নৈশ প্রহরে পরস্পর

কি শুনে হঠাৎ ভেঙে গেল ঘুম গভীর রাত্তিরে?
কবর খোঁড়ার শব্দ, নাকি প্রেতের আবছা স্বর
আমাকে জাগিয়ে দিল? পর মুহূর্তেই ভাঙে ভুল-
আমার শয্যার পাশে দেখি একা রয়েছে দাঁড়ানো
আমারই সন্তান। তার কণ্ঠস্বর যেন কোনো দূর
বিষণ্ণ সৈকত থেকে এলো ভেসে ‘এই এই, শোনো,
কে তুমি, কে তুমি?’ তার প্রশ্নের শলাকা হল বিদ্ধ
হৃৎপিণ্ডে আমার; আর্ত আমি, অসহায়, তার দিকে

চেয়ে থাকি, বোবা, চেষ্টাহীন। কতদিন তার কত
ভৌগোলিক কৌতূহল মিটিয়েছি, নিত্য খুঁটিনাটি
প্রশ্নের উত্তর আমি জুগিয়েছি তাকে সহজেই।
অথচ এখন ব্যর্থ, পরাজিত এ নৈশ প্রহরে।

জানি সে অসুস্থ এক অসুখী বালক, হয়তোবা
সুখ-দুঃখ তাকে আর করে না বিহ্বল! নিমেষেই
স্বাভাবিক রৌদ্রছায়া তার চোখে, হায়, অন্য কিছু
হয়ে যায়! আমিও অস্পষ্ট চেনা, কখনো অচেনা

তার কাছে। কিন্তু তবু তার সেই ভীষণ জিজ্ঞাসা
প্রাসঙ্গিক বড় বেশি। তাহলে কে আমি? কার
পরিচয় আজ তুলে ধরব এই বালকের কাছে?
যে প্রবল ভোগী জীবনের গ্রীবায় চুম্বন আঁকে
বার-বার, তার? নাকি যে-যোগী অলক্ষ্যে হাঁটে ধু-ধু
প্রান্তরে একাকী, রুক্ষ, রিক্ত, হাতে রাখে না কিছুই,
তার? কিংবা অস্তিত্বের স্তরে স্তরে নানান যুগের
স্মৃতির ভগ্নাংশ নিয়ে যারা হাসে, কাঁদে, চুল ছেঁড়ে,

দেখা দিয়ে সহসা লুকায়, মুখ ঢাকে মনস্তাপে,-
আমি কি তাদেরই কেউ বাস্তবিক? বিনষ্ট, দণ্ডিত?
দ্বিধার ঠোকরে ছিন্নভিন্ন নিজেকেই প্রশ্ন করি
ঘুরে ফিরে, বলো তবে কোন আমি প্রকৃতই আমি?

সম্মুখে দাঁড়ানো প্রশ্নাকুল যে বালক, তার মধ্যে
আমার ঔরসজাত সন্তান কোথায়? এই ঘরে
সুস্থ, স্বাভাবিক সারাবেলা করত যে খেলা, করেছে
সে প্রস্থান বহুদূরে; একে আমি চিনি না বস্তুত।
এ এক নির্জ্ঞান তটে রয়েছি দাঁড়িয়ে আমি আর
আমার সন্তান, যেন দুই প্রতিদ্বন্দ্বী, নিরুত্তর।