কালো চুল

আজও তো মনে হয় মেঘ যেন মেঘ নয়, কার চুল,
কার চুল, কালো চুল, এলো চুল,
কঙ্কাবতীর কালো এলো চুল!
কঙ্কাবতী তার কালো চুল খুলে দিলো সন্ধ্যার সোনালি বারান্দায়,
স্বর্গের মায়াবী বারান্দায়,
লাল সূর্যাস্তের জানলায়;
লাগলো আলো চুলে, জাগলো উচ্ছ্বাস স্বচ্ছ সবুজের,
বিলোল হলুদের আগুনে বেগনির বিশ্রাম,
উষ্ণ বাদামির হৃদয়ে ধূসরের শান্তি,
রঙের অঙ্গনে আধার সন্ধ্যার শান্তি।

আর্দ্র-উজ্জ্বল ধারালো-ছলোছলো ভাদ্রের হলদে বারান্দায়
কঙ্কাবতী এসে দাড়ালো।
খুলে দিলো কালো চুল, আহা কী কালো চুল!
লাল সূর্যাস্তের সন্ধ্যায়।
খুলে গেলো পশ্চিমে সূর্যের জাদুকর জানালা
রঙের রূপসীরা বাড়লো মুখ ঐ শৌখিন প্রাসাদের জানলায়,
দাঁড়ালো দলে-দলে রৌদ্রের প্রাসাদের ধারালো-জ্বলোজ্বলে জানলায়,
পশ্চিমে অন্তিম সূর্যের জানলায়-জানলায়।
তবু তো পা’র হ’য়ে উত্তাল-লাল আর উদ্দাম হলুদের বন্যা
কখন তুমি এলে, কঙ্কা!
সিন্দুর-আলতার হলদে-লালে জ্ব’লে আহ্লাদে গ’লে যাক সন্ধ্যা,
রাত্রি তুমি নিলে, কঙ্কা।
তোমার কালো চুল ছড়ায়ে দিলে দূর নীল দিগন্তের প্রান্তে,
মত্ত বিপ্লবী অপলাপ পার হ’য়ে দাঁড়ালে শাশ্বতী শান্তি;
আর্দ্র-উজ্জ্বল তীব্র-থরোথরো ভাদ্রের সৌম্য সীমান্তে
আশ্বিন এনে দিলে, কঙ্কা!

সৌর-শৌখিন দীপ্ত জানালায় নিবলো একে-একে
রেশমি রূপসীরা; সোনালি অপ্সরী সাজলো সবুজে;
হলদে আগুনের রঙ্গ থেমে গেলো বেগনি-বাদামির
অলীক অঙ্গনে; রঙের রঙ্গের রঙ্গমঞ্চের পঞ্চ অঙ্ক
হঠাৎ হ’লো শেষ; সন্ধ্যাতারা-ফোটা শান্ত আশ্বিনে
তীব্র ভাদ্রের সন্ধ্যা নিবলো; বাজলে ঘণ্টা
শিউলি-শিশিরের; নামলো নিঃসীম নীলিম রাত্রি
ধূসর সুন্দর দূর দিগন্তে; আলোর উল্লোল
আকাশ ডুবে গেলো কালোর বন্যায়,
তোমার নীল-কালো চুলের বন্যায়, কঙ্কা, কঙ্কা!
বাজলো ঘণ্টা ‘কঙ্কা! কঙ্কা!’ অন্ধকারে আর
সন্ধ্যাতারকার স্তব্ধ সবুজে। সব তো হ’লো শেষ;
এখন শুধু তুমি, শব্দ শুধু শুনি ‘কঙ্কা, কঙ্কা,
কঙ্কা, কঙ্কা!’
তারার কম্পনে লক্ষ-কোটি যুগ বাজায় কঙ্কণ
‘কঙ্কা, কঙ্কা!’
আঁধার আকাশের হাজার বিশ্বের বহ্নি হ’লো লীন
তোমার কালো চুলে,
তারার অগ্নিতে ছড়ালো মগ্নতা তোমার কালো চুল;
তোমার কালো চুল যুগ-যুগান্তের দূর সীমান্তে
ছড়ালো শান্তি, অতল অন্তিম শান্তি, শান্তি,
শান্তি, কঙ্কা,
কঙ্কা, শান্তি।

কঙ্কা, তুমি যেই দাড়ালে বিশ্বের ছায়াপথে ছড়ানো বারান্দায়,
দাড়ালে চুপ ক’রে কুটিল জঙ্গম কালের ক্রান্তির প্রান্তে,
একটু মুখ তুলে খুলে দিলে কালো চুল লক্ষকোটি তারা ছড়ায়ে,
অমনি শান্তি, শান্তি নামলো,
থামলো ক্রান্তির মত্ত উচ্ছাস,
ডুবলো কালো চুলে বস্তু-বিশ্বের ব্যস্ত উচ্ছাস,
ডুবলো বিপ্লব নিশীথ-নিঃসীম নীল সমুদ্রে,
কঙ্কা, কঙ্কা!
আঁধার-বন্যায় হাজার বিশ্বের তারার বুদ্বুদ
ফুটলো, ডুবলো;
বিশ্ব-বস্তুর বুকের বিদ্যুৎ মিশলো কালো চুলে-
শান্তি, শান্তি।
মত্ত অস্থির রঙিন দৃশ্যের নৃত্য ফেলে দিলো
লজ্জা, সজ্জা;
মগ্ন হলো তার নগ্ন সত্তা স্তব্ধ রাত্রির
লগ্নে, কঙ্কা;
কঙ্কা, তুমি এই স্তব্ধ গম্ভীর আদিম অন্তিম
রাত্রি, শান্তি;
সব তো হ’লো শেষ, এখন শুধু তুমি, তোমার কালো চুলে
শান্তি, শান্তি।