ব্রাহ্মণ

অন্ধকার বনচ্ছায়ে সরস্বতীতীরে
অস্ত গেছে সন্ধ্যাসূর্য্য; আসিয়াছে ফিরে
নিস্তব্ধ আশ্রম-মাঝে ঋষিপুত্রগণ
মস্তকে সমিধ্ভার করি আহরণ
বনান্তর হতে; ফিরায়ে এনেছে ডাকি
তপোবন-গোষ্ঠগৃহে স্নিগ্ধশান্ত-আঁখি
শ্রান্ত হোমধেনুগণে; করি সমাপন
সন্ধ্যাস্নান, সবে মিলি লয়েছে আসন
গুরু গৌতমেরে ঘিরি কুটীরপ্রাঙ্গণে
হোমাগ্নি-আলোকে। শূন্যে অনন্ত গগনে
ধ্যানমগ্ন মহাশাস্তি; নক্ষত্রমণ্ডলী
সারি সারি বসিয়াছে স্তব্ধ-কুতূহলী
নিঃশব্দ শিষ্যের মতো। নিভৃত আশ্রম
উঠিল চকিত হয়ে; মহর্ষি গৌতম
কহিলেন, “বৎসগণ, ব্রহ্মবিদ্যা কহি,
কর অবধান।”

হেনকালে অর্ঘ্য বহি
করপুট ভরি’, পশিলা প্রাঙ্গণতলে
তরুণ বালক; বন্দি’ ফলফুলদলে
ঋষির চরণপদ্ম, নমি ভক্তিভরে
কহিলা কোকিলকণ্ঠে সুধাস্নিগ্ধ স্বরে,
“ভগবন্, ব্রহ্মবিদ্যা-শিক্ষা-অভিলাষী
আসিয়াছি দীক্ষা-তরে কুশক্ষেত্রবাসী
সত্যকাম নাম মোর।”

শুনি স্মিতহাসে
ব্রহ্মর্ষি কহিলা তারে স্নেহশান্ত ভাষে,
“কুশল হউক সৌম্য। গোত্র কি তোমার
বৎস, শুধু ব্রাহ্মণের আছে অধিকার
ব্রহ্মবিদ্যালাভে।”

বালক কহিলা ধীরে,
“ভগবন্, গোত্র নাহি জানি। জননীরে
শুধায়ে আসিব কল্য কর অনুমতি।”

এত কহি ঋষিপদে করিয়া প্রণতি
গেল চলি সত্যকাম, ঘন-অন্ধকার
বনবীথি দিয়া পদব্রজে হয়ে পার
ক্ষীণ স্বচ্ছ শান্ত সরস্বতী- বালুতীরে
সুপ্তিমৌন গ্রামপ্রান্তে জননীকুটিরে
করিলা প্রবেশ।

ঘরে সন্ধ্যাদীপ জ্বালা;
দাঁড়ায়ে দুয়ার ধরি জননী জবালা
পুত্রপথ চাহি; হেরি তারে বক্ষে টানি
আঘ্রাণ করিয়া শির কহিলেন বাণী
কল্যাণকুশল। শুধাইলা সত্যকাম,
“কহ গো, জননী, মোর পিতার কী নাম,
কি বংশে জনম? গিয়াছিনু দীক্ষা-তরে
গৌতমের কাছে; গুরু কহিলেন মোরে,
বৎস, শুধু ব্রাহ্মণের আছে অধিকার
ব্রহ্মবিদ্যালাভে। মাতঃ, কী গোত্র আমার?”

শুনি কথা, মৃদুকণ্ঠে অবনতমুখে
কহিল জননী, “যৌবনে দারিদ্র্যদুখে
বহুপরিচর্যা করি পেয়েছিনু তোরে,
জন্মেছিস ভর্তৃহীনা জবালার ক্রোড়ে-
গোত্র তব নাহি জানি, তাত!”

পরদিন
তপোবনতরুশিরে প্রসন্ন নবীন
জাগিল প্রভাত; যত তাপসবালক
শিশিরসুস্নিগ্ধ যেন তরুণ আলোক,
ভক্তি-অশ্রু-ধৌত যেন নব পুণ্যচ্ছটা,
প্রাতঃস্নাত স্নিগ্ধচ্ছবি আর্দ্রসিক্তজটা
শুচিশোভা সৌম্যমূর্তি সমুজ্জ্বলকায়ে
বসেছে বেষ্টন করি বৃদ্ধবটচ্ছায়
গুরু গৌতমেরে। বিহঙ্গকাকলীগান,
মধুপগুঞ্জনগীতি, জলকলতান,
তারি সাথে উঠিতেছে গম্ভীর মধুর
বিচিত্র তরুণকণ্ঠে সম্মিলিত সুর
শান্ত সামগীতি।

হেন কালে সত্যকাম
কাছে আসি ঋষিপদে করিলা প্রণাম-
মেলিয়া উদার আঁখি রহিল নীরবে।
আচার্য্য আশিষ করি শুধাইলা তবে,
“কী গোত্র তোমার সৌম্য, প্রিয়দরশন?”

তুলি শির কহিলা বালক, “ভগবন্,
নাহি জানি কী গোত্র আমার। পুছিলাম
জননীরে; কহিলেন তিনি, সত্যকাম,
বহু পরিচর্যা করি পেয়েছিনু তোরে,
জন্মেছিস ভর্তৃহীনা জবালার ক্রোড়ে-
গোত্র তব নাহি জানি।”

শুনি সে বারতা
ছাত্রগণ মৃদুস্বরে আরম্ভিল কথা,
মধুচক্রে লোষ্ট্রপাতে বিক্ষিপ্ত চঞ্চল
পতঙ্গের মতো- সবে বিস্ময়বিকল,
কেহ বা হাসিল, কেহ করিল ধিক্কার
লজ্জাহীন অনার্যের হেরি অহংকার।

উঠিলা গৌতম ঋষি ছাড়িয়া আসন;
বাহু মেলি বালকেরে করি আলিঙ্গন
কহিলেন, “অব্রাহ্মণ নহ তুমি, তাত,
তুমি দ্বিজোত্তম, তুমি সত্যকুলজাত!”

৭ ফাল্গুন, ১৩০১