কার্তিকের কবিতা

গ্রীষ্মপ্রেমিক, বর্ষাবিলাসী আমি,
দীর্ঘসূত্ৰী দিবস আমার প্রিয়,
তবু এ-নবীন-হেমন্তদিন যেন
মাঝে-মাঝে মোর মনে হয় রমণীয়।

দক্ষিণায়ন ক্লান্ত তপনে একটু-একটু ক’রে
কাছে টেনে নেয় রোজ,
শীতের সঙ্গে কার্তিক তার
অনতিব্যক্ত আত্মীয়তার
চিহ্নগুলির দিনে-দিনে করে খোঁজ।
সহসা শিহরি’ কৃশ দু’পহরে
উত্তর বায় বার্তা বিতরে,
‘নেই, দেরি নেই আর।’

আবার কখনো সান্ধ্য আকাশে
ক্ষীণ বৈশাখী মায়া,
কখনো মেঘের মেদুর ধূসরে
যেন শ্রাবণের ছায়া।
এই তো সেদিন বৈশাখ ছিলো
দীপ্ত রেখায় আঁকা,
মনে হয় যেন মুখ ফেরালেই
পাবো শ্রাবণের দেখা।
আসলে এখনো মনে-মনে আমি
ছিনু গ্রীষ্মের দেশে,
সহসা শিশির-পরশে বাতাস
ব’লে চ’লে গেলো ভেসে-
‘নেই, নেই, আর নেই।’
ভাবতে পারি না একটি বছর
গেলো এত সহজেই।

গ্রীষ্মের লাগি’ নিশ্বাস ফেলি আমি:
-এখনও সে কত দূর!
কবে যে আবার আদ্র আঁধারে
ভরা ভাদ্রের ঝরঝরধারে
সব রূপ হবে সুর!
মনে-মনে আমি তারই দিন গনি-
বেঁচে থাকা তবু ব্যর্থ হয়নি,
শান্ত প্রবীণ হেমন্তদিন
তাও লাগে সুমধুর।

যদিও আপন কুলায়ের টানে
বাঁধা হৃদয়ের পাখি,
আতিথেয়তার প্রবাস কখনো
তবু সুখী হয় নাকি?
সেই মতো এই ছোটো-হ’য়ে-আসা দিন
তারও কাছে মোর কিছু যেন হ’লো ঋণ,
কিছু আলো, কিছু আকাশ, কিছুটা রোদ।
-এই কবিতায় হবে কি সে-ঋণ শোধ?

শীতের সঙ্গে জীবনের শত্রুতা,
মৃত্যুর সখা সে যে;
তবু তো শীতের প্রথম দূতের দল
সোনালি-সুনীলে সেজে
নেচে-নেচে এলো, যেন কত রমণীয়।

ঋতুর ক্রান্তি মনের ক্লান্তি মেজে
সারা পৃথিবীরে আবার করে-যে প্রিয়:
বারে-বারে একই নতুনে রচনা,
তবু সে-নতুন পুরোনো হয় না,
ফিরে-ফিরে যেন আরো বেশি ভালো লাগে
কিছু সুর, কিছু পরশ, কিছু-বা দৃশ্য;
হোক শীত, হোক বর্ষা, হোক-সে গ্রীষ্ম।

হায় রে, মানুষ করেছে ফন্দি
প্রকৃতির হবে প্রতিদ্বন্দ্বী!-
কেড়েছে শক্তি, শেখে নাই তার ছন্দ।
মানবভাগ্য-আবর্তনের
যে-কোনো সূক্ষ্ম ক্রান্তিক্ষণের
হৃৎ-বিদারণ আজও কী দারুণ দ্বন্দ্ব!
প্রকৃতির কোলে যে-নতুন আসে
তারই ছোঁওয়া লেগে বিশ্ব বিকাশে,
এমনকি, পীত শীতের আভাসে
খানিক ঝরায় সুধা,
আর মানুষের ইতিহাস-পটে,
নতুনের রেখা যদি কিছু ফোটে,
অমনি ভীষণ বিস্ফোরণের
অমিত শোণিত নিঃসরণের
মূঢ় ক্রূরতা বিশ্বে ছড়ায়
নরক, মড়ক, ক্ষুধা।