ভাটির চিঠি

দয়াল নাম ভরসা করে আরম্ভ করলাম।
রচনায় দ্বিপদী ছন্দ ধরলাম।।
ছন্দ যে হলো আমার জীবনের সাথি।
সুর তাল ছন্দে আমি কথার মালা গাঁথি।।
সুর তাল ছন্দে যখন গান গেয়ে যাই।
আমার মনের কথা ছন্দে বলতে চাই।।

বৃহত্তর সিলেটের সুনামগঞ্জ জেলায়।
জন্ম নিয়ে লেগে গেলাম ভবের খেলায়।।
ইহলোকে সুখ-দুঃখে কাঁদায়-হাসায়।
বসত করি হাওরমাতৃক ভাটি এলাকায়।।
পল্লীগ্রামে বসত করি উজানধল ঠিকানা।
পোস্ট অফিস ধলবাজারে দিরাই হলো থানা।।
গরিব কৃষক পরিবারে জন্ম নিলাম।
জন্মগত প্রতিবাদী আমি ছিলাম।।
তেরশো বাইশ বাংলায় জন্ম আমার।
মা বলেছেন ফাল্গুন মাসের প্রথম মঙ্গলবার।।
পিতা-মাতা রেখেছিলেন আবদুল করিম নাম।
জানি না কেন যে বিধি হলো বাম।।
এই দুঃখ কার কাছে কী বলি বলো না।
ইশকুলে লেখাপড়া করা মোর হলো না।।
সমাজ ব্যবস্থা আমার পক্ষে ছিল না।
তাই তো আমার খবর কেউ যে নিল না।।
এই ভবে লক্ষ লক্ষ করিম জন্ম নিল।
এ ব্যবস্থা তাদেরেও নিঃস্ব করে দিল।।
ভাটি অঞ্চলে হলো আমার জন্মস্থান।
গাই সদা জনগণের সুখ-দুঃখের গান।।
বাউলরেশে এই দেশে কত গান গেয়েছি।
মানুষের ভালোবাসা-আশীর্বাদ পেয়েছি।।

ভাটির চিঠি লিখবো বলে মনে যখন চায়।
মনের কথা প্রকাশ করি গ্রামের ভাষায়।।
জ্ঞানী গুণী সুধীসমাজ যারা গণ্যমান্য।
তুলে ধরি সকলের অবগতির জন্য।।
জন্ম নিয়ে এই অঞ্চলের খবর শুনলাম।
পূর্বে এখানে সাগর ছিল কালীদহ নাম।।
নৌকা কুন্দা বাইয়া মানুষ করত আসা যাওয়া।
লোকে বলে, ছিল তখন লাউড়ে-গৌড়ে খেওয়া।।
আকাশ হতে পাহাড়েতে নামে যখন ঢল।
পলি মাটি সঙ্গে নিয়ে নিচে নামে জল।।
পাহাড়ি পলিমটি নিচে এসে পড়ে।
সাগরের তলদেশ ধীরে ধীরে ভরে।।
জানি না কত দিনে ভরাট হয়েছে।
এখনো মধ্যে মধ্যে গভীর রয়েছে।।
সাগর ভরাট হয়ে হইল জঙ্গল।
কৃষক মজুরের শ্রমে হইল মঙ্গল।।

জীবিকা নির্বাহের জন্য কৃষক মজুরগণ।
জঙ্গল কাটিয়া করে বসতি স্থাপন।।
উঁচু জয়গাগুলোতে হলো গ্রাম-ঘর।
নিচু স্থানগুলোর নাম হইল হাওর।।
গ্রামের কাছে নিচু জায়গার নাম হয় ঝিল।
গভীর জলাশয়গুলোর নাম হয়েছে বিল।।
ভরাট অঞ্চলে হলো হাজার হাজার গ্রাম।
ভাটি দেশ বলে হলো এই এলাকার নাম।।
হবিগঞ্জ সুনামগঞ্জ জেলার ষোলোআনা।
নেত্রকোনা কিশোরগঞ্জ নিয়ে সীমানা।।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সঙ্গে রয়েছে।
পাঁচটি জেলার সমন্বয়ে ভাটি দেশ হয়েছে।।
জঙ্গল কেটে আবাদ করে মেহনতি সকল।
যেখানে ফলে আজ সোনালি ফসল।।
পলি মাটি এলাকায় মাটিতে রয় বল।
কৃষকে জমিতে পাইত ভালো ফল।।
বসত করে কৃষক মজুর হিন্দু-মুসলমান।
এই এলাকা হয় খাদ্য উৎপাদনের স্থান।।
বন্যার জলে ফসল নিলে কেউ কাঁদে কেউ হাসে।
সুনামগঞ্জবাসী কাঁদে পড়ে পূর্ণগ্রাসে।।

পল্লীগ্রামে বসত করি কী অবস্থায় চলি।
এলাকার সুখ-দুঃখের খবর এখন বলি।।
আমি বলি আমার ভাবে আমি যাহা বুঝি।
দুঃখে গড়া জীবন নিয়ে মুক্তির পথ খুঁজি।।
মনে ভাবি শিক্ষাসম্পদ নাই যে আমার।
করতে চাই না আকাশের নক্ষত্র বিচার।।
প্রয়োজনে ভাটির চিঠি লিখতে যখন বসি।
ভাবি, আঁধারে কবে উদয় হবে শশী।।
ভাটি এলাকায় আমার জন্ম হয়েছে।
ছোটোবেলার কথাগুলো মনে রয়েছে।।
পঞ্চাশ বছর পূর্বে যাহা দেখেছি নয়নে।
মনে হয় স্বপ্ন যেন হেরেছি শয়নে।।
অনাবদি স্থানে প্রচুর ঘাস-বন ফলিত ।
গরু মহিষ ইচ্ছা মতো খাইত চলিত।।
ছেলেরা মাঠে চড়াইত গরুর পাল।
আজো আমার মনে পড়ে সে জমানার হাল।।
রাখাল বাজাইত বাঁশি আনন্দে তখন।
সে রাখালদের মধ্যে ছিলাম আমিও একজন।।
দই-দুগ্ধের অভাব ছিল না ধনী কৃষকদের।
দুগ্ধ তখন বিকাইত দুই আনা সের।।
শাক-শবজি গ্রামবাসী ফলাইয়া খাইত।
একে অন্যের কাছে চাইলেও পাইত।।
শাক-শবজি দধি দুগ্ধ ঘৃত মাখন ছানা।
তখন খাইত মানুষ ভেজালমুক্ত খানা।।
নদী-নালা খাল-বিল ছিল যে বিস্তর।
মাছ ধরে খাইত মানুষ সারাটা বৎসর।।
এখনো মনে পড়ে যা দেখেছি চোখে।
কত জাতের মাছ ধরে খাইত দেশের লোকে।।
বর্ষার ভাসান জলে মাছ ধরে খাইত।
মনের আনন্দে মানুষ নানান গীত গাইত।।
ছোটো নৌকার পাছায় বসে নৌকা বেয়েছি।
ভাইবে রাধারমণ বলে কত গান তখন গেয়েছি।।

খেলাধুলা গান-বাজনার প্রচলন থাকায় ।
আনন্দ-পরিবেশ ছিল ভাটি এলাকায়।।
বৈশাখ মাসে ঘরে এসে উঠলে বোরোধান।
বর্ষাতে ভাটি দেশে হইত কত গান।।
এক সঙ্গে মিলেমিশে গ্রামের নওজোয়ান।
সম্মিলিতভাবে তখন গাইত বাউলা গান।।
হিন্দু-মুসলিম ধনী গরিব মিলিয়া সকলে।।
প্রতিদ্বন্দ্বিতা হইত দুই গ্রামের দুই দলে।।
ভক্তিমূলক গান গাইতেন ফকির সাধু যারা।
বাজাইয়া লাউ ডপকি একতারা দোতারা।।
ভাবে বিভোর হয়ে গাইতেন তারা গান।
তাদের মধ্যে ছিল না কোনো বিভেদ-বিধান।।
মহররমে জারি গান শ্রদ্ধাভরে গাইত।
একে অন্যের কাছে ভালোবাসা পাইত।।
হিন্দু-মুসলমানে মিলে গ্রামে করি বাস।
গান বাজনার প্রচলন ছিল বারোমাস।।
যাত্রাগান কবিগান সদানন্দ মনে।
হিন্দু বাড়িতে গাইত পূজাপার্বনে।।
মুসলমান বন্ধু-বান্ধবকে নিমত্রণ দিত।
গেলে পরে মনপ্রাণে সেবাযত্ন নিত।।
মাঘ মাসে সূর্যব্রত হিন্দু মেয়েরার।
উদয়-অস্ত গান গাইত প্রতি রবিবার।।
মাঘে বৃষ্টি না হইলে ছিল এক বিধান।
ছোটো মেয়েরা গাইত বেঙ্গাবেরি গান।।
মাঘ মাসে মিলে-মিশে গ্রামের নওজোয়ান।
সু-বৃষ্টির মানসে গাইত বাঘাই শিন্নির গান।।
বাড়ি বাড়ি গান গেয়ে চাউল পয়সা পাইত।
শিন্নি তৈয়ার করে তারা মিলে মিশে খাইত।।
বিবাহে বিয়ের গান মেয়েরা গাইত।
মিলামিশা ভালোবাসার সুযোগ তারা পাইত।।
বাড়ি বাড়ি কিচ্ছা নইলে পুথি পাঠ হইত।
হুক্কা চুংগা তামুক টিক্কা লইয়া মানুষ বইত।।
বর্ষাকালে গাজির গাইন বাড়ি বাড়ি আইত।
গাজির গান গাইত ধান চাউল পাইত।।
গাজি-কালু দুই পির নাম সবাই জানে।
জিন্দাপির বলিয়া এলাকার লোকে মানে।।

খোল ঢোল সঙ্গে নিয়া নৌকায় আসিত।
গ্রামবাসী গাজির গানকে ভালোবাসিত।।
খোল ঢোল বাদক যারা তারা হলেন বাইন।
গান যে জনে গায় বলতো গাজির গাইন।।
হাতে আশা থাকত মস্তকে পাগড়ি।
গলে থাকত তসবি মালা পরনে ঘাগড়ি।।
যার বাড়িতে যাইত গাজির গানের দল।
বাড়ির মালিক এনে দিত এক ঘটি জল।।
জল ছিটা দিয়া স্থান পবিত্র করে নিত।
জিন্দাগাজি বলে প্রথম নামের ধ্বনি দিত।।
হাতের আশা তার, গাজি কালু বলে।
মাটিতে গাড়িয়া থইত গান গাইতে হলে।।
সুরতালছন্দে তখন ধরিয়া রাগিনী।
গান গাইত গাজি কালু চাম্পার জীবনী।।
কথা বলতো রঙেঢঙে দিয়ে নানান সুর।
সঙ্গে যে বাইন থাকত সে বড় চতুর।।
দুইজনে করত তারা কথার মারামারি।
বড় আনন্দ পাইতেন গ্রামের পুরুষ নারী।।
গাজির গান হিন্দুদের বাড়িতেও নিত।
হিন্দু সবাই শ্রদ্ধাভরে গাজির শিন্নি দিত।।
ধর্মপ্রাণ মানুষ যদি বিপদে পড়িত।
গাজির গান গাওয়াবে বলে মানসা করিত।।

বর্ষা গত হয়ে যখন আসত শরৎকাল।
তখন আরম্ভ হইত নৌকাবাইচের তাল।।
নৌকা বাইচে সারিগান ভাদ্র আশ্বিন মাসে।
প্রাণ খুলে গাইত কত আনন্দ উল্লাসে।।
রাজহংস ময়ূরপঙ্খি বিভিন্ন নামে।
দৌড়ের নৌকা ছিল তখন প্রতি গ্রামে গ্রামে।।
এই সমস্ত নৌকা নিয়া বাইচের থলায় যাইত।
সীল-কাপ পাঠা-খাসি উপহার পাইত।।
নৌকাতে পাইক সাজিত গ্রামের নওজোয়ান।
মনানন্দে মিলে মিশে হিন্দু-মুসলমান।।
ঢোল করতাল নৌকায় নিয়া তালে বৈঠা বাইত।
নৌকাবাইচ সারিগান সবাই ভালো পাইতো।।
যেখানে থলা জমাবে বাজারে ঢোল দিত।
স্থানীয় জনগণ এই দায়িত্বভার নিত।।
নৌকাবাইচ হইত যখন বিভিন্ন স্থানে।
জনমনে আনন্দ তখন দিত সারিগানে।।
থলাতে আসিত যে কত জাতের নাও।
দিরাই থানায় বাইচ হইত গরমা ভাটির গাঁও।।
আজমিরীগঞ্জে নৌকাবাইচ হইত যখন।
শতাধিক দৌড়ের নৌকা আসিত তখন।।
থলার দক্ষিণে হলো আজমিরীবাজার।
দর্শক থাকতেন সেদিন হাজার হাজার।।
শুকনা মৌসুমে থাকত কতজাতের খেলা।
বিভিন্ন স্থানে হইত ঘোড়া দৌড়ের মেলা।।
গ্রামে গ্রামে হইত তখন ষাঁড়ের লড়াই।
নৌকাবাইচ ঘোড়দৌড় এখন আর নাই।।

বর্তমানে দিরাই থানা সুনামগঞ্জ জেলা।
ধল গ্রামে হইত এক ঐতিহ্যবাহী মেলা।।
জানি না কবে থেকে আরম্ভ হয়েছে।
পূর্বে ছিল মেলা এখনও রয়েছে।।
মেলা হয় ফারুন মাসের প্রথম বুধবার।
চারদিক থেকে লোক আসতেন হাজার হাজার।।
পারাপারে মাঝি তখন পয়সা নিত না।
ব্যবসায়ীগণ কোনো খাজনা দিত না।।
সমস্ত নিষ্কর ছিল দ্রব্য যাবতীয়।
মেলা ছিল দেশবাসীর সকলের প্রিয়।।
মেলাযোগে হইত মানুষ আনন্দে বিভোর।
স্বজনে স্বজনে হইত মিলন মধুর।।
নদীপথে যোগাযোগ ছিল পরিষ্কার।
কালনী নদী দিয়ে তখন চলতো ইস্টিমার।।
যখন আরম্ভ হইত ধলগ্রামে এই মেলা।
ঢাকা থেকে নিয়ে আসত সার্কাসবাজি খেলা।।
হাতী ঘোড়া বাঘ ভালুক নিয়ে আসতো সাথে।
ঘর বাঁধিয়া খেলা দেখাইত মেলাতে।।
পরমেশ্বরী নামে হিন্দুর দেবস্থান।
হিন্দু সবাই গাইত তাদের ভক্তিমূলক গান।।
আসতেন তখন সাধু সন্ত গায়ক বাদকগণ।
আটচলিশ ঘণ্টা হইত নাম সংকীর্তন।।
হিন্দু ধনী মানী যারা দায়িত্বভার নিত।
দেবস্থানে পাঁঠা এবং মহিষ বলি দিত।।
গ্রামবাসী আনন্দ পাইত মেলা আসলে পরে।
চিড়া-মুড়ি তৈয়ার হইত প্রতি ঘরে ঘরে।।
খাঁটি দুগ্ধের ছানার মিষ্টি মেলাতে পাইত।
দধি-দুগ্ধ চিড়া-মুড়ি লইয়া তখন খাইত।।
কারো মনে কোনো মানস থাকিলে ।
ভক্তিভাবে স্নান করতো কালনীর কালো জলে।।
পূর্বের আনন্দ-বাতাস এখন আর বয় না।
ঘরে ঘরে চিড়া-মুড়ি তৈয়ার এখন হয় না।।
অতীতের আনন্দের ছবি আজো মনে পড়ে।
ভুলিবার কথা নয় ভুলিব কী করে।।

হিন্দু-মুসলিম কৃষক মজুর মেহনতিগণ।
ভ্ৰাতৃভাবে বাস করত আনন্দে তখন।।
কাঠের কুন্দে জমিতে সেচ দিত জল।
যত্ন নিত কৃষকে পাইত ভালো ফল।।
গরু মহিষ দিয়ে লাঙলে বাইত হাল।
মিলেমিশে চলত সবাই ছিল না ভেজাল।।
কুঁড়েঘর করে মানুষ বাস করত যে গ্রামে।
ছন বাঁশ কেটে আনত নিজ পরিশ্রমে।।
জালিবেতে বান দিত উলুছনে ছানি ।
ভালোভাবে ছাইতে জানলে তারে বলত জ্ঞানী।।
অতীতের এই দিনগুলো ভাবনা করি।
বাঁশ তখন বিকাইত দশটাকা কুড়ি।।
এক টাকায় পাওয়া যাইত ষোলোটা মুলি।
কিনতে হলে কাছে মিলতো কাদিরগঞ্জ-মাকুলি।।
এক পয়সায় এক ছলি পান তখন পাইত।
চার আনায় এক সের সুপারি কিনে খাইত।।
সেই সময় মানুষ ছিল সরল-সবল।
দেশ জুড়ে ছিল তখন তামুক খাওয়ার চল।।
এক পয়সায় এক সের চিটা কিনতে পাইত।
দুই আনা দশ পয়সা সের তামুক লইয়া খাইত।।
তামুক কুটার জন্য ছিল ছোট গাইল ছিয়া।
কুটিয়া মিশাইয়া লইত গাইলের মধ্যে দিয়া।।
কাঠের নইচরা লাগাইত নারিকেলের ফুলে।
তার উপরে মাটির এক কলকি দিত তুলে।।
কলকির মধ্যে ভালোভাবে তামুক সাজাইত।
তার উপরে আগুন দিয়া মিলে মিশে খাইত।।
বটনী হুক্কায় লাগাইত বাঁশের এক নল।
হুক্কাতে ভরিয়া লইত শীতল গঙ্গার জল।।
কোনো কোনো বাড়িতে ফসসি হুক্কা ছিল।
বৃন্দাবনি হুক্কা পরে বাহির করে দিল।।
গ্রামের সাধারণ মানুষ কৃষক-মজুর যারা।
ছোট নারিকেলের হুক্কায় তামুক খাইত তারা।।
নলবিহীন হুক্কা তাহা হাতে তুলে খাইত।
কাজের মানুষ কাজের বেলা সঙ্গে লইয়া যাইত।।
কাজের ফাঁকে তামুক খাইত এক সঙ্গে বসে।
আলাপ আলোচনা তখন করত রঙ্গরসে।।
বর্ষাকালে গ্রামের মানুষ হাট-বাজারে যাইত।
নিজের নৌকা নিত, নিজে নৌকা বাইত।।
দাঁড় বৈঠা হুক্কা চুঙ্গা তামুক টিক্কা লইয়া।
যাতায়াত করত মানুষ নিজে নৌকা বাইয়া।।
হুক্কা দিয়া তামুক খাইত খরচ হইত কম।
এখন খায় সিগারেট-গাঁজা ডেকে আনে যম।।
আনন্দ পরিবেশ এই এলাকাতে ছিল।
বিচার করে দেখতে হবে কে কাড়িয়া নিল।।

এই ছিল ভাটির অতীতের ছবি।
প্রাকৃতিক স্বভাবে গড়া কত বাউল কবি।।
ভাটি এলাকায় মাঝির ভাটিয়ালি গান।
সবুজ বনে পাখি ডাকে নিয়তির দান।।
কত জাতের পাখি দেশে সময়ে আসিত।
লাখ লাখ পাখি হাওর-বিলে ভাসিত।।
রাত্র হলে পাখি চলতো করে হুমঝুম।
পাখির ডাকে তখন ভেঙে যাইত ঘুম।।
শান্তিকামী দুনিয়াতে শান্তি সবাই চায়।
আজীবন চেষ্টা করে কয়জনে তা পায়।।
এলাকায় জনগণ বসতি যখন নিল।
সমস্ত এলাকা জুড়ে বনজঙ্গল ছিল।।
বর্ষাকালে বনজঙ্গল থাকতো তখন ভাসা।
দারা দিয়া নৌকায় মানুষ করত যাওয়া-আসা।।
তখন ছিল না এই ঢেউয়ের মারামারি।
ঢেউয়ে ভেঙে নিত না গ্রামের ঘরবাড়ি।।
এখন কোনো বনজঙ্গল নাই এলাকায়।
বর্ষা হলে হাওর যেন সাগর দেখা যায়।।
মধ্যে মধ্যে গ্রামগুলো, চারিদিকে জল।
বর্ষার দুযোগে কারো রয় না মনোবল।।
এই সমস্ত গ্রামে কৃষক মজুরের বসতি।
প্রাকৃতিক দুযোগে কত মানুষের দুগতি।।
বর্ষাকালে ঝড় আসিলে উঠে যখন ঢেউ।
ভুক্তভোগী ছাড়া দুঃখ বুঝে না যে কেউ।।
বাড়ি ভেঙে নিয়ে যায় ভেঙে পড়ে ঘর ।
কে আছে দরদি তখন কে নেয় খবর।।
শক্ত করে বান্ধিতে হয় দিয়ে বাঁশ বন ।
নইলে বাড়ি রক্ষা হয় না শান্ত হয় না মন।।
কর্তব্যকাজ না করিলে হয় সর্বনাশ।
একশো টাকায় মিলে না ছোটো দুইটা বাঁশ।।
গরিব যদি কষ্ট করে বাঁশ যোগাড় করে।
বাঁশ হলেও বন মিলে না বনশূন্য হাওরে।।
পতিত কোনো জায়গা নেই কোথায় ফলবে বন।
বন বিনে গরিবের চলে না জীবন।।
কুড়েঘর করে গ্রামে বাস করে যারা।
ঘর করিবে কেমন করে ছন-বন ছাড়া।।
বনশূন্য হইল যখন এই ভাটি অঞ্চল।
সাধারণ মানুষের মন হইল চঞ্চল।।
এখন একটি কুড়েঘর করিতে তৈয়ার।
কমপক্ষে পাঁচ হাজার টাকার দরকার।।
জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার উপায় নাই যার।
ঘর করিবে কই পাবে টাকা পাঁচ হাজার।।
বাঁ হলে নৌকাযোগে পাহাড়ে লোক যাইত।
পাহাড়ের কাছে তখন ছন-বন পাইত।।
ছন-বন কেটে আনতো নিজ পরিশ্রমে।
অবস্থা দেখে এখন পড়ে গেলাম ভ্রমে।।
পাহাড়ের পাদদেশে যে বনজঙ্গল ছিল।
জনগণ এখন তাহা আবাদ করে নিল।।

বনজঙ্গল পরিষ্কার হইল যখন।
আসলে সমস্যার সৃষ্টি হইল তখন।।
জল নামে রাস্তায় কোনো বাধা বিঘ্ন নাই।
প্রচুর মাটি নেমে আসে চোখে দেখতে পাই।।
পাহাড়ি জল নিচে নেমে নদী পথে চলে ।
এলাকা পাবিত হয় অকাল বন্যার জলে।।
জলনিকাশে বাঁধাবিঘ্ন রয়েছে রাস্তায়।
এলাকাতে জল তখন আটকা পড়ে যায়।।
জলের সঙ্গে মাটি আসে কথা নহে মিছে।
জলে-মিশা পলিমাটি বসে পড়ে নিচে।।
নিচু জায়গা ভরাট হয় সমস্যা বাড়ে।
বন্যার জলে কৃষকের ফসলাদি মারে।।
বন্যানিয়ত্রণ করা হলো মূল কারণ।
নদী খনন না হলে তা হবে না বারণ।।
সুরমা-কুশিয়ারার তীর বেঁধে নেওয়া দরকার।
এ ছাড়া উপায় নাই এই ভাটি এলাকার।।
নদীর তীর বেঁধে যখন উঁচ করতে পারবে।
তখন এই নদীগুলোর গভীরতা বাড়বে।।
কল ডুবাইয়া নদীর জল হাওরে যাবে না।
অকাল বন্যার জলে ফসলকে পাবে না।।
স্বাভাবিক অবস্থায় জল নদীপথে যাবে।
বন্যার কবল থেকে ফসল রক্ষা পাবে।।
জল নিকাশে বাঁধা কোথায় বিচারে যা পাও।
বাধা বিঘ্ন দূর করে রাস্তা খুলে দাও।।
নির্বিঘ্নে জল নেমে যাওয়া হলো দরকার।
প্রয়োজন মনে করি লোপকাটিং করার।।
আঁকা-বাঁকা নদীপথ সোজা সরল হলে।
উপর হতে আসবে জল নিচে যাবে চলে।।
অতি সহজে জল হইবে নিকাশ।
কৃষকগণ বারবার হবে না নিরাশ।।
আর একটা স্থায়ী ফল জনগণ পাবে।
নদীপথে যাতায়াতের রাস্তা কমে যাবে।।

প্রয়োজন হবে তখন সুইচ গেইট করার।
বিবেক বিচার করে যেখানে দরকার।।
কুশিয়ারার জল নিকাশে বাধা যখন পড়ে।
তখন কুশিয়ারায় জল উল্টা রাস্তা ধরে।।
কালনী দিয়ে কুশিয়ারার জল ঢুকে যায়।
এই জলে দিরাই শালার হাওর ডুবায়।।
এই জল ঢুকে যখন ঘটায় বিষাদ।
এর জন্যই দিতে হয় কালনীর মুখে বাঁধ।।
কুশিয়ারায় জল নিকাশের রাস্তা যদি পাই।
কালনী নদীর মুখে কোনো বাঁধের দরকার নাই।।
বর্তমান অবস্থায় এবং জ্ঞানী গুনীর মতে।
এই ভাটি এলাকা এখন সাগর হওয়ার পথে।।
এলাকার মানুষকে যদি বাঁচাইতে চাও।
পাহাড়ি জল নেমে যাওয়ার রাস্তা খুলে দাও।।
ক্ষমতার মালিক যারা সূক্ষ্ম রাস্তা ধর।
কৃষকের ফসল রক্ষার সুব্যবস্থা কর।।
এই দাবি ভাটি অঞ্চলের কৃষকের।
কর্ম চাই বাঁচতে চাই দাবি মজুরের।।
কৃষক মজুর মিলে সবাই স্বদেশ ভালোবেসে।
বাঁচার মতো বাঁচতে চাই এই বাংলাদেশে।।

ফসলের নিরাপত্তা নাই কী করে যে চলি।
মানুষের সুঃখ দুঃখের খবর এখন বলি।।
কৃষক-মজুর নারী-পুরুষ গ্রামে যারা আছে।
ফসল উৎপাদনের ভার তাহাদের কাছে।।
জমিতে সুফল হবে- আশায় স্বপ্ন দেখে।
গরিব কৃষক ঋণ আনে জমি বন্ধক রেখে।।
শীলাবৃষ্টি খরা আর অকাল বন্যার জল।
অনেক সমস্যার মুখে কৃষকের ফসল।।
ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যে দেশের সরকার।
কৃষককে ঋণ দেন যাদের দরকার।।
ঋণ পায় অতিরিক্ত জমির মালিক যারা।
গরিব মারার কল-কৌশল করে নেয় তারা।।
জমির অনুপাতে ঋণের বড় অংশ পায়।
অনেকেই এই টাকা সুদী লাগায়।।
চৈত্র মাসে সুদী-লগ্নির বেড়ে যায় মান।
একশো টাকায় দিতে হয় তিনশো টাকার ধান।।
উৎপাদনে কৃষিঋণের প্রয়োজন যার।
সহজভাবে ঋণ পাওয়ার সুবিধা নাই তার।।
গরিব কৃষক যারা, মারা যায় মাঠে।
তিন টাকা পাওয়ার জন্য তের দিন হাঁটে।।
হাজারে প্রায় দুইশত খরচ হয়ে যায়।
এর পরে কপালপোড়া গরিবী ঋণ পায়।।
গরিব কৃষক বিপদ ভেবে করে আজাহারি।
দিনে দিনে ঋণের বোঝা হয় যে তার ভারি।।
মেহনতি নারী-পুরুষ গ্রামে যারা আছে।
দিন-রাত মাটির সঙ্গে লড়াই করে বাঁচে।।
শীত-গরম রোদ-বাদলে নাহি করে ভয়।
তাদের পরিশ্রমের ফলে উৎপাদন হয়।।
যাদের উৎপাদনের উপর নির্ভর সবার।
তাদের পেটে ভাত নাই উপায় কী এবার।।
কৃষক দেশের মেরুদণ্ড কৃষিপ্রধান দেশে।
কৃষককুল ধ্বংস হলে কী হইবে শেষে।।
কৃষকের মুখে যদি অন্ন জুটে না।
মজুর বাঁচার তো কোনো প্রশ্নই উঠে না।
মজুর বলে ভিক্ষা নয় মজুরি চাই।
ভাটি অঞ্চলে তো কল-কারখানা নাই।।
গরিব কৃষক বিক্রি করে জমি ছাড়তেছে।
ভূমিহীন ক্ষেত মজুরের সংখ্যা বাড়তেছে।।
মজুরি নাই মজুর বাড়ে হবে কী উপায়।
মজুরি বিনে মজুরের প্রাণে বাঁচা দায়।।
ছোটো বড় কৃষক যত পুরান-নতুন।
ভূমিহীন ক্ষেতমজুর তাহার দ্বিগুণ।।
জীবনের নিরাপত্তা নাই মরে হা-হুঁতাশে।
ছেলেমেয়ের শিক্ষার সুযোগ নাই তো এই দেশে।।
ঘর করে থাকতে পারে না পরার নাই কাপড়।
রোগে কোনো ঔষধ নাই কে নেয় খবর।।
বিভিন্ন অবস্থায় চলেছে এই দেশ।
ভাটি অঞ্চলের হয় ভিন্ন পরিবেশ।।
শুকনা মৌসুমে হয় ইরি-বোরো চাষ।
অগাধ জলের নিচে থাকে ছয় মাস।।
কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে জমি যখন ভাসে।
কৃষকের কৃষিকাজের সময় তখন আসে।।
এই সমা কৃষকগণের মজুর দরকার।
মজুরদের প্রয়োজন মজুরি করার।।
কৃষিকাজে মজুরগণে মজুরি পাইত।
লাখ লাখ মজুর তখন লাঙ্গলে হাল বাইত।।
কাঠের কুন্দে জমিতে সিচিত যে জল।
কর্ম করে বেঁচে থাকতো মজুরের দল।।
কৃষিতে আধুনিক যন্ত্র আসিল যখন।
ক্ষেতমজুরগণ নিরুপায় হইল তখন।।
এখন কাঠের কুন্দে সিচতে হয় না জল।
চাষের জন্য এসেছে কলের লাঙ্গল।।
একশো জনের কাজ এখন দুচারজনেই চলে।
গরুতে হাল টানে না এখন টানে কলে।।
জল সিচা লাঙ্গল বাওয়া এখন আর নাই।
মজুরের কপাল পুড়ে হয়ে গেছে ছাই।।
ফসলবোনায় কয়েক দিন মজুরি মিলে।
মাছধরাতে মালিকগণে মজুর খাটায় বিলে।।
কেউ মেয়াদি কেউ দিনমজুরি করে।
তাও যদি না পায় অনাহারে মরে।।
সরকারি-বেসরকারি মাটি কাটা পায়।
হেমন্ত-শীত-বসন্ত দুঃখ-কষ্টে যায়।।
চৈত্রের শেষে নবীন বেশে আসে বৈশাখ মাস।
ধনী গরিব সবার মনে আনন্দ উল্লাস।।
একটি ফসল মাত্র ভাটি এলাকার।
কৃষক সকলেরই মজুর দরকার।।
এই সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়।
এলাকাবাসী তখন আতঙ্কিত রয়।।
কৃষক সবাই তখন এই চেষ্টা করে।
তাড়াতাড়ি ফসল তুলে নিতে চায় ঘরে।।
বর্তমান অবস্থায় যাহা চোখে দেখতে পাই।
গ্রামের মজুরদের স্থায়ী মজুরি নাই।।
মজুরগণ বেকার বিপন্ন অবস্থায়।
যেখানে মজুরি মিলে সেখানেই যায়।।
বৈশাখ মাসে বোরো ফসল তোলার সময়।
অনেক মজুর তখন উপস্থিত হয়।।
বিভিন্ন জেলার মজুর আসে যে তখন।
এলাকাতে রয়েছে এই প্রচলন।।
দূর থেকে মজুরগণ নৌকায় আসে যারা।
নিজ দায়িত্বে থেকে ফসল তুলে দেয় তারা।।
কৃষকগণ ইচ্ছামত চালাইতে পারেন।
সুবিধা পাইলে আর কেহ কি ছাড়েন।।
তারা যখন ষোলোআনা নেয় দায়িত্বভার ।
স্থানীয় মজুর তখন হয়ে যায় বেকার।।
আশা করে ফসল বোনে কৃষক মজুরগণ।
ভাটি এলাকায় যাদের জীবন-মরণ।।
অকাল বন্যার জলের আক্রমণ হলে।
রক্ষা করতে চেষ্টা করে মিলিয়া সকলে।।
ফসল তোলার মজুরি যখন তাদের ভাগ্যে নাই।
আশা-ভরসায় তখন পড়ে যায় ছাই।।
এরপর নামে জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ়িয়া ঢল।
বিপদে পড়ে এই দিনমজুরের দল।।
তখন মজুরে কোনো মজুরি পায় না।
নৌকা না থাকিলে বাড়ির বাহির হওয়া যায় না।।
ঘরে বসে চিন্তা-ভাবনা করে সর্বদায়।
থাকলে কিছু অমূল্যে বিক্রি করে খায়।।
বর্ষাতে হাজার হাজার নৌকা-বারকি বাইত।
মাঝি হয়ে নৌকা বেয়ে মজুরগণ খাইত।।
নৌকাতে বসেছে এখন আধুনিক কল।
বিপদে পড়েছে এই মাঝিমাল্লার দল।।
ভাসা-জলে মাছ ধরে বিক্রি করে খাইত।
তাও এখন পারে না সেদিন আর নাই তো।।

অনেক জলাশয় আছে এই ভাটি অঞ্চলে।
কোটি কোটি টাকার মাছ আপনা থেকেই ফলে।।
গরিব সমবায় সমিতি মৎস্যজীবীদের।
আশ্রয় নিতে বাধ্য হয় ধনী কৃষকের।।
ওদের মাথায় কাঁঠাল রেখে অন্যেরা খায়।
অর্থলোভী আমলা যারা তারা অংশ পায়।।
সবাই বলি জমিদারগণ শোষণ করে নিত।
তারা যখন জলমহাল বন্দোবস্ত দিত।।
ছোটো ছোটো খাল-নালা-ডোবা-ঝাই আর।
এগুলোতে জনগণের ছিল অধিকার।।
বর্ষার ভাসান জলে সমস্ত হাওরে।
ধরিয়া খাইত মাছ যে যেভাবে পারে।।
তখন কোনো নিষেধ বাঁধা ছিল না যে কার।
এ ছিল দেশবাসীর মৌলিক অধিকার।।
এখন বন্দোবস্ত দেন দেশের সরকার।
বন্দোবস্ত দেওয়ার বাকি কিছুই রয় না আর।।
শক্তি সম্পদের মালিক ধনী-মানী যারা।
জলমহাল বন্দোবস্ত আনেন এখন তারা।।
হাওরে একটি বিল তাদের আনা হলে।
সমগ্র হাওর তারা নিয়ে যায় দখলে।।
মহালের ক্ষতি হয় অজুহাত করে।
নিষেধাজ্ঞা জারি করে সম্পূর্ণ হাওরে।।
কড়া পাহারা চলে সারা দিন-রাত ।
মাছ ধরিতে কেহ যেন জলে দেয় না হাত।।
জাল-বঁড়শি নিয়ে কেউ নামিলে হাওরে।
জাল-বঁড়শি মানুষসহ নিয়ে যায় ধরে।।
গরিব মানুষের মনে হয়েছে ভয়।
জালগুলো আগুনে পুড়াইয়া দেওয়া হয়।।
মাছ ধরে খাওয়ার দিন সমাপ্ত হলো।
এখন দেখি না আর কুচা-অচু-পলো।।
হেমন্ত কি বর্ষাকালে মাছ ধরে খাওয়ার।
কোনোখানেই জনগণের নাই অধিকার।।
সেদিন নাই আর, মাছ ধরে খাইতে কেউ পায় না।
ভালো একটা মাছ এখন চোখে দেখা যায় না।।
এলাকার জলাশয়ে যে মাছ ধরা পড়ে।
এলাকার মানুষ তাহা দেখে না নজরে।।
মালিকের হিমাগারে সযতনে রয়।
কারগো বিমানে তাহা বিদেশ চালান হয়।।
শাক-শবজি দেশের মানুষ খাইতে নাহি পায়।
ব্যবসায়ীগণ তাহা বিদেশে পাঠায়।।
শাক-শবজি মাছের মূল্য দিন দিন বাড়ে।
ভালো কোনো মাছ মিলে না দেশের বাজারে।।
খাঁটি দুগ্ধ পাওয়ার দিন চলে গেছে পাছে।
গুড়া দুগ্ধ কিনে খায় টাকা যাদের আছে।।
দিনের পর দিন আসে কঠিনভাব দেখে ডরাই।
স্বাধীন হয়ে কী পেয়েছি মনে ভাবি তাই।।
গ্রামাঞ্চলে মজুর বাঁচার উপায় যাহা ছিল।
কল এসে মজুরের মজুরি কেড়ে নিল।।
কৃষিতে মজুরি বিনা অন্য উপায় নাই।
নিরুপায় হয়ে গেছে মজুর সবাই।।

গরিব কৃষক ক্ষেতমজুরগণ হও হুঁশিয়ার।
দুঃখ এসেছে দেখো ঘরে আপনার।।
চোখের সামনে সন্তানাদি দুঃখ-কষ্ট করে ।
স্ত্রী দেখো ঔষধ বিনা রোগে ভুগে মরে।।
টাকা ছাড়া ঔষধ-ডাক্তার পাওয়ার উপায় নাই।
অনুতাপের আগুনে যে পুড়ে হবে ছাই।।
সন্তানাদি জন্ম দেওয়া বড় কথা নয়।
শিক্ষা-দীক্ষা দিয়ে পরে মানুষ করতে হয়।।
টাকা ছাড়া লেখাপড়া করাবে কী করে।
বেতন না দিলে কি পড়াবে মাস্টারে।।
এর পরেও গৃহশিক্ষক হবে দরকার।
তা না হলে ফল পাবে না ইশকুলে পড়ার।।
অধিকাংশ মানুষ এখন দুঃখের সাগরে।
অর্ধাহার-অনাহারে দুঃখ কষ্ট করে।।
পেটে ভাত নাই দিন-রাত দুঃশ্চিন্তায় ভোগে।
ঔষধ-ডাক্তার মিলে না ধরে যখন রোগে।।
গরিবের রোগ হইলে সহিতে হয় জ্বালা।
ঔষধের দাম শুনিলে কানে লাগে তালা।।
চৌদিকে অন্ধকার দেখি কী বলিব কারে।
উপায় নাই দ্রব্যমূল্য দিনে দিনে বাড়ে।।
মজুতদার দোকানদারগণ নাচে কৌতূহলে।
খাদ্যে ভেজাল মিশায় বানরের দলে।।
চলমান অবস্থা দেখে মনে ভয় পাই।
চলেছে লুটপাট আজ ধর্মাধর্ম নাই।।
মজুতদার কালোবাজারি পেয়েছে বাজার।
আছে ইজারাদারের চরম অত্যাচার।।
সাধারণ মানুষ এখন হলো নিরুপায় ।
এই আঁধারে দেশবাসী আলো পেতে চায়।।
সুযোগ-সন্ধানী যারা সুযোগ পেয়ে নাচে।
সাধারণ মানুষ ভাবে কী করে প্রাণ বাঁচে।।
দেশের যত ধনী আরো ধনী হতে চায়।
গরিব যদি মরে তাদের কিবা আসে যায়।।
পুরান এক প্রবাদ বাক্য পড়ে গেল মনে।
রাজার হয় না ধনে গৃহস্থের হয় না বনে।।
বর্তমান অবস্থা যাহা চোখে দেখতে পাই।
মানুষের প্রতি মানুষের দয়া-মায়া নাই।।
বিচার করে দেখ যাহা চোখে দেখা যায়।
ধনী যারা দুনিয়াটা গ্রাস করিতে চায়।।
জোর-জুলুম-অত্যাচার দুর্বলে কি করে।
দুর্বল শুধু মাইর খায় অবশেষে মরে।।
বিচার নয় অবিচার আর ন্যায়কে অন্যায়।
স্বেচ্ছাচারী ধনী যারা করে সর্বদায়।।
সজ্ঞানী মানুষ যারা নীরব হয়ে রয়।
ন্যায্য কথা বলতে চায় না মান ইজ্জতের ভয়।।

বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ এলাকাতে আছে।
চোখে দেখি সাধারণ লোক কী করে যে বাঁচে।।
অধিকাংশ লোকে বলে করি কী উপায়।
কইতে নারি সইতে নারি বড় অসহায়।।
উপর তলায় বসেছে রূপচান্দের বাজার।
নিচ তলাতে চলেছে জঘন্য কারবার।।
স্বার্থপর নেতা যারা কাজে তারা জামিদার।
স্বার্থপর পদলোভী মিথ্যা কথার দোকানদার।।
আপন নিয়ে ব্যস্ত সবাই কে কার পানে চায়।
রক্ষক যদি ভক্ষক হয় প্রাণে বাঁচা দায়।।
যখন সুবিধা সুযোগ পেয়েছ যারা।
আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছে তারা।।
এদেশে পুরান এক প্রবাদ বাক্য রয়।
বৃক্ষ যে হয় তার ফলে পরিচয়।।
এখন আস্থাহারা হলেন জনগণ।
খুঁজে মিলে না তাদের কে হবে আপন।।
জীবনে কত আশার স্বপ্ন দেখলাম।
আশায়-নেশায় পড়ে কত গান লেখলাম।।
এই দেশে কি মানুষের বাঁচার অধিকার নাই।
অনেকে জিজ্ঞাসা করে উত্তর কোথায় পাই।।
অসহায় বিপন্ন হয়ে মা-বোন কত আছে।
অন্তরের দুঃখ-ব্যাথা বলবে কার কাছে।।
শোষিত-বঞ্চিত-লাঞ্ছিত হয় যারা।
সীমাহীন দুঃখ কষ্ট সহিতেছে তারা।।
দলে দলে মেয়েলোক রাস্তায় মাটি কাটে।
জানি না এদের আর কী আছে ললাটে।।
জন্ম নিলে মরতে হয় নিয়তির বিধান।
সবাই করে ধর্ম-কর্ম আমি গাই গান।।
আমি আমার গান আমার ভাবে গাই।
জীবননদীতে নৌকা উজান বেয়ে যাই।।
এখনো লোভ-লালসা করে পরিহার।।
মানবতার লক্ষ্যে করো সমাজের বিচার।।
তা যদি না করো রাখিও স্মরণ।
একদিন তোমাদের বিচার করবে জনগণ।।

মনে পড়ে তেরশো পঁচানব্বই বাংলাতে।
কী ঘটেছিল এই ভাটি এলাকাতে।।
তেরশো পঁচানব্বই সাল এসে দেখা দিল।
কৃষক মজুরের মনে কত আশা ছিল।।
হঠাৎ করে এমন হবে আগে কি কেউ জানি।
জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রথম এল অকাল বন্যার পানি।।
ভাটি এলাকায় যা ইরি আউশ ছিল।
প্রথম ছোবলে তাহা গ্রাস করে নিল।।
নিদারুণ বন্যার জলে দেশ করল দখল।
সমূলে বিনাশ করিল কৃষকের ফসল।।
অধিক ফসল পাবে বলে ছিল যে বাসনা।
নিমিষে চলে গেল রহিল ভাবনা।।
ধান নিল খড় নিল এসে বন্যার পানি।
গরিবের হলো না তো কুঁড়ে ঘরে ছানি।।
মানুষের ভাত নিল গরুর নিল ঘাস।
ঘর-বাড়ি ভাসাইয়া কত করলো সর্বনাশ।।
গবাদি পশু মরিল প্রবল প্লাবনে।
বিপাকে পড়ে কত মানুষ মরে প্রাণে।।
বন্যার তাণ্ডবলীলা তখন দেখিলাম ।
অধ্বভাঙা হয়ে গেছে গ্রামের পর গ্রাম।।
স্বচক্ষে দেখিলাম যাহা ভাটি এলাকায়।
সাধারণ মানুষ আছে হয়ে অসহায়।।
ঘর ভাঙ্গিল ঝড়বৃষ্টিতে ঢেউয়ে ভাঙলো বাড়ি।
বিপদে পড়ে মানুষ করে আহাজারি।।
এই মহা বিপদের খবর যখন পাইলা।
সরকারি-বিরোধী দল সবই তখন আইলা।।
আসলেন তারা স্পীডবোট এবং ইঞ্জিন-নৌকায়।
দেখতে এলেন, কী ঘটেছে ভাটি এলাকায়।।
বাস্তবে গ্রামগঞ্জের অবস্থা দেখিলা।
মর্মান্তিক ঘটনাগুলোর ছবি তুলে নিলা।।
দুর্গত এলাকায় যারা আসিয়াছিলেন।
সবাই তখন মুখভরা ভরসা দিলেন।।
আশ্বাসবাণীতে তারা বলিলেন তখন।
করা হবে দুর্গতদের পুনর্বাসন।।
সবরকম সাহায্য দেবেন সবাই বলেছিলা।
ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হিসাব করে নিলা।।
প্রচারমাধ্যম তাহা তুলিয়া ধরিল।
দেশ-বিদেশ প্রচুর সাহায্য করিল।।
বিভিন্ন স্থানে যারা আশ্রয় নিয়েছিল ।
ধীরে ধীরে বন্যার জল ভাটা যখন দিল।।
হুকুম হলো ফিরে যাও যার তার জায়গায়।
ভাঙা বাড়িতে এল হয়ে নিরুপায়।।
ঝড় প্লাবণে ঘরবাড়ি ভেঙে যাদের নিল।
ফিরে এসে অসহায় অবস্থাতে ছিল।।
ভাঙা ভিটায় মাটি কেটে বান্ধিতে হয় ঘর।
আসলে খাবার নাই সমস্যা বিস্তর।।
দুঃখ কষ্টে একটি বছর গত করে দিল।
কোনো কিছু পাবে বলে মনে আশা ছিল।।
পাওয়ার আশে ছিল যারা অসহায় এতিম ।
পাবে বলে পেয়েছে কি হাতি-ঘোড়ার ডিম।।
বিদেশী সাহায্য যখন এই দেশে আইল।
স্বার্থপরগণ স্বার্থের সুযোগ তখন পাইল।।
ব্যক্তিস্বার্থে পাগল যারা আর কিছু বোঝে না।
স্বার্থের বেলা ভালোমন্দ তারা যে খোঁজে না।।
নরক যাতনায় আছে গরিব কাঙাল যারা।
লুটকর ধনিক শ্রেণী মজা লুটছে তারা।।
সাধারণ মানুষ যে অবস্থায় পড়েছে।
দিনে দিনে হতাশা নিরাশা বেড়েছে।।
মানুষের দুঃখ দেখে কাঁদে মনপ্রাণ।
মানুষকে ভালোবাসি, গাই মানুষের গান।।
যেভাবে যা মনে আসে করি তা প্রচার।
সাধু কি চলিত ভাষা করি না বিচার।।
আমি যাদের গান গাই তারা যদি বোঝে।
তাদের মাঝে থাকতে চাই, তারা আমায় খোঁজে।।
আমি বলি আমার ভাবে, আমি যাহা বুঝি।
দুঃখে গড়া জীবন নিয়ে মুক্তির পথ খুঁজি।।

অনাবাদি জায়গা কত বিভিন্ন স্থানে।
রেকর্ডকৃত আছে তাহা ডিসির খতিয়ানে।।
বর্তমান শাসনতন্ত্রের আইনের ধারায়।
ভূমিহীনে এসব জায়গা বন্দোবস্ত পায়।।
খরচ করে গরিব যদি বন্দোবস্থ আনে।
এইসব জায়গায় দখল পায় না বিভিন্ন কারণে।।
কৃষি-কর্মচারীগণ কলকৌশলে চলে।
এ সমস্ত জায়গা আছে জোতদারের দখলে।।
গ্রামসামন্ত-জোতদার যখন গরিবকে তাড়াবে।
জোতদারের সামনে গরিব কী করে দাঁড়াবে।।
চেষ্টা করতে গরিব যখন খালি হাতে যায়।
সালামের আলেক মিলে না উপর তলায়।।
জন্মগত ভূমিহীন একজন ছিল।
পতিত বন্দোবস্তের জন্য দরখাস্ত দিল।।
তিন একর পাওয়ার জন্য দরখাস্ত ছিল।
দুই একর এগারো শতক দেওয়া তারে হলো।।
আইন মতে দশ কিস্তিতে সালামি দিয়েছে।
এ পর্যন্ত এই জমির খাজনা দিতেছে।।
কাগজপত্রে বন্দোবস্ত পেয়েছে তো বটে।
আজো বেদখল আছে জোতদারের দাপটে।।
সময় গেল, টাকা পয়সা গেল যে বিস্তর।
আশাতে আছে প্রায় একত্রিশ বৎসর।।
শক্তি-সম্পদ না থাকাতে সবুর করে আছে।
ভুলিতে পারিবে কি যতদিন বাঁচে।।
এইভাবে গরিবের মনে দেয় যারা ব্যথা।
তারাও জনদরদি তারাও আজ নেতা।।
চোরের নৌকায় সাউধের নিশান দখিন হাওয়ায় উড়ে।
কারে কী বলিব আর সময়ে সব করে।।

আরেক দুঃখের কথা এখন বলতে চাই।
চারদিকে পড়েছে অভাব উপায়-বুদ্ধি নাই।।
যখন যা প্রয়োজন হয় তখন তা আনো।
রান্না করে খাইতে হয় সবাই তা জানো।।
কালের করাল গ্রাসে কত দুঃখ সই।
বনশূন্য ভাটি এলাকা লাকড়ি পাব কই।।
ডোবা জায়গায় গাছ লাগাব এমন স্থানও নাই।
আশি টাকা লাকড়ির মণ কিনতে যদি যাই।।
যে কৃষকের গরু আছে ভাটি এলাকায়।
তোষের সাহায্যে গরুর গোবর জ্বালায়।।
গরু নাই যার গোবর নাই তার কী করবে বল না।
লাকড়ির জন্য তাগিদ করেন ঘরের ললনা।।
সারাদিন কাজ করে ডাইল চাউল আনে।
লাকড়ি বিনা রান্না হয় না পড়ে ঘোর নিদানে।।
সমস্যা আছে বলে সমাধান চাই।
ভাটি এলাকায় তো গ্যাসের চুলা নাই।।
এই অঞ্চলের মাটির নিচে প্রচুর গ্যাস রয়েছে।
কে কখন কাজে লাগাবেন সমস্যা হয়েছে।।
ভাঙাগড়া দেখলাম কত লীলার অন্ত নাই।
চাচা আপন জান বাঁচা- এই দেশে তো তাই।।
আমরা নয়- আমি শুধু সবার মনে মনে।
জাতির উন্নতি তবে হইবে কেমনে।।

গ্রামের কৃষক যে কৃষি কর্ম করে।
অধিকাংশ নির্ভর করে গরুর উপরে।।
বর্তমান অবস্থায় যাহা চোখে দেখতে পাই।
গোসম্পদ রক্ষার কোনো সুব্যবস্থা নাই।।
গ্রামের কাছে পতিত জায়গায় ছিল গরুর ঘাস।
এখন হয় এই জায়গাতে ইরি ধানের চাষ।।
খাদ্যের অভাবে গরু পোষা হলো দায়।
চিকিৎসার সুযোগ নাই রোগের বেলায়।।
কারে কী বলিব আমি ভাবি সর্বক্ষণ।
জেলা থানায় আছেন পশু-ডাক্তারগণ।।
ডাক্তারগণ নিজ দায়িত্ব পালন করতে চায় না।
হালের বলদ রোগে মরে কৃষকে তো পায় না।।
ডাক্তার আছেন কী করতেছেন আমি যদি কই।
তাহলে তো ভাগু ভেঙ্গে পড়ে যাবে দই।।
পুরান কথা মনে পড়ে আজো তাহা ভাবি।
দশ টাকা হলে তখন কেনা যেত গাভী।।
ধীরে ধীরে গোসম্পদের অভাব পড়ায়।
দশ টাকার গাভী এখন দশ হাজার বিকায়।।
খাদ্যাভাবে রোগব্যধিতে গরু মরিতেছে।
হাজার হাজার গরু রোজ জবাই করিতেছে।।
এই অবস্থা এগিয়ে যায় যদি তবে।
একটি গাভীর মূল্য পঞ্চাশ হাজার হবে।।
সবার পক্ষে গাভী পালন সম্ভব হবে না।
সধারণ কৃষকের ঘরে গাভী রবে না।।
কৃষক ভাইগণ শোনো এখন গাভীর খবর।
গাভী তো চলে গেছে ঢাকার শহর।।
রঙ মাখিয়া সঙ সাজিয়া গ্রাম গঞ্জে আসে।
টিনের মধ্যে থেকে গাভী কল কল করে হাসে।।
গাভী বলে রব না আর কৃষকের ঘরে।
এখন আমি স্থান পেয়েছি শহরে বন্দরে।।
ক্ষুধায় খাদ্য মিলে- রোগে ঔষধ পাই।
গ্রাম্য এলাকায় বেঁচে থাকার পরিবেশ নাই।।
ক্ষুধায় খাদ্য মিলে না রোগ ব্যাধিতে মরি।
সময়ে কৃষি কাজে পরিশ্রম করি।।
গ্রামের কৃষকে যখন প্রাণ খুলে চায় না।
দধি দুগ্ধ মাখন ছানা তারাও এখন পায় না।।
ধীরে ধীরে গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র যাব।
আশা করি সবাই মোরা শহরে স্থান পাব।।
গাভী বলে আপাতত বিদায় নিলাম।
গ্রামবাসী সবার কাছে রহিল সালাম।।

জানি না দেশবাসীর ভাগ্যে যে কী ছিল।
ভালোর জন্য নির্বাচন এই দেশে দিল।।
এখন নির্বাচন আসিলে পরে।
নেতা সবাই আসেন তখন বিভিন্ন রঙ ধরে।।
স্বার্থ সুবিধার কথা লোকেরে বোঝায়।
আসলে সবাই তখন ভোট নিতে চায়।।
এই সময় গ্রামগঞ্জের ধনী মানী যারা।
বহু ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় তারা।।
নিরপেক্ষ থাকে যারা সাধারণ মানুষ।
চারদিকের তাড়নায় হয়ে যায় বেহুশ।।
একজনে পাঁচজনের মন কেমন করে রাখে।
সাধারণ মানুষ তখন পড়ে যায় বিপাকে।।
এক গ্রামের লোক যখন পাঁচ দল হয়।
ভালোবাসা আত্মবিশ্বাস থাকার কথা নয়।।
উশৃঙ্খলা-বিশৃঙ্খলা চা-খাওয়ার তাল।
মিছিলে দেখি তখন বড় বড় ফাল।।
দলাদলি মারামারি মামলা মোকদ্দমা।
কত কিছু ঘটে তখন নাই তার সীমা।।
আমাদের কেউ নয় আসলে তা জানি।
অন্যের মরা কেন আমরা যে টানি।।
ভোট যুদ্ধ হারা-জেতায় মীমাংসা হয়।
আগুন যদি নিভে তবে স্ফুলিঙ্গ রয়।।
এরপরে তিন-চার বৎসর চলে যায়।
ধীরে ধীরে আগুন তখন নিভে যেতে চায়।।
আবার নির্বাচন আসে যখন ফিরে।
পর্বের সেই স্ফুলিঙ্গ দাবানল সষ্টি করে।।
শোষকের শাসনতন্ত্র বহাল থাকিলে।
কী কাজ হবে পার্লামেন্টে ভালো লোক দিলে।।
শোষকের তৈরি শাসনকাঠামো যে তার।
কৃষক-মজুর শোষণের হাতিয়ার।।
কাল যা ছিল আজো আছে ভেবে দেখ তাই ।
এই তন্ত্রে শোষিতের পক্ষে কিছুই লেখা নাই।।
ব্রিটিশ গেল প্রকাশ্য জমিদার নাই।
পাঞ্জাবি শাসক-শোষক গেল যে সবাই।।
কৃষক-মজুরের তো দুঃখ গেল না।
এখন ভাবি এই সমস্ত শুধু প্রতারণা।।
কৃষক মজুর মেহনতিগণ বেঁচে যদি রবে।
শোষকের শাসনতন্ত্র ভেঙে দিতে হবে।।
শোষনহীন সমাজব্যবস্থা গড়তে যদি চাও।
কৃষক মজুর সর্বহারা এক হয়ে দাঁড়াও।।
অন্ন বস্ত্র শিক্ষা চিকিৎসা বাসস্থান।
সমভাবে করতে হবে সমাজকল্যাণ।।

বর্তমান অবস্থা লেখি আমি গ্রামের কবি।
পরিবর্তন হয়ে গেছে সমাজের ছবি।।
সুবিধা সুযোগ দিয়েছে নতুন জামানায়।
চলে সবাই লঞ্চে নইলে ইঞ্জিনের নৌকায়।।
হাঁটতে এখন চায় না মানুষ রিকশা গাড়ি চড়ে।
উন্নত হোটেল খোঁজে যায় যদি শহরে।।
আধুনিক চালচলনে গরিব-কাঙাল চলে।
উদের সঙ্গে বিড়াল যেন ডুব দিতে চায় জলে।।
এসব কথা বলি আর ভাবি তা অন্তরে।
গরম ভাতে বিড়াল বেজার কেউ যদি রাগ করে।।
গরিব নিজের ভাল-মন্দ বুঝতে নাহি চায়।
সুদী টাকা আনে তবু চা-সিগারেট খায়।।
চা পানের দোকান এখন রাস্তাঘাটে পাই।
শুধু ধনীরা খায় না গরিবেও খাই।।
একজনে চা পান সিগারেট খায়।
রোজ যদি পাঁচ টাকা বাজে খরচ যায়।।
এক বছরে যোগ দিলে কত টাকা হয়।
শোষিত মানুষ তার খবর নাহি লয়।।
বেহিসাব খরচ করে বাধা নাহি মানে ।
অসুবিধায় পড়ে তখন সুদী টাকা আনে।।
গ্রাম্য সুদের কবলে যখন পড়ে।
সর্বহারা হয়ে তখন আয়ু থাকতে মরে।।
সুদখোর ঘুষখোরদের মধ্যে রয়ে গেছে মিল।
ওরা যে হয় গরিবের নগদ আজরাইল।।
পূর্বের সুদখোরের মধ্যে ছিল কল-কৌশল।
কলমের প্যাঁচে নিত গরিবের সম্বল।।
এখন সুদখোর যারা ব্যাঘ্র আকার ধরে।
কলম নয় তারা তাদের শক্তি প্রয়োগ করে।।

সত্য কথা বলি যদি আমায় পাবে দোষে।
স্বার্থপরগণ টাকা দিয়া লাঠিয়াল পোষে।।
টাউট দালাল ঘুষখোর তার লাঠিয়াল বাহিনী।
আমি আর কী বলিব এইসব কাহিনী।।
যুক্তি নয় তারা যখন শক্তি প্রয়োগ করে।
দুর্বল আতঙ্কিত হয় মান-ইজ্জতের ডরে।।
মিথ্যা মামলা জোর-জুলুম অত্যাচার করে।
গরিব পলায় জীবন নিয়ে ভিটা মাটি ছেড়ে।।
মানুষে মানুষে কত ভালোবাসা ছিল।
এখন এই ঝগড়া বিবাদ কেন যে বাড়িল।।
মামলা মোকদ্দমা নাই শান্তি ছিল দেশ।
বিবাদ হলে গ্রামের বিবাদ গ্রামেই হইত শেষ।।
এখন মামলা-মোকদ্দমা দেশের লোকে করে।
টাকা পয়সা যায় আর দ্বন্দ্ব করে মরে।।
ঝগড়াঝাটি মারামারি আছে সর্বদায়।
এই সুযোগে দুষ্ট লোকে স্বার্থের সন্ধান পায়।।
আর এক কথা বলি হতে পারে দোষ।
যার কাছে যে কাজে যাও সেই চায় ঘুষ।।
বর্তমানে সুদ-ঘুষের চরম আক্রমণে।
কৃষক মজুর দিশেহারা বাঁচিবে কেমনে।।

গ্রামে যে বিচার ছিল তা-ও প্রায় নাই।
বর্তমান অবস্থায় যাহা চোখে দেখতে পাই।।
দলগত গোষ্ঠীগত স্বজনপ্রীতি আছে।
সুবিচার পাওয়ার দিন চলে গেছে পাছে।।
কোর্ট আদালত কাছে যখন মামলা হয় বেশি।
মানুষে মানুষে এখন বাড়ছে রেষারেষি।।
গ্রামে-গঞ্জে দুর্নীতির বন্যা রয়েছে।
সাধারণ মানুষ এখন নিরুপায় হয়েছে।।
সুযোগ সন্ধানী যারা তাদের হলো ফুল ।
গড়ে উঠছে নতুন করে টাউটের দল।।
স্বার্থপররা দিনরাত দেয় কুমন্ত্রণা।
হিতে বিপরীত ঘটায় বাড়ায় যন্ত্রণা।।
চারদিকে টাকার জয়, গরিবের মরণ।
চলেছে আমলাতান্ত্রিক নির্মম শোষণ।।
আদালতের খরচ যাহা না দিলে সারে না।
মামলার খরচ বহন করতে গরিবে পারে না।।
শক্তি সম্পদ আছে যাদের তাদের হবে জয়।
গরিব বাঁচবে কেমন করে তাই তো মনে ভয়।।
শিক্ষা সম্পদ নাই শক্তি নাই যার ।
তাদের তো বেঁচে থাকার উপায় নেই আর।।
জন্ম নিয়েছি যখন জীবনের গান গাই।
মানুষ মানুষের মতো বেঁচে থাকতে চাই।।