে সামনে। অথচ শাশুড়ি শোনেন না। ঠাকুরদেবতার গান ছাড়া রস পৌঁছায় না কানে। অন্যেরা বলবে, কী বাবা একঘেঁয়ে নাকি কান্না আর ও বলবে, কী এত মৌরি-মিছরি পাও এই ঘ্যানঘ্যানানিতে?

দক্ষিণ সমীরে দূর গগনে
একলো বিরহী বুঝি গাহে গো।
কুঞ্জবনে মোর মুকুল যত
আবরণ বন্ধন ছিঁড়িতে চাহে।

আমার বুক ভাসিয়ে জলের মতো নেমে আসছে শিকড়। আমার নিজস্ব শিকড় ভেসে যাচ্ছে জলের থাবায়। আমি পালকের মতো পলকা। অথচ দুহাত ভর্তি ভারী পশম। এই পশমগুলো হারিয়ে যায় যখন তখন। কেবল গান হলেই ফিরে আসে। মুখের দিকে তাকায়। হাতের ভিতরে কই-মাগুরের ঝাপটা তোলে। কখন বুনবে? কখন বানাবে? বলেছিলে বদলিয়ে দেবে আমাদের। বলেছিলে আঙুরের মতো ফোটাবে। পালটিয়ে দেবে আমাদের হিজিবিজি হয়ে থাকা। বাইরে হাওয়া উঠল বোধ হয়। সন্ধ্যে থেকে মেঘ। এবার হয়তো নামবে বৃষ্টিও। কালকের মতো, পরশুর মতো, ঝমাঝম। পর্দা উড়ছে জানলার। সরাব না। জানলার কাচে ধাক্কা। ভেজাব না। মশারিটা ছিড়ে ফেলতে চাইছে নিজের খোপ। উঠব না। আমি এখন গান। ভরাট এক সুর। খুলছে আমার গুটোনো ডানা। রাজেন্দ্ৰনন্দিনী হয়ে যাচ্ছি নিমেষে নিমেষে বদলে বদলে। এখন যদি আমাকে দেখতে তুমি শুভঙ্কর! তোমাকে দেখাতে পারতাম যদি।