আত্মচরিত

কী করে করবো শুরু? কোনো সূত্র চিন্তার রোদ্দুরে
ঝলসে ওঠে না, শুধু ভেবে মরি। রাজরাজড়ার
তালিকায় নামগোত্র নেই কিংবা মোটরে বেড়ালে
জয়মালা হাতে জনসাধারণ থাকে দাঁড়িয়ে
মুখরিত রাস্তার দু’পাশে; আমার প্রস্তরমূর্তি
জানি এ শহরে করবেন না উদ্ঘাটন কোনোদিন
নধর নগরপালা কোনো। তবু আমি ধার-করা
ধড়াচূড়া নিয়ে হবো হাজির প্রকাশ্যে? কল্পনার
সেজবাতি জ্বেলে এক বন্ধ ঘরে কুলের ঠিকুজি
বানাবো আপন মনে প্রাচীন কবির মতো? এই
ঝলমলে রঙ্গালয়ে অতি গৌণ আমার ভূমিকা।
তবু কেন অক্ষরে অক্ষরে আত্মকথা সাজাবার
সহসা খেয়াল হলো, এ সওয়াল অসঙ্গত নয়।
জবাবে বলতে পারি, মর্ত্যের মানুষ মাঝে মাঝে
এমন অনেক কিছু করে, যার কোনো ব্যাখ্যা নেই,
অথবা আদপে নয় যুক্তিসিদ্ধ। যদিও আমার
জন্ম জানি জগৎ সংসারে কোনো ঘটনা হিশেবে
এমনকি জন্মকানা ডোবায় ব্যাঙের লাফও নয়,
তবু প্রথামতো শুরুতেই জন্মবৃত্তান্তের খেই
ধরা যাক।

উনিশ শো ঊনত্রিশ সালে অক্টোবরে
জন্মেছি ঢাকায় আমি ছায়াচ্ছন্ন গলির ভেতরে
ভোরবেলা নিম্নমধ্যবিত্ত মাতামহের নিবাসে।
আমার সুদূর পূর্ব পুরুষেরা আরব ইরান
কিংবা মধ্যপ্রাচ্যস্থিত অন্য কোনো দেশ থেকে তেজী
ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে অথবা উত্তাল সমুন্দরী
কিস্তিতে খাটিয়ে পাল এই বঙ্গদেশে পদার্পণ
করেছেন কিনা, এই তথ্য নিয়ে কস্মিনকালেও
তুলি নি চায়ের কাপে ঝড়। এদেশের মাটিতেই
আমার নিজস্ব সব শেকড়-বাকড় জেনে খুশি।

পাঁচটি দশক গেছে, যেন এক্সপ্রেস ট্রেন দ্রুত
যাচ্ছে ছুটে, মাঝে মাঝে ছোট ছোট স্টেশন নিমেষে
ঝলসে উঠছে শুধু। সময়ের খর দন্তচিহ্ন
ভয়ানক ব্যাপ্ত আজ ঝলসানো অস্তিত্বে আমার।
অথচ সেদিন আমি ঝুলিয়ে খয়েরী ব্যাগ কাঁধে
মর্নিং ইশকুলে গেছি শিউলি ফুলের ঘ্রাণ শুঁকে,
পেরিয়ে অনেক অলিগলি ছুটি শেষে কাচবন্দি
দুলদুল ঘোড়া দেখে। বলেছি পাখির সঙ্গে কথা,
গোলাপের সঙ্গে আমি জুড়েছি আলাপ বারংবার-
বাস্তবে হরিণ না দেখেও হরিণ শব্দটি দেখে
চলে গেছি সে কোন্ গভীর বনে মনে মনে আর
ঝর্ণার পানিতে মুখ দেখতে পেয়েছি স্বচ্ছতায়-
দর্পণের অন্তরালে দেখেছি দর্পণ।

কখন যে
আমার নিজেরই অগোচরে খুঁজতে করেছি শুরু
বৃষ্টিভেজা সরু গলি, স্পন্দিত গাছের পাতা, জীর্ণ
জুতো, রোদ-নাওয়া গিরগিটি, পোড়োবাড়ি, স্নানরতা
তরুণীর বিহ্বল নগ্নতা, মৃত্যুপথযাত্রী চোখ,
পাখির বাসায় কী ব্যাকুল কবিতার পঙ্ক্তিমালা।
আজকাল প্রুফকের ঢঙে পথ হাঁটি, ঢিলেঢালা
ট্রাউজারে পরাবাস্তবের চন্দ্রধূলি, শস্তা কোনো
চাখানায় বসে ঢুলি, শুনি সেই কবেকার গান,
পক্ষিরাজ উড়ে যায় মেঘের আড়ালে, বাল্যসখী
পাশে এসে হাত ধ এ দেয় টান, অথচ সে জানি,
কয়েক বছর আগে মারা গেছে, আমিও তো নিত্য
একটু একটু করে মরছি নিশ্চিত। ক্রমাগত
বড় বেশি লোভী হয়ে উঠছে চিরুনি শাদা-কালো
আমার চুলের জন্যে। চখ দুটো আগেকার মতো
নেই আর, বেশিক্ষণ বইয়ের পাতায় রাখলেই
খচ্খচ্ করে, বড় কষ্ট পাই, তখন চোখের
পাতা বুঁজে রাখলে আরা, বুঝি পঞ্চাশের পরে
এরকমই হয়, হতে থাকে। আজ আমি বড় একা,
বন্ধুরা যে-যার মতে পথে পর্যটক, কোনোখানে
জমে না তেমন আড্ডা। মেয়েরা স্বামীর ঘর করে,
ছেলেটা এড়িয়ে চলে সকল সময়। আর যিনি
জীবনসঙ্গিনী তিনি সম্প্রতি আছেন মেতে তার
নাতি নিয়ে সারাক্ষণ। আমি শুধু কাকতাড়ুয়ার
মতো থাকি এ সংসারে নির্জন নেপথ্যে। মৃত্যু যত
কাছে আসে ততই জীবনতৃষ্ণা যায়, বেড়ে যায়।
কখনো-সখনো

বই থেকে চোখ তুলে দেখি নীল
আসমান, পায়রার ওড়া, রৌদ্রে হাতের রুলির
নড়া কারো, কখনো-বা স্বদেশ ভাবনা ব্যেপে আসে।
বাংলাদেশ আমার আপন দেশ, তবু আমি নই
বাঁধা এই ভৌগোলিক সীমায় কখনো; এই বিশ্বে
যেখানে জননী তার সন্তানের মুখে তুলে দ্যায়
স্নেহার্দ্র খাবার, আর যে-দেশে প্রেমিক তার লাজ-
রক্তিম নারীর কানে কানে বলে নিত্য প্রেমকথা,
যে-দেশে শিশুরা পথে কিংবা নদীতীরে আনন্দের
ঢেউয়ে ভেসে বানায় বালির দুর্গ, যে-দেশে তরুণী
গলা ছেড়ে গান গায়, যে-দেশে এখনো পাখি ঠোঁটে
বয়ে আনে খড়কুটো, বানায় নিজস্ব বাসা আর
যে-দেশে কবির বাণী গভীর ধ্বনিত হয় প্রেমে,
শ্রমে নিত্য প্রাণে, সেই দেশই স্বদেশ আমার।