পথ হারানো বিএনপি কি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে

১ সেপ্টেম্বর বিএনপি ৪২ বছর পেরিয়ে ৪৩ বছরে পদার্পণ করল। এই বয়সী কোনো দলকে নাবালক বলা যায় না। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, চার দশকে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির যে পরিপক্বতা অর্জন করার কথা, তা পারেনি মূলত নেতৃত্বের দোদুল্যমানতা, সিদ্ধান্তহীনতা ও ক্ষেত্রবিশেষে হঠকারিতার জন্য। তাদের আচরণে দেশবাসী তো বটেই, দলের তৃণমূলের নেতা-কর্মীরাও হতাশ।

ক্ষমতায় থেকে বাংলাদেশে কোনো দল জনগণের আস্থা ধরে রাখতে পেরেছে, এমন নজির নেই। সে ক্ষেত্রে বিরোধী দলের ওপরই জনগণের ভরসা রাখার কথা। কিন্তু বাস্তবতা হলো মানুষ ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল-উভয়ের প্রতি আস্থা হারিয়েছে।

জাতীয় সংসদে আসনসংখ্যা যত কম হোক না কেন, বর্তমানে বিএনপিই দেশের প্রধান বিরোধী দল। আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রীদের প্রতিদিনকার বক্তৃতা-বিবৃতির লক্ষ্যবস্তুও বিএনপি। জাতীয় পার্টিকে মনে করা হয় সরকারের ‘ঘরের লোক’। এ অবস্থায় ক্ষমতাসীনদের ব্যর্থতা-অক্ষমতার ফসল যে বিএনপি ঘরে তুলে নেবে, তার কোনো সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছে না।
বিজ্ঞাপন

অনেকে মনে করেন, বিএনপি মৌলবাদী জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোট করার কারণে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারছে না। বিএনপির নেতাদের দাবি, সরকারের দমন-পীড়নের কারণে যেখানে তাঁরা রাস্তায় নামতে পারছেন না, সেখানে আন্দোলন গড়ে তুলবেন কীভাবে? তাঁদের নিশ্চয়ই জানা আছে যে অতীতে কোনো সরকারই বিরোধী দলকে জামাই আদরে রাখেনি। জেলজুলুমের ঝুঁকি মাথায় নিয়েই বিরোধী দলকে আন্দোলন করতে হয়।

বিএনপি তিন দফায় ক্ষমতায় ছিল। প্রথম দফায় ১৯৭৮ (১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বরের আগে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় থাকলেও বিএনপি ছিল না) থেকে ১৯৮২ সাল। দ্বিতীয় দফায় ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল। তৃতীয় দফায় ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আশির দশকে বিরোধী দলে থাকতেই বিএনপি সুবর্ণ সময় পার করেছে। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এরশাদ বন্দুকের জোরে ক্ষমতা দখল করার পর বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের অনেকেই এরশাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। সেই কঠিন সময়ে খালেদা জিয়া দলীয় প্রধানের দায়িত্ব নিয়ে রাজপথে আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। দলকে সংগঠিত করেছেন। বিএনপির নতুন প্রজন্মের অনেক নেতা এসেছেন আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। আওয়ামী লীগের চেয়ে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও খালেদার আপসহীন ভূমিকার কারণে বিএনপি ১৯৯১-এর নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল। এমনকি ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদেও বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে কার্যকর চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল। কিন্তু ২০০৯ সালের পর দলটি সেই ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে। জনগণ তখনই বিরোধী দলের কথায় রাস্তায় নামবে, যখন মনে করবে তাদের দাবিদাওয়া-অধিকার নিয়ে তারা কথা বলছে। বিএনপি গত ১১ বছরে দলীয় ইস্যুতে যত কর্মসূচি পালন করেছে, জনগণের দাবিদাওয়া নিয়ে তার সিকিভাগও করেনি। আর এখন দলটি আন্দোলন করবে কি, নিজেই পথ হারিয়ে ফেলেছে।

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে (নির্বাহী আদেশে বর্তমানে জেলের বাইরে থাকলেও তিনি প্রকাশ্য রাজনীতি করতে পারছেন না) বিএনপি কে চালাচ্ছেন, তা-ও দলের সাধারণ নেতা-কর্মীদের কাছেও পরিষ্কার নয়। ব্যক্তিগত আলাপে অনেকে আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘আন্দোলন কীভাবে হবে। আমরা হয়তো দীর্ঘ আলোচনার পর কোনো সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু রিমোট কন্ট্রোলে সেটি বাতিল হয়ে যায়।’ রিমোট কন্ট্রোল মানে তারেক রহমান। বিএনপির অধিকাংশ নেতা ২০১৪ সালের নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে ছিলেন। কিন্তু ‘লন্ডনের প্রত্যাদেশের’ কারণে সেটি হয়নি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরাও মনে করেন, ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন বিএনপির ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। যত প্রতিকূল অবস্থাই হোক, বিএনপি ওই নির্বাচনে গেলে তারাই সংসদে প্রধান বিরোধী দল হতো।

বিএনপি যে প্রতিকূল পরিবেশের অভিযোগ তুলে ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ নেয়নি, তার চেয়ে শতগুণ বেশি প্রতিবন্ধকতা ছিল ২০১৮ সালের নির্বাচনে। বিএনপির নেতারা যুক্তি দেন, দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলন হিসেবে তাঁরা নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। নির্বাচনের পর সেই আন্দোলন করতে পারেননি বলেই খালেদা জিয়াকে নির্বাহী আদেশে জামিন নিতে হয়েছে।

নির্বাচনের আগে বিএনপি যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করেছিল, সেটি শুরুতেই হোঁচট খায়। দলের কোনো কোনো নেতা এই জোটের মধ্যে ‘ষড়যন্ত্রও’ আবিষ্কার করেন। খালেদা জিয়া জেলে যাওয়ার পর তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হয়, যিনি ২০০৮ সাল থেকে লন্ডনে অবস্থান করছেন এবং দেশত্যাগের আগে রাজনীতি ছাড়ারও ঘোষণা দিয়েছিলেন। দলের অনেক নেতা-কর্মীও মনে করেন, বিএনপির দুরবস্থার জন্য তিনিই দায়ী। তদুপরি তারেক রহমান ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মামলায় দণ্ডিত আসামি। এ রকম একজন ব্যক্তিকে দল পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া কতটা সমীচীন হয়েছে, তা-ও ভাবার বিষয়। তাঁর কারণে দলের অনেক নেতা-কর্মী নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছেন। কেউ কেউ পদত্যাগও করেছেন।

তৃণমূলের নেতা-কর্মীরাই বিএনপির বড় শক্তি। ১২-১৩ বছর ধরে তাঁরা জেল-জুলুম সহ্য করছেন। কিন্তু এই তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের সঠিক পথে পরিচালনা করার ইচ্ছা বা ক্ষমতা বর্তমান নেতৃত্বের আছে বলে মনে হয় না। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যের বিরোধও আর লুকোছাপার বিষয় নয়। করোনার আগে দলীয় অফিসের চেয়ে স্থায়ী কমিটির সদস্যদের বাড়িতে সমর্থক নেতা-কর্মীদের ভিড় বেশি থাকত।

১৯ সদস্যের স্থায়ী কমিটির বেশ কটি অনেক দিন ধরে শূন্য আছে। অধিকাংশ জেলায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই। ছাত্রদল, যুব দল, মহিলা দল, স্বেচ্ছাসেবক দলসহ সব সহযোগী সংগঠন অগোছালো। কোনো কোনো কমিটিকে কেন্দ্র করে দলীয় অফিসের সামনে বিক্ষোভ-ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে। বর্তমানে দলের কার্যক্রম সীমিত হয়ে পড়েছে দিবস পালন, নেতাদের বক্তৃতা এবং রোজকার প্রেস ব্রিফিংয়ের মধ্যে।

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের লেখা একটি প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল, ‘বিএনপি আবার ঘুরে দাঁড়াবে’। ওই লেখায় তিনি দেশবাসীকে অতীতের বিজয়গাথা শুনিয়েছেন। দল কীভাবে ঘুরে দাঁড়াবে, সে পথ বাতলাননি। সম্ভবত দেশে অবস্থানকারী বিএনপির নেতাদের সেটি জানাও নেই। তাঁরা তাকিয়ে থাকেন লন্ডনের দিকে। কিন্তু তাঁদের জানা উচিত তারেক আয়াতুল্লাহ খোমেনি নন যে বিদেশে বসে দেশে গণ-অভ্যুত্থান ঘটাবেন।

বিএনপি এখনো চলছে জিয়া ও খালেদা জিয়ার ভাবমূর্তিকে সম্বল করে। সেখানে নতুন কারও ‘ভাবমূর্তি’ গড়ে তোলার চেষ্টা কেবল ব্যর্থ হবে না, বুমেরাং হওয়ার আশঙ্কাই বেশি।

প্রকাশকাল: ৫ সেপ্টেম্বর ২০২০