কী সঞ্চয় রেখেছো

কালের কামড়-খাওয়া ছন্নছাড়া হে বংশীবাদক
তুমি কি নিজেই হবে নিজের খাদক
আত্মনাশী প্রাণীর মতন আজ? এখন, এখন কেন আর
আক্ষেপের সুর শুধু বাজাও একাকী বারবার?
বস্তুত এই তো চেয়েছিলে…
এই মতো গাছপালা দেখে দেখে, আসমানী নীলে
চোখ রেখে, কখনো উদাস
প্রান্তরে পথিক হয়ে মনের মোহন ফরমাশ
খেটে খেটে হৃদয়ের অন্ধকারে অজস্র কুসুম
ফুটিয়ে নেপথ্যে বেঁচে থাকা; খড়কুটোময় অত্যন্ত নিঝুম
দ্বিপ্রহরে খরগোশের দৌড়, হরিণের আনন্দিত লাফ মনে
তুলে নেয়া আর গৃহকোণে
বিড়ালের নিরিবিলি ঘুমের ভিতরে
বসবাস, ফেরেশতার পাখার ছায়ায় বুক ভরে
সুগন্ধি বাতাস নেয়া-এর চেয়ে বেশি কিছুর উদ্দেশে
কখনো গায়নি গান আকাঙ্ক্ষা তোমার। মেঘে ভেসে

ভেসে সারাদিনমান তুমি কি আপনার বংশী ধ্বনি শুনে
কিংবা তারা গুণে
গুণে মধ্য রাতে খুব ক্লান্ত হয়ে গ্যাছো? বুঝি তাই পূর্ণিমার,
ফুলের পাখির সঙ্গে রাগ করে অন্ধকার
কুঠরিতে রক্ত তুলে গলায় নিজের
ওপরই ভীষণ প্রতিশোধ নিতে চাও। কেউ টের

পাক আর নাই পাক, তুমি নিজে জানো
কী জটিল নিষ্করুণ আত্মপ্রতারণা-জাল রয়েছে জড়ানো
জীবনের পাকে পাকে। অথচ এই তো চেয়েছিলে…
কখনো হাঁসের বিলে,
কখনো বা ফ্যাক্টরির চিম্‌নির ধোঁয়ায়
চোখ রেখে অলৌকিক কিসের ছোঁয়ায়
বেঁচে থাকা। তবে কেন স্মৃতির সৈকতে
প্রেতের মতন হাঁটো, হঠাৎ হারিয়ে যাও নিঃস্ব চোরা পথে
অভিমানে? মওয়া শরীরের ভার টেনে
নিজেকে ধিক্কার দাও আজ ঘন ঘন? কার কাছে হার মেনে
তুমি হবে নতজানু, বাঁশি ফেলে দাঁড়াবে হে দীন
প্রত্যাশাবিহীন উদ্ভিদের মতো ভাবলেশহীন?

নাকি তুমি একালের দারুণ নিষ্ঠুর
বিলুপ্তির সুর
তুলবে বাঁশিতে? কিন্তু দেখি, অকস্মাৎ
সুরের জগতে নামে ক্রুর পক্ষাঘাত।
ভৈরবী কি পূরবীকে আত্মসাৎ করে
ব্যাপক স্তব্ধতা অগোচরে।
তুমি ঠায় থাকবে দাঁড়িয়ে,
মরীচিকাময়, পথে নিরাশ্রয়, চকিতে হারিয়ে
তমার নিজস্ব সুর? এদিকে তমসা আসে ব্যেপে
দেশে দেশান্তরে; স্বাপদেরা ওঠে ক্ষেপে,
দিকে দিকে কেবলি রক্তাক্ত হয় প্রাণের প্রতিমা।
লক্ষ্যহারা বিপর্যয়ে অগাধ নীলিমা,
প্রগাঢ় সবুজ মুছে যায়, কী ধূসর
জঞ্জালে আচ্ছন্ন মনে হয় চরাচর।
হে বংশীবাদক কী সঞ্চয়
রেখেছো অন্তরে, যার বলে এ প্রলয়ে হবে তুমি মৃত্যুঞ্জয়।

[প্রথম লেখন: ৭ মার্চ, ১৯৭৬
পরিমার্জনা:১২ জানুয়ারি, ১৯৮৩]