ইব্‌লিস ও বনি আদম

স্থান…মানুষের বস্তি
কাল…গভীর রাত্রি

(ইব্‌লিসের প্রবেশ)
বনি আদম
কি আশ্চর্য! আজকেও তুমি?

ইব্‌লিস
আজো আমি এই রাত্রে
এসেছি উত্তপ্ত স্নায়ু, জেনে যেতে সর্বশেষ কথা।

বনি আদম
কি কথা?

ইব্‌লিস
যে কথা তুমি কোনদিন করোনি স্বীকার।
তোমার ঔদ্ধত্য যাকে বক্রোক্তির শাণিত খঞ্জরে
ক্রমাগত কেটে গেছে।

বনি আদম
অর্থাৎ বিজয়ী তুমি কিনা,
সে কথাই আজ ফের জেনে যেতে চাও! কিন্তু আমি
আমার বক্তব্য যত সহজেই বলেছি বুঝিয়ে,
আশা করি বুঝেছো তা; প্রতি রাত্রে তবু কেন ফিরে
আমার দুর্লভ ঘুম ভাঙানোর এ দুষ্ট প্রয়াস?

ইব্‌লিস
শেষ কথা বলে দাও, চলে যাই আমি নির্বিবাদে,
আর কোন দীর্ঘ রাত্রে জ্বালাবো না।

বনি আদম
বলেছি সে কথা
বহুবার, বহুভাবে দ্ব্যর্থহীন ভাষায়… জীবনে
প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সংগ্রামে।

ইব্‌লিস
প্রশ্নের উত্তর তাতে
মেলে নাই। চূড়ান্ত জয়ের বার্তা…কাম্য যা আমার
পাইনি তা কোনদিন সংঘর্ষের মুখে। তাই আমি
আবার এসেছি ঘুরে জেনে যেতে সর্বশেষ কথা।

বনি আদম
ফিরে যাও পূর্ববৎ দুরাকাঙ্ক্ষা অহেতুক বাড়িয়ে
চূড়ান্ত জয়ের বার্তা পাবে না জীবনে।

ইব্‌লিস
এ ধৃষ্টতা
বনি আদমের।

বনি আদম
মহান প্রকৃতি এই মানুষের।
আল্লাহ ছাড়া কারু কাছে হয় না যে আনত, অথবা
জিন্দেগীতে নতশির;- মাটি, পানি, আগুন, হাওয়ার
বিশাল, বিচিত্র, বিশ্বে, অফুরন্ত কর্মের প্রবাহে
প্রতিনিধি জেনো সে আল্লার। আত্মসচেতন, দৃঢ়
সংগ্রাম-সংঘাতে তিক্ত চিরদিন সে অপরাজেয়
বিরাট দায়িত্বভার নিয়ে চলে পূর্ণতার পথে;
মানে না সে পরাজয় জীবনে কখনো। হতোদ্যম
হয় না সে কোনদিন দ্বন্দ্বে ইব্‌লিসের।

ইব্‌লিস
বহুবার
সে তীব্র দ্বন্দ্বের মুখে উড়ে গেছো; তবু অন্তহীন
ঔদ্ধত্য গেলো না।

বনি আদম
তবু অন্তহীন প্রস্তুতি আমার
এ মাটিতে,…জ্বেহাদের মাঠ বলে চিনি আমি যাকে।
দুর্গম অরণ্যচারী মুক্ত সিংহ সন্ধ্যায় যেমন
হানা দেয় শঙ্কাহীন, সুকৌশলী শিকারের ‘পরে;
নিঃশঙ্ক আমার প্রাণ তেমনি জঙ্গের ময়দানে
জানে না, মানে না, ভীরু সমর্পণ-পলায়নী রীতি।
যত আসে হিংস্র বাধা, প্রতিরোধ; জাগে তত প্রাণে
সত্যের বিশাল দাবী; সংগ্রামের প্রয়াস অশেষ।
তুমি ক্লান্ত হতে পারো, ক্লান্ত আমি নই কোন দিন;
বংশপরম্পরা চলে এ মহান সংগ্রামের ধারা।

ইব্‌লিস
এখনো কি-স্বপ্ন দেখো?

বনি আদম
এখনো যে স্বপ্ন দেখি আমি
সে স্বপ্ন অজ্ঞাত নয় আলমে আল্লার।

ইব্‌লিস
বাতুলতা
নয় কি তোমার? দুনিয়া কারবালা মাঠে মিশে গেছে
যে স্বপ্ন বালুতে, সে স্বপ্ন জাগাতে চাও শতাব্দীর
ঘূর্ণাবতে এই? আদমের আউলাদ, কী উদগ্র
আকাক্ষা তোমার?

বনি আদম
যে আকাক্ষা টেনে আনে প্রতি রাত্রে
তোমাকে,…আমার পদপ্রান্তে।

ইব্‌লিস
পরাজিত শক্তি তুমি,…
এ কথা ভুলো না কোনদিন।

বনি আদম
পরাজিত নই আমি।
টমাড় শূটিব্র দ্বন্দ্ব,- বলেছি তো জোগায় প্রেরণা
নবতর।

ইব্‌লিস
অস্বীকার কর কেন, পরাজিত নও!
পূর্ণ মানবতা আজ দুঃসাহসী তোমার মনের
উন্মত্ত কম্পনা শুধু! দেখনি কি ইঙ্গিতে আমার
কপট মুখোশে আজ শবগন্ধী এ পাশবিকতা
অপমৃত্যু খোঁজে কোন্ জড়বাদী পিশাচের কাছে?
লক্ষ কোটি ভ্রূণ হত্যা কেন আজ নরহত্যা নয়?
ক্লেদাক্ত, বিকৃত কেন অর্ধনগ্ন এ চিত্র-সভ্যতা?
মুক্তি স্বপ্ন নয় সে কি স্বকপোল-কল্পিত তোমার?
যৌন বিকৃতির পঙ্কে করিনি কি জ্ঞানীর জগৎ
পূতিগন্ধময়? বিকৃত সভ্যতা আর মৃত্যুমুখী
কৃষ্টির পঙ্কিল স্রোতে শ্বাসরুদ্ধ করিনি কি আমি
বন্দী জনতাকে? ঘৃণ্য সেই পাশবতা আনিনি কি
শ্রান্ত এ শোষণ-রিক্ত, প্রবঞ্চিত, পৃথিবীর বুকে?
দেখনি কি দুনিয়ার প্রতি পথে, প্রত্যেক শড়কে
দানবিক স্বৈরাচারে অপমৃত্যু মানবিকতার?
শোষিত, লুষ্ঠিত কিম্বা ঘঁচে-ঢালা আড়ষ্ট, বিবশ,
বিকলাঙ্গ এ জীবন লক্ষ্যভ্রষ্ট প্রেতাত্মার মত
মরে না কি শান্তিহীন ব্যক্তি আর ইন্দ্রিয়পূজায়?
শতাব্দীর অন্ধকারে উজ্জীবিত নয়া ফেরাউন
ছিঁড়ে কি ফেলেনি তার হিংস্র নখে মূক জনতার
বিমূঢ় জিজ্ঞাসা? আর লৌহ যবনিকা অন্তরালে
মানুষের মুক্তবুদ্ধি আত্মঘাতী হয়নি কি আজও?
শোষণের লুব্ধগ্রাসে ব আশা, আশ্বাস হারিয়ে
আদমের আউলাদ লক্ষ, কোটি মানুষ এদিকে
ত্রস্ত কি হয়নি? শুধু একমুষ্টি অন্ন প্রত্যাশায়
আমার চক্রান্তজালে লক্ষ নারী দেয়নি কি দাম
সতীত্বের? লক্ষ শিশু কারুণের জিন্দানখানায়
হয়নি কি জন্মদাস? লক্ষ কোটি বন্দী তরুণের
রক্তে তৃপ্ত করিনি কি পুঁজিবাদী পাশবিকতার
বীভৎস পিপাসা? তবু কি ধৃষ্টতা আদম-সন্তান,
আমার চক্রান্তে ঘেরা মৃত্যু-তিক্ত পৃথিবীর বুকে,
কারুণের বেষ্টনীতে হতাশ্বাস পৃথিবীর বুকে,
ফেরাউনী অত্যাচারে দীর্ণ এই পৃথিবীর বুকে,
কল্পিত জান্নাতে আজ পেতে চাও তৌহিদী আলোয়
শোষণ-সন্ত্রাসমুক্ত, প্রাণদীপ্ত, পূর্ণাঙ্গ সমাজ?
শৃঙ্খলিত করেছি যে পথভ্রান্ত মূক জনতাকে
পেতে চাও তাকে তুমি মুক্তির জ্বেহাদে? কী বিশ্বাস
তোমাকে করেছে দৃঢ় পাহাড়ের মত? কোন্ আলো
তোমাকে দেখায় পথ রাত্রির সন্ত্রাসে? কোন্ স্বপ্নে
গড়ে যেতে চাও তুমি পৃথিবী নূতন? শকুনির
যে স্বভাব, যে স্বভাব পিশাচের,- সে স্বভাব আমি
সঞ্চারিত করিনি কি তোমাদের মাঝে? দুনিয়াকে
দু’ভাগে দ্বিখণ্ড ক’রে মারিনি কি খোদার শান্তিকে?
শেষ করিনি কি আমি মানুষের শেষ সম্ভাবনা?
তবু বলো পরাজিত নও!

বনি আদম
পরাজিত নই তবু।
তবু বলি নিঃসংশয়ে,- ফেরাউন, কারুণের ব্যূহ
যেখানে দ্বিখণ্ড হ’য়ে জাগে আজ দীর্ণ মানবতা,
সেই চক্রান্তের বুকে প্রশান্তির নবীন নকীব
তুলেছে নতুন ধ্বনি তৃতীয় শক্তির। সে মাটিতে
দেখি বিশ্ব মানুষের পূর্ণ সম্ভাবনা। জানি আমি
সূলনের এ অধ্যায় তিক্ত, তিক্ততম; জানি আমি
মুষ্টিমেয় নারী নর নিম্নস্তরে পাশবিকতার
মানুষের সত্তা ভুলে জীবনের খোঁজে সার্থকতা
স্বার্থপরতার চক্রে, ছায়াচ্ছন্ন রাত্রির পর্দায়
ইব্‌লিসের অনুগামী চলে আজও বিচিত্র মুখোশে
নর-রক্তপায়ী কিংবা রক্ত-লোভাতুর। তবু জানি
বিকৃতির এ অধ্যায় বিভ্রান্তির প্রতিচ্ছায়া শুধু।
বিকৃত ‘সভ্যতা’ আর মৃত্যুমুখী পঙ্কিল কৃষ্টির
ঘূর্ণাবর্তে তবু আমি নই হতাশ্বাস। এ বিকৃতি
অতিক্রম ক’রে যাব আমি। প্রাণস্পর্শ দেব আমি
প্রাণহীন জনপদে। নব কৃষ্টি, সভ্যতা নূতন;
নূতন পৃথিবী আমি গ’ড়ে যাব রসূলের রাহে।

ইব্‌লিস
সে দীপ্ত প্রাণের কথা কেন বলো? কারবালা ময়দানে
দীর্ণ যার স্বপ্নসাধ রাজতন্ত্রী এজিদী খঞ্জরে,
বিলুপ্ত করেছি তাকে আমার অসংখ্য মতবাদে
শতাব্দীর অন্ধকূপে।

বনি আদম
তোমার অসংখ্য মতবাদ
ব্যক্তিপূজা, রাষ্ট্রপূজা, আত্মপূজা, স্বার্থপূজা নিয়ে
প্রতীক পূজার সাথে। ধরা পড়ে গেছে এ জাহানে
অন্তঃসারশূন্য; ম্লান। ফাঁকা আওয়াজের কারসাজি
ঝাণ্ডা তুলে বহুবিধ দিতে কোন পারেনি সুরাহা।
সংখ্যাহীন সমস্যায়। সাম্য, মৈত্রী, শান্তি, স্বাধীনতা
আত্মার আলোচ্যুত জড়বাদী এই পৃথিবীতে
পায়নি সাফল্য খুঁজে। প্রশান্তির দিকচক্র শুধু
সরে গেছে দূরে, দূরান্তরে। তোমার বীভৎস মতবাদ
রঙিন খোলসে শুধু বিভ্রান্ত করেছে জনতাকে,
বর্ণ-গোত্র-অঞ্চলের প্রশ্নে শুধু ক’রেছে বিক্ষত
মানুষের শান্তি, আশা;- শাণিত নখরে। আজ তাই
মৃত্যু তিক্ত অবিশ্বাস ‘প্রগতির’ পথে।

ইব্‌লিস
মানুষের
মস্তিষ্কে, হৃদয়ে, প্রাণে, অন্ধকার- সংশয়ের বীজ
বপন করেছি আমি কত যত্নে, জানো না সে কথা
ক্ষণজীবী পৃথিবীতে অনভিজ্ঞ তুমি জানো না তা
দীর্ঘ যুগ-যুগান্তের সেই শ্রম, প্রয়াস আমার
ফুলে ফলে সুশোভিত শতাব্দীর বিষ-বৃক্ষ সেই
অপমৃত্যু এনেছে কিভাবে। জিব্রাইল, মিকাইল
জান্নাতী ফেরেশতা যত দেখেছে তা শঙ্কিত বিস্ময়ে
সময়ের তীরে! মানুষের ইতিহাস-কলঙ্কিত
সে কাল কাহিনী, কলঙ্কিত দেখে আরও ভ্রাতৃরক্তে,
হত্যায়, লুণ্ঠনে, পাপে, ব্যভিচারে, শোষণে, ঈর্ষায়,
ফিরে গেছে বেদনার্ত তারা। মানুষের পৃথিবীতে
আমি জাগি শবের প্রহরী। প্রত্যয়ের এক বিন্দু
পাবে না এ পকিল ধরায়। সংশয়িত মানুষের
ব্যক্তি বা সমাজসত্তা দিশাহারা তিক্ত অবিশ্বাসে
হারায়েছে মূল লক্ষ্য ইব্‌লিসের অভিজ্ঞ কৌশলে।

বনি আদম
তোমার ফাঁকির চক্র, তোমার কৌশলী মতবাদ
রাত্রির আলেয়া যেন মিথ্যাময়ী,- নিষ্প্রভ, এখন
স্পষ্ট দিবালোকে। হিংসা-হিংস্রতার ছুরি ঢেকে রেখে
শান্তির খোলস মুখে প্রতারক, প্রভুত্ব পিয়াসী
প্রচার করেছ যত মিথ্যা বুলি, ধরা পড়ে গেছে
সম্পূর্ণ স্বরূপ তার এ বিশ্ব জগতে!- ঘূর্ণমান
মানুষের এ মিছিলে রসূল এসেছে বারেবারে।
অগণ্য যাত্রীকে তারা নিয়ে গেছে সত্যের মঞ্জিলে,
পথের দিশারী- পৃথিবীতে। মানুষের ইতিহাস
কলঙ্কিত নয় তাই শুধু পাপ-পঙ্কিল প্রবাহে।
সেখানে ঔজ্জ্বল্য আছে, আছে দীপ্ত পূর্ণ পরিচয়
আশরাফুল মখলুকাত ইনসানের। বনি আদমের
মহান ভ্রাতৃত্বে, ত্যাগে, সততায়, সগ্রামে, শান্তিতে
প্রেমে ও প্রজ্ঞায় দীপ্ত সমুজ্জ্বল সে পুণ্য কাহিনী;
নতমুখ ইব্‌লিস যেখানে।- জমানার ঘূর্ণাবর্তে
সব আলো নিভে গেলে অন্ধকারে জ্ব’লেছে আবার
সিরাজাম মুনীরার দীপ্ত শিখা অনির্বাণ তেজে
বহু বর্ষ আগে; তবু প্রোজ্জ্বল ভাস্বর দু’জাহানে।
পেয়েছে বিভ্রান্ত যাত্রী মঞ্জিলের দিশা তারা খুঁজে
সে সত্য আলোকে! দিকে দিকে আজ তাই উঠে আসে
নয়া জিন্দেগীর খোঁজে নারী-নর তৌহিদী আলোকে;
আখেরী নবীর পন্থা একমাত্র কাম্য যে তাদের।

ইব্‌লিস
বিলুপ্ত যে ইতিহাস টেনে এনে চাপা দিতে চাও
ব্যর্থতা নিজের, তাতে সুফল কি পেয়েছ এখানে
স্মৃতি রোমন্থনে মুগ্ধ…অথবা ঐতিহ্যসচেতন
কম্পলোকাচারী, অর্বাচীন! বলেছি তো আমি আগে
সে স্বপ্ন বিলীন আজ কারবালায়,- এজিদী খঞ্জরে।

বনি আদম
কে বলে বিলুপ্ত সেই ইতিহাস আদর্শবাদের
দশ্তে কারবালায়? মৃত্যু নাই আদর্শের। মৃত্যুহীন
শহীদের অনুসারী যে মুমিন, পায় সে প্রেরণা
মৃত্যুঞ্জয়ী শহীদের প্রাণবন্ত সে আদর্শ থেকে
চিরদিন। এজিদী খঞ্জরে তার শঙ্কা নাই কোন।
ফেরাউনী অত্যাচারে সে দাঁড়ায় কালীমের সাথে
ভয়শূন্য নীল নদী তীরে। নমরুদের জিন্দানে সে
নির্ভীক সংগ্রামী সত্তা ইব্রাহিম খলিলের মত
চায় শুধু মদদ খোদার। তাই বিশ্ব মানুষের
নব সম্ভাবনা দেখি দুনিয়া জাহানে। দেখি আমি
খিলাফতে রাশেদার পূর্ণ সম্ভাবনা।

ইব্‌লিস
কী অলীক
সে কম্পূনা!

বনি আদম
সকল দিগন্ত জুড়ে যে পারে জ্বালাতে
সকল ঘুমন্ত সূর্য, দিতে পারে পূর্ণতার আলো
-ব্যক্তির, ব্যষ্টির কিংবা পৃথিবীর সব মানুষের
সমস্যা-সঙ্কুল পথে, ঘূর্ণাবর্তে, তরঙ্গে, তুফানে,
-সে মানবতার রশ্মি যদি আজ থাকে অন্তরালে
মনে রেখো সুপ্ত শক্তি মিথ্যা নয় তার।

ইব্‌লিস
আশাবাদী
তুমি কিন্তু যে আশার পটভূমি অবাস্তব আজও,
সেখানে দুরাশা এই নৈরাশ্যের কাল ছায়া শুধু।
নিষ্ক্রিয়, হতাশাগ্রস্ত নারী-নর অবসন্ন, আর
স্তব্ধগতি যেখানে সমাজ, কিভাবে সেখানে তুমি
আশা করো মানুষের অন্তহীন সম্ভাবনা,- সেই
খিলাফতে রাশেদার পরিপূর্ণ জীবনপ্রবাহ?

বনি আদম
কেন বলো অসম্ভব প্রতীক্ষিত সে জীবন, আর
সেই সত্য খিলাফত এ পটভূমিতে? প্রভাতের
দুয়ারে সঞ্চিত যত হোক্ না সে কুহেলি নিবিড়
দীর্ণ করে তবু তাকে শক্তিমান ভোরের শিকারী
আফতাব। নিঃশক সূর্যের রশ্মি রাত্রির মিনারে
তীব্র সংঘর্ষের শেষে জ্বালে তবু সুবে উম্মীদের
স্বর্ণশিখা অমলিন,- সাময়িক অবসাদ শেষে।
আঁধারে ছিল যে সুপ্ত, সংগোপনে,- সে আত্মবিস্মৃত
আকাশের শামাদানে অনুভব করে সে তখন
সুসম্পূর্ণ জীবনের ভূমিকা বিশাল। জেহাদের
অগণ্য সংঘর্ষ মাঝে দেখে সেই পূর্ণ কামিয়াবি
সত্যের দুর্গম পথে চলে আজ এ বনি আদম;
অসম্ভব নয় তাই মানুষের পূর্ণ সম্ভাবনা।

ইব্‌লিস
কেন অসম্ভব নয়? অচেতন যেখানে সমাজ
কিভাবে সেখানে তুমি এনে দেবে বহ্নি চেতনার?
কি অস্ত্রে ভাঙাবে তুমি শতাব্দীর নেশাগ্রস্ত ঘুম?
উজ্জ্বল উল্কার মত মানুষের মুক্ত পথ থেকে
স্খলিত যে মিশে গেছে দুর্নীতির ঘূর্ণি ও তুফানে
সহস্র পঙ্কিল পাপে- আজ তার আশা নাই, ভাষা
অর্থহীন- উন্মত্ত প্রলাপ। সহানুভূতির স্পর্শ
দেখে না সে কোনখানে, প্রাণহীন স্বার্থবুদ্ধি তার
জ্বেলেছে হাবিয়া তীব্র নীতিভ্রষ্ট পৃথিবীর বুকে
স্বস্তিহারা;- শান্তিহীন। অন্ধ অনুকরণের দাস
বিকায়ে নিজের সত্তা হারায়েছে স্বকীয়তা: আর
মিশে গেছে চক্রে ইব্‌লিসের।

বনি আদম
এ কথা আংশিক সত্য।

ইব্‌লিস
পূর্ণ সত্য এই। আত্মপ্রবঞ্চিত, ধূর্ত, জ্ঞানপাপী
বুঝেও বোঝ না তুমি! দেখ না কি চক্রান্তে আমার
মুসলিম মিল্লাত আজ দিশাহারা, কী কূট কৌশলে
হারায়ে জীবনাদর্শ চলে কোন মৃত্যুর প্রান্তরে,
শতধা বিচ্ছিন্ন; দেখ না কি কূটচক্রে ইব্‌লিসের
সে আত্মবিস্মৃত মরে পথভ্রান্ত, পরানুকরণে!
ব্রাহ্মণ্যবাদের ক্লেদ, ক্লেদ যত ফিরিঙ্গিয়ানার
নির্লজ্জ নগ্নতা নিয়ে জমে তার নিস্ক্রিয়, নিঃসাড়
জিন্দেগীতে,- প্রতিহত তার গতি ইহুদীর চালে!
হারায়ে শক্তির উৎস শিকার সে সাম্রাজ্যবাদের!
আখেরী নবীর পথ-বিচ্যুত সে করে আমদানী
বিজাতীয় মূল্যবোধ আপ্রাণ প্রয়াসে! আনে ভ্রান্ত
মিথ্যা আর মারী বিষ সঠিক দ্বীনের বিনিময়ে!
আমার সাফল্য এই।- দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ছিন্ন, সংশয়িত
মুসলিম জাহানে ঐক্য অবশিষ্ট রাখি নাই কোন,
রাখি নাই মুক্তির সরণি। নৈরাশ্যের অন্ধকারে
মিটায়েছি তার শেষ আশা।…লক্ষ্যহীন মিল্লাতের
এ ভূমিকা ভুলে ফের মুক্তি চাও, কোন্ তরিকায়,
কার পথে? দিবাস্বপ্ন রচনার এ স্বভাব তুমি
ভোলো মূখ; ভুলে যাও আজ।

বনি আদম
এ স্বভাব মানুষের।
নবীর তরিকা চিনে যে স্বভাব চায় অগ্রগতি
মুক্ত শাহীনের মত, গোলামীর জিঞ্জির ছাড়িয়ে
যে চায় প্রদীপ্ত গতি ঊর্ধ্ব হ’তে আরো ঊর্ধ্ব স্তরে;
ক্ষুদ্র সংকীর্ণতা ছেড়ে বর্ণ-গোত্র-ভাষা-অঞ্চলের
তামাম আলমে চায় গ’ড়ে নিতে মুক্ত জাতীয়তা
মুজাহিদ- যে মর্দে মোমিন;- বিশ্বভ্রাতৃত্বের ডাকে
পরিপূর্ণ ইনসাফ, সত্য আর ন্যায়ের দাবীতে
আল্লার প্রভুত্ব মেনে অস্বীকার করে যে বাতিল
ইব্‌লিসের ভ্রান্ত মত, কূটচক্র, কর্তৃত্ব অলীক;-
ঝঞ্ঝা, ঝড়ে, ঘূর্ণাবর্তে বিদ্যুতের চেয়ে দীপ্যমান
এ স্বভাব সেই মোমিনের। এ স্বভাব বিপ্লবীর
বিপ্লবে মহান।…সত্যাশ্রয়ী মানুষের এ স্বভাব
আগ্নেয় প্রেরণা দেয় অসত্যের বিপক্ষে দাঁড়াতে,
অন্যায়ের টুটি টিপে মারে যে, অসাম্য পিষে পায়ে
মানুষের যে স্বভাব জেহাদের ঝাণ্ডা ব’য়ে চলে
নতুন দিগন্ত পানে অভিযাত্রী সেই!- দেখ চেয়ে
মরক্কোর তীর থেকে দ্বীপপুঞ্জে ইন্দোনেশিয়ার
ঘুমের অরণ্য জ্বলে চেতনার সে তীব্র আগুনে
লেলিহান। দেখ চেয়ে সংখ্যাহীন সিংহ শাবকেরা
জেহাদী আগুনে সেই নিতে চায় সব প্রাপ্য খুঁজে!
বিক্ষোভ মিছিলে কিংবা শব্দহীন মূক জনপদে
দেখ সেই ইনসাফ, ঐক্য, শান্তি, সত্যের অন্বেষা!

ইব্‌লিস
বহু রাত্রি, বহু বাধা পথে আছে তার।

বনি আদম
জানি আমি
মুক্ত প্রভাতের পথে জানি আমি, জানি আমি আরো
বহু শ্রম, বহু রক্ত, জেহাদের সংখ্যাহীন মাঠ
পড়ে আছে। তবু শ্রান্ত নই আমি, সঙ্গী জেহাদের
ক্লান্তি সে মানে না; তার কোন দিন পরাজয় নেই।

ইব্‌লিস
ক্লান্ত আমি। তবু আজ এই প্রশ্ন তোমাকে শুধাই
সংগ্রামী তোমার সত্তা দেখে না কি ছায়া ব্যর্থতার?

বনি আদম
ঝড়ের বিপক্ষে ওড়ে যে ঈগল,- সে বিহঙ্গ আমি!
সমুদ্রের প্রতিরোধ চূর্ণ করে যার উন্মাদনা
সে তিমির প্রাণোচ্ছ্বাস মর্মমূলে সঞ্চিত আমার
নিরন্তু রাত্রির বক্ষ দীন করে সুতীব্র রশ্মিতে
যে তারা, আমি সে দীপ্ত নক্ষত্র;- সঘন অন্ধকারে
চিন্তার জটিল বিশ্বে করি তীক্ষ্ণ আলোকসম্পাত।
সূচীভেদ্য অন্ধকারে, নিষ্প্রাণ প্রান্তরে জনহীন
আবে-হায়াতের খোঁজে যে খিজির সঙ্গীহীন একা
নির্ভয়ে আল্লার নামে পাড়ি দেয় বিজন প্রান্তর,
সংকটে যে ধৈর্যশীল, জেহাদে যে দুর্জয় নির্ভীক,
আমি তার অনুবর্তী। সংগ্রামের আগুন আমার
প্রাণকেন্দ্রে; ধমনীতে জ্বলে তার শিখা লেলিহান।
মৃত্যুকে করি না ভয়, অগ্রগামী জীবনের পথে
নিষ্কম্প আমার প্রাণ করে নিত্য সংগ্রাম সূচনা,
অসত্যের অন্ধকূপে কিংবা তিক্ত অন্যায়ের মুখে
শক্তিমান করে বাহু আঘাতে; সুতীব্র প্রতিঘাতে।
যত পথে বাধা পড়ে, দৃঢ় হয় শত্রু ব্যূহ যত,
সংকটের মৃত্যু মেঘ হ’য়ে আসে যত ঘনতর,
যত আসে হিংস্র ঝড় বার্তা নিয়ে বজ্র বিদ্যুতের
আমার সংগ্রামী সত্তা তত তাকে স্বাগত জানায়।
যতবার বাধা পাই ততবার জাগে এই প্রাণে
নয়া জেহাদের মাঠে নবতর সংগ্রামী চেতনা;
যত দেখি বিফলতা পাই তত সাফল্য-আশ্বাস।
যে পৃথিবী কাঁদে আজ কারুণের লুব্ধ বেষ্টনীতে,
যে সমাজ বিকলাঙ্গ শাদ্দাদের চক্রান্তে,- যেখানে
নমরুদের ব্যভিচারে শ্বাস রুদ্ধ হয় প্রতিক্ষণে,
জাগে দর্পী ফেরাউন ক্ষমতা-লোলুপ অন্ধকারে;
সেখানে বিভ্রান্ত সেই মানুষের পৃথিবীতে আজ
আমি চলি জালিমের মৃত্যু-বার্তা নিয়ে। সে মাটিতে,
সব শৃঙ্খলিত মাঠে করি মুক্ত আলোক-সম্পাত,
ব্যক্তি আর সমাজের পূর্ণতার বাণী ব’য়ে চলি
নবীর উম্মত আমি;…ইনসানের উত্তরাধিকারে।
আমি চলি ইনসানের শেষহীন সম্ভাবনা নিয়ে।
তোমার সুতিক্ত দ্বন্দ্ব তীব্রতম হোক, তবু জেনো
এখানে মাটির বুকে সর্বশেষ জয় মানুষেরি।

ইব্‌লিস
যারা যুদ্ধ চায়, যারা বিপর্যয় আনে পৃথিবীতে
তুমি যে তাদের;- তবে এ কথা কোরো না অস্বীকার।

বনি আদম
অস্বীকার করি আমি। পৃথিবীতে শান্তির পশরা
চূর্ণ ক’রে যায় যারা, জনপদে অবিশ্বাস আনে,
-আমি যে তাদের নই, এ কথাও তুমি ভালো জানো,
তবু ধূর্ত বিতর্কের অবসরে স’রে যাওয়া জানি
পলায়নী স্বভাব তোমার। যে সরণি জ্বেহাদের,
যে সংগ্রাম বিশ্বব্যাপী প্রশান্তির খোজে,- জালিমের,
জড়বাদী প্রেতাত্মার অত্যাচার সমূলে জ্বালিয়ে
চায় যে প্রশান্তি; পূর্ণ মানবতা; অজানা সে নয়
অন্তত তোমার কাছে- ইব্‌লিস! কূটবুদ্ধি তুমি

ইব্‌লিস
রাত্রি শেষ হয়ে আসে প্রভাতের তীরে। সংকটের
হিংস্র অন্ধকারে ফের দেখা হবে।

বনি আদম
সব অন্ধকারে, সকল সংকটে পাবে- ইব্‌লিস! প্রস্তুত আমাকে।

(ভোরের আজানে ইব্‌লিসের অন্তর্ধান)