কবর-ই-নূরজাহান্

“বব্ ম্যজারে মা গরীবী ন্যঃ চেরাগে ন্যঃ গুলে!
ন্যঃ পরে পরমানা সুজদ্ ন্যঃ স্যতায়ে বুল্বুলে।।”

আজকে তোমায় দেখতে এলাম জগৎ-আলো নূরজাহান্!
সন্ধ্যা-রাতের অন্ধকার আজ জোনাক-পোকায় স্পন্দমান।
বাংলা থেকে দেখতে এলাম মরুভূমির গোলাপ ফুল,
ইরান দেশের শকুন্তলা! কই সে তোমার রূপ অতুল?
পাষাণ-কবর-বোরকা খোলল দেখব তোমায় সুন্দরী!
দাঁড়াও শোভার বৈজয়ন্তী ভুবন-বিজয় রূপ ধরি।
জগৎ-জেতা জাহাঙ্গীরের জগৎ আজি অন্ধকার,
জাগ তুমি জাহান্-নূরী আলোয় ভর দিক আবার;
কর গো হতশ্রী ধরায় রূপের পূজা প্রবর্ত্তন-
কত যুগ আর চলবে অলীক পরীর রূপের শব-সাধন?
জাগাও তোমার রূপের শিখা, মরে মরুক পতঙ্গ;
রতির মূরতিতে জাগ, অঙ্গ লভুক অনঙ্গ।
রূপের গোলাপ রোজ ফোটে না বুলবুলে তা জানে গো,
গোলাপ ঘিরে পরস্পরে তাই তারা ঠোঁট হানে গোন গো;-
তুচ্ছ রূপার তরে মানুষ করছে কত দুষ্কৃতি,
রূপের তরে হানাহানি, তার চেয়ে কি বদ্ রীতি?
খনির সোনা নিত্য মেলে হাট বাজারের দুইধারে,
রূপের সোনা রোজ আসে না, বেচে না সে পোদ্দারে।
* * * *
রূপের আদর জান্ত সেলিম, রূপ-দেবতায় মান্ত সে;
সোনার চেয়ে সোনা মুখের ঢের বেশী দাম জান্ত সে;
বিপুল ভারত-ভূমির সোনা সঞ্চিত তার ভাণ্ডারে
তবুও কেন ভরল না মন? হায় তৃষিত চায় কারে?
তোমার সোনা মুখটি স্মরি’ পাগল-সমতুল্য সে,
রূপের ছটায় ঝলসেছে চোখ পুণ্য পাতক ভুল্ল সে,
রক্ত-সাগর সাঁৎরে এসে দখল পেল পদ্মটির
রূপের পাগল, রূপের মাতাল, রূপের কবি জাহাঙ্গীর।-
টাকশালে সে হুকুম দিল তোমায় পেয়ে পূর্ণকাম।
“টাকায় লেখ জাহাঙ্গীরের সঙ্গেতে নূরজাহাঁর নাম।”
মোহরে নাম উঠল তোমার, লেখা হ’ল তায় শ্লোকে,-
“সোনার হ’ল দাম শতগুণ নূরজাহানের নাম যোগে।”
* * * *
মরুভূমির শুষ্ক বুকে জন্মেছিলে সুল্তানা!
গরীব বাপের গরব-মণি সাপের ফণা আস্তানা।
তোমায় ফেলে আস্ছিল সব, আসতে ফেলে পারল কই?
দৈন্য দশার নির্মমতা টিকল না দু’দণ্ড বই।
জয়ী হ’ল মায়ের অশ্রু, টলে গেল বাপের মন,
ফেলে দিয়ে কুড়িয়ে নিল স্নেহের পুতুল বুকের ধন।
মরুভূমির মেহেরবানী। তুমি মেহের-উন্নিসা!
তোমায় ঘিরে তপ্ত বালুর দহন চির-দিন-নিশা!
পথের প্রসূন! তোমার রূপে দুর্নিয়তি আকৃষ্ট-
ফেলে-দেওয়া কুড়িয়ে-নেওয়া এই তত তোমার অদৃষ্ট!
* * * *
দিনে দিনে উঠলে ফুটে পরীস্থানের জরীন্ গুল!
মলিন করে রূপ রাণীদের ফুল তোমার রূপের ফুল।
রূপে হলে অপ্সরী আর নৃত্যগীতে কিন্নরী,
শ্লোক-রচনায় সরস্বতী ধী-শ্ৰীমতী সুন্দরী,
তীর ছোড়া আর ঘোড়ায় চড়ায় জুড়ি তোমার রইল না,
এমন পুরুষ ছিল না যে মূরত বুকে বইল না।
রূপের গুণের খ্যাতি তোমার ছাইল ক্রমে সব দিশা,
নারীকুলের সূৰ্য্য তুমি, তুমি মেহের-উন্নিসা!
বাদশাজাদা দেখল তোমায়- দেখ্ল প্রথম নওরোজে,
খুসী দিলের খুস্রোজে তার জীবন মরণ দুই যোঝে।
খস্ল হঠাৎ ঘোমটা তোমার সরম-রাঙা মুখখানি
একে গেল যুবার বুকে রূপরাণী গো রূপরাণী!
বাদ্শাজাদা চাইল তোমায়, বাদশা হ’লেন তায় বাদী;
শের আফগানের বিবি তুমি হ’লে অনিচ্ছায় কাঁদি।
বাঘ মারে শের শুধু হাতে তোমায় পাওয়ার হর্ষে গো,
বর্দ্ধমানের মাটি হ’ল রাঙা তোমার স্পর্শে গো।
* * * *
দিনের পরে দিন গেল টের ছটা ঋতুর ফুল-বোনা,
বাদ্শাজাদা বাদ্শা হ’ল তোমায় তবু ভুলল না;
অন্যায়ের সে বৈরী চির ভুল হঠাৎ ধৰ্ম্ম-ন্যায়
ডুবে ভেসে তলিয়ে গেল রূপের মোহের কি বন্যায়!
কুচক্রে তার প্রাণ হারাল সরল পাঠান মহাপ্রাণ।
উদারচেতা সিংহ-জেতা সিংহ-তেজা শের আফগান;
সেলিমের দুধ-মায়ের ছেলে সুবাদারীর তৃষ্ণাতে
মারতে এসে পড়ল মারা শেরের অসি-সংঘাতে;
তেজস্বী শের ঘৃণ্য কুতব পাশাপাশি ঘুমায় আজ
রাঢ়ের মাটি রাঙিয়ে দ্বিগুণ জাগছে জাহাঙ্গীরের লাজ!
সকল লজ্জা ডুবিয়ে তবু জাগছে নারী, তোমার জয়!
সকল ধনের সার যে তুমি, রূপ সে তোমার তুচ্ছ নয়।
* * * *
পাল্কী এল “আগ্রা চল”- শাহানশাহের অন্দরে,
কাছে গিয়ে দেখ্লে তফাৎ, আঘাত পেলে অন্তরে।
মহলে কই বাদশা এলেন? মৌনে ব্যথা সইলে গো,
চোদ্দ আনা রোজ খোরাকে রং-মহলে রইলে গো।
রেশমী পটে নক্সা এঁকে, গড়ে ফুলের অলঙ্কার,
বাঁদী দিয়ে বিক্রি ক’রে হ’ত তোমার দিন-গুজার;
সাদা-সিধা সুতির কাপড় আপনি পরে থাক্তে গো,
চাকরাণীদের রাণীর সাজে সাজিয়ে তুমি রাখ্তে গো।
স্পর্শে তোমার জুঁই-বুরুজের শিলায় শিলায় ফুট্ল ফুল,
রূপে গুণে ছাপিয়ে গেল রং-মহলের উভয় কূল।।
* * * *
কথায় বলে মন না মতি,- সেলিমের মন ফিরল শেষ,-
হঠাৎ তোমার কক্ষে এল, দেখ্ল তোমার মলিন বেশ;
দেখ্ল তোমার পুষ্প-কান্তি, দেখ্ল জ্যোতির পুঞ্জ চোখ,
ভুলে গেল খুনের আড়াল, ভুল সে দুধ-ভায়ের শোক।
বাদ্শা সুধান্ “এ বেশ কেন? নিজের দাসীর চাইতে ম্লান!
জবাব দিলে “আমার দাসী-সাজাই যেমন চায় পরাণ।
তোমার দাসীর অঙ্গে খামিন্! তোমার খুসীর মতন সাজ।”
বাদশা বলেন “সত্যি কথা, দিলে আমায় উচিত লাজ,
আজ অবধি প্রধান বেগম তুমি মেহের! সুন্দরী!
চল আমার খাসমহলে মহল-আলো অপ্সরী।
সিংহাসনে আসন তোমার, আজ থেকে নাম নূরমহল,
বাদ্শা তোমার গোলাম, জেনে, করেছ তার দিল্ দখল।”
* * * *
পাঁচ-হাজারের এক এক মোতি, এম্নি হাজার মোতির হার
বাদ্শা দিলেন কণ্ঠে তোমার সাত-সাগরের শোভার সার।
বাদ্শার উপর বাদ্শা হ’লে, বাদ্শা হ’লেন তোমার বশ,
অফুরাণ যে স্ফুর্ত্তি তোমার, অগাধ তোমার মনের রস।
দরবারে বার দিলে তুমি রইলে নাকো পৰ্দ্দাতে,
জাহাঙ্গীর সে রইল শুধু ব্যস্ত তোমার চর্চাতে।
পিতা তোমার মন্ত্রী হ’লেন, তুমি আসল শাহান্শা,
সেনা-নায়ক ভাইটি তোমার যোদ্ধ কবি আসফ জা।
দেশে আবার শান্তি এল ভারত জুড়ে মহোৎসব-
বাড়ল ফসল শিল্প-কুশল হ’ল ফিরে শিল্পী সব।
নূতন কত শিল্প প্রচার করলে ভারত মণ্ডিতে-
ফুলের আত্মা আতর হ’ল অমর হ’ল ইঙ্গিতে!
তুমি গো সাম্রাজ্য-লক্ষ্মী কৰ্ম্মে সদা উৎসাহী
জাহাঙ্গীরের পাঞ্জা নিয়ে করলে নারী বাদসাহী;
নারীর প্রতাপ, প্রতিভা আর নারীর দেখে মন্ত্রবল
দরবারী সব চটল মনে, উঠল জ্বলে ওমরাদল;
বাদ্শাজাদা খুরম্ এবং দশহাজারী মহব্বৎ
বিষম হ’ল বৈরী তোমার তবুও তুমি সূৰ্য্যবৎ
রইলে দীপ্ত, রইলে দৃপ্ত করলে নিরোধ সব হানা
ধী-শ্রী-ছটার ছত্র মাথায় ছত্রবতী সুল্তানা!
বাদ্শা যখন নজর-বন্দী মহব্বতের ফন্দীতে
চললে তুমি সিংহী সম চলে স্বয়ং রণ দিতে;
হাতীর পিঠে হাওদা এটে ঝিলাম-নদের তরঙ্গে
ঝাণ্ডা তুলে লড়তে এলে মাতলে তুমি কী রঙ্গে;
শত্রু মেরে করলে খালি তীরে-ভরা তিন্টে তূণ,
আঘাত পেয়ে কর্ণে কাঁধে যুঝলে তবু চতুর্গুণ;
দুষমনেরা উঁচু ডাঙায়, তুমি নদীর গর্ভে গো,
তোমার হানায় অধীর তবু ভাবছে কি যে করবে গো;
হঠাৎ বেঁকে বস্ল হাতী বিমুখ হ’ল অস্ত্র-ঘায়
ফিরলে তুমি বাধ্য হয়ে ক্ষুব্ধ রোষের যন্ত্রণায়।
বন্দী স্বামীর মোচন-হেতু হ’লে এবার বন্দিনী,
মহব্বতের মুঠা শিথিল করলে ইরাণ-নন্দিনী;
জিতে তবু হারল শত্ৰু, করলে তুমি কিস্তিমাৎ,
তোমার অস্ত্র আমোঘ সদা, তোমার অস্ত্র সে নির্ঘাত;
ফকীর-বেশে শত্রু পালায়, তোমার হ’ল জয় শেষে,-
তোড়ে তোমার ঐরাবত ঐ মহব্বত-খা যায় ভেসে।
* * * *
আজ লাহোরের সহরতলীর কাটাবনের আব্ডালে
লুপ্ত তোমার রূপের লহর জঙ্গলে আর জঞ্জাল,
জীর্ণ তোমার সমাধি আজ, মীনার বাহার যায় ঝরি’,
আজকে তুমি নিরাভরণ চিরদিনের সুন্দরী!
হোথা তোমার স্বামীর সমাধ যত্নে তোমার উজল ভায়
ঝল্মলিছে শাহ-ডেরা রতন-মণির আল্পনায়।
গরীব বাপের গরীব মেয়ে তুমি আছ এক্লাটি,-
সিংহাসনের শোভার নিধি পালং তোমার আজ মাটি!
শাহ-ডেরার সুপ্ত মালিক জেগে তোমায় ডাক্ছে না,
তুমি যে আর নাইকো পাশে সে খোঁজ সে আজ রাখ্ছে না
সূক্ষ্ম সোনার সূতায় বোনা নাই সে গদি তোমার হায়!
আজকে তোমার বুকে পাথর, মাথায় পাথর, পাথর পায়।
বিস্মরণী লতার বনে ঘুমাও মাটির বন্ধনে,
গোরী! তোমার গোরের মাটি রূপের গোপীচন্দন এ।
সোহাগী! তোর দেহের মাটি স্বামী-সোহাগ সিঁদূর গো,
জীর্ণ তোমার শ্রীহীন কবর বিশ্বনারীর শ্ৰ-দুর্গ!
* * * *
শিয়রে কি লিখন লেখা! অশ্রুভরা করুণ শ্লোক,-
এ যে তোমার দৈববাণী জাগায় প্রাণে দারুণ শোক;-
হে সুলতানা! লিখেছ এ কী আফশোষে সুন্দরী!
লিখছ তুমি “গরীব আমি” পড়তে যে চোখ যায় ভরি।
“গরীব-গোরে দীপ জ্বেল না ফুল দিয়ে না কেউ ভুলে-
শামা পোকার না পোড়ে পাখ, দাগা না পায় বুল্বুলে।”
সত্যি তোমার কবরে আর দীপ জ্বলে না, নূরজাহান!
সত্যি কাঁটার জঙ্গলে আজ পুষ্পলতার লুপ্তপ্রাণ।
নিঃস্ব তুমি নিরাভরণ ধূসর ধূলির অঙ্কেতে,
অবহেলার গুহার তলায় ডুব্ছ কালের সঙ্কেতে।
ডুব্ছে তোমার অস্থিমাত্র- স্মৃতি তোমার ডুব্বে না,
রূপের স্বর্গে চিরনূতন রূপটি তোমার যায় চেনা।
সেথায় তোমার নাম ঘিরে ফুল উঠছে ফুটে সৰ্ব্বদাই,
অনুরাগের চেরাগ যত উজল জ্বলে বিরাম নাই,
চিত্ত-লোকে তোমার পূজা- পূজা সকল যুগ ভরি’
মোগল-যুগের তিলোত্তমা! চিরযুগের সুন্দরী!