বিতর্কিত ও অবিতর্কিত

এখন বাঙলাদেশে সম্ভবত একজন ছাড়া বাকি সবাই অবিতর্কিত। সবাই সকলের কাছে গৃহীত ও শ্রদ্ধেয়। কেরানি ও কর্তা, চোর ও দারোগারা অবিতর্কিত, সন্তান ও মন্ত্রী, গোলাপ ও গোলামেরা অবিতর্কিত, চাষী ও কবি, সাংবাদিক ও উপন্যাসিকেরা অবিতর্কিত; সবচেয়ে সুখের কথা মূর্খ ও মহাপুরুষেরাও অবিতর্কিত। শ্রদ্ধেয়, গৃহীত। যে-সমাজের সবাই এমন সুন্দর সুচারুরূপে অবিতর্কিত, শ্রদ্ধেয় গৃহীত, তাকে যদি চতুষ্পদ প্রাণীর সমাজ বলি, তাহলে বিতর্কের অবকাশ নেই। অপরাধ পর্ব এখানে কোনো শেষ নেই; এ-সময়টিকে বাঙলাদেশের ইতিহাসের অপরাধ পর্ব মনে ক’রে পথে পথে আমরা অপরাধ ক’রে চলেছি; কিন্তু সাবধান থাকছি যাতে গাছে কোনো বিতর্ক সৃষ্টি করে না ফেলি। বিতর্ক সৃষ্টি খুব খারাপ ব্যাপার; তাতে শত্রু তৈরি হয়, গৃহীত শ্রদ্ধেয় সুওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যায়। রাজনীতিক সাবধান থাকে যাতে সে কোনো বিতর্ক তৈরি ক’রে না ফেলে; তাতে তার বর্তমানভবিষৎ ঝরঝরে হয়ে যাবে। বুদ্ধিজীবী সাবধানে পাহারা দেয় নিজেকে, যাতে তার মুখ আর কলম থেকে এমন কিছু না বেরোয়, যা তাকে বিতর্কের আগুনে জ্বলি পুড়িয়ে মারবে।

সমাজ এখন নানা প্রজাতির মহাপুরুষে ভ’রে গেছে। মহাপুরুষেরা সবাই অবিতর্কিত থাকার সাধক; অবিতর্কিত বটবৃক্ষের নিচে ব’সে তারা অবিতর্কিত সত্য লাভের আপ্রাণ চেষ্টা ক’রে চলছেন। এদের সমষ্টিগত সাধনায় বাঙলায় চতুস্পদী সমাজ প্রায় প্রতিষ্ঠিত। সমাজ সম্পর্কে যখন কথা বলেন মহাপুরুষেরা, কথা বলেন সাবধানে; রাষ্ট্র সম্পর্কে সাবধানে, ইতিহাস সম্পর্কে সাবধানে, ধর্ম-শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে কথা বলেন সাবধানে। পাঁচ-ছ দশক আগেও আমাদের পূর্বযাত্রীরা মুখ খুলে বিতর্ক করেছেন, কেউ কেউ শিকার হয়েছেন সমাজের মূর্খ আক্রোশের, তবুও তাঁরা বহু বিষয়ে কথা বলেছেন। এখন ওই সব কথা বলার সাহস কেউ করে না। জীবন বিপন্ন হ’তে পারে; তার চেয়ে বড়ো কথা জীবনের সোনালি স্বার্থ বিপন্ন হ’তে পারে। যে-সমাজে কোনো বিতর্ক নেই, সে-সমাজ মিথ্যায় আক্রান্ত; যে-সমাজে কেউ বিতর্কিত কথা বলে না বা বিতর্কিত কাজ করে না, সে-সমাজ সমর্থিত মিথার পায়ে। এমন সমাজ পরখ না ক’রে মেনে নেয় প্রচলিত বাজে কথা; এবং তা প্রচার করে বিভিন্ন মাধ্যমে। বিতর্কহীন সমাজের মন ও মস্তিষ্ক পুরোপুরি নিষ্ক্রিয়, সেখানে কুকুরের মতো জেগে থাকে শুধু স্বার্থ। অমন সমাজ পশুধৰ্মীর সমষ্টি; অমন সমাজের মহাপুরুষেরাও সামান্য মানুষ। তাঁদের পক্ষে নতুন ও অসাধারণ কিছু সৃষ্টি করা অসম্ভব। এটা দেখতে পাই আমাদের সমাজে। যারা মহাপুরুষের মুখোশ প’রে আছেন চারদিকে, তাঁরা খুবই ক্ষুদ্র মানুষ। এমন সমাজে পণ্ডিত হয়ে ওঠেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভৃত্য, সৃষ্টিশীল লেখক হয়ে ওঠেন ফরমাশি পণ্য সরবরাহকারী, রাজনীতিক হয়ে ওঠেন গোলাম, দার্শনিকবিজ্ঞানীর উদ্ভবই ঘটে না। রোকেয়া কিছু কথা বলেছিলেন, যা এখন বললে তাঁকে চৌরাস্তায় অপদস্থ হ’তে হতো। নজরুল বলেছিলেন এমন সব মারাত্মক কথা, যা এখন বললে তার পক্ষে জাতীয় কবি হওয়া দূরে থাক, বেঁচে থাকাই কঠিন হতো। এখন আমরা অমন মারাত্মক কথা বলি না। রাষ্ট্র ও সমাজকে ক্ষেপিয়ে তোলার মতো বোকামি তো করিই না, এমন কি একটি দুষ্ট লোককেও রাগাই না। তার শক্তি আছে; আর সে ক্ষতি ও স্বার্থ বিপন্ন করতে পারে।

অবিতর্কিত সমাজ পুনরাবৃত্তিপ্রাণ; সে-সমাজের একশো বছর এক বছরের একশোবার পুনরাবৃত্তি মাত্র। এতে বয়স বাড়ে, আর কিছু বাড়ে না, কমে। সে-সমাজই সামনের দিকে এগোয়, যে-সমাজ দশকে দশকে জন্ম দেয় বিতর্কিত মানুষ, যারা সব কিছু সম্পর্কে প্রশ্ন তোলেন। আমাদের দেশে মুসলমান সমাজে প্রশ্ন তোলা ভয়ংকর ব্যাপার। শুধু যে প্রথাগত বিশ্বাসগুলো সম্পর্কেই প্রশ্ন তোলা ভয়ংকর, তাই নয়; যে-সমস্ত ব্যাপারের সাথে অন্ধ বিশ্বাসের কোনোই সম্পর্ক নেই, সে-সম্পর্কেও প্রশ্ন তোলা বা নতুন মত প্রকাশ করা যায় না। রাজনীতিক স্বৈরাচারের মতো অপবিশ্বাসের স্বৈরাচারও জাতিকে শেকল পরিয়ে বন্দী ক’রে রাখে। এ-ক্ষেত্রে বন্দী হয় জাতির সৃষ্টি ও মননশীলতা। একটি উদাহরণ দিই। নজরুল সম্পর্কে আমি একটি মন্তব্য করেছিলাম, আমার মন্তব্যটি প’ড়ে বোঝারও আগ্রহ কেউ বোধ করেনি, কিন্ত্র মেতে উঠেছিলো অনেকেই। তারা নজরুল সাহিত্যও পড়ে নি, আমার মন্তব্যও পড়ে নি। তারা অন্ধভাবে আক্রমণে উদ্যত হয়েছিলো নতুন বক্তব্যকে। সাহিত্যকেই এখন ঠিক মতো বিচার করা কঠিন; যে-সব বিশ্বাস মানুষকে পুরোপুরি অন্ধ ক’রে ফেলে, সেগুলোকে পরখ করার কথা ভাবাও যায় না। পরখ করার সাহস করতে পারেন শুধু যারা প্রকৃতই মহাপুরুষ, যারা নিজেদের বিপন্ন ক’রে তুলতে ভয় পান না। পৃথিবীর অধিকাংশ মহাপুরুষ এখনো বিতর্কিত, কোনো গাধা সম্পর্কে পৃথিবীর কোনো প্রান্তে কোনো বিতর্ক নেই। ধর্মপ্রবর্তকদের নিয়েও বিতর্ক দেখা দেয়; প্লাতোকে এখনো প্রতিদিন অনেকেই, বাতিলের চেষ্টা করে, মার্ক্সকে শারীরিকভাবে আক্রমণের চিন্তা করে অনেকে, রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে ক্ষোভের শেষ নেই অনেকের। বিতর্কিত ব্যক্তিরা পৃথিবীকে বদলে দেয়, অবিতর্কিতরা উপভোগ করে, যেমন চতুষ্পদগন উপভোগ করে খড়-বিচুলি-ঘাস।

বাঙলায় অসংখ্য বিতর্কিত মানুষ দরকার। প্রয়োজন বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বিতর্ক, জ্ঞানের এলাকায় বিতর্ক দরকার রাজনীতিক, দার্শনিক বিতর্ক; দরকার সামাজিক বিতর্ক, দরকার শিল্প-সাহিত্য-স্বপ্নের জগতে বিতর্ক। জীবিত মানুষের সব এলাকায় সব বিষয়ে শেষ সিদ্ধান্ত চিরকালের জন্যে গৃহীত হয়ে যেতে পারে না; এবং পারে না আমাদের মতো সমাজে, যেখানে অধিকাংশ এলাকায়ই গৃহীত হয়ে আছে অপসিদ্ধান্ত। প্রশ্ন তোলার জন্যে মগজ ও প্রতিভা দরকার; বিশ্বাসের জন্যে অন্ধ হ’লেই ভালো। প্রশ্ন তুললেই বিতর্কিত হ’তে হবে, হ’তে হবে আক্রান্ত; তাই আমাদের সমাজে বিতর্কিত মানুষের অভাব। কিন্তু সাহস ক’রে প্রশ্ন তোলা প্রয়োজন। এখানে মুখোশপরা মহাপুরুষদের একটি ভূমিকা রয়েছে। তারা যদি প্রশ্ন তোলেন, কিছুটা বিতর্কিত হন, তবে তরুণদের সাহস বাড়ে। তবে ওই মহাপুরুষেরা পালন করেছেন ক্ষতিকর ভূমিকা; তারা গৃহীত অপসিদ্ধান্তগুলোকে আউড়ে যাচ্ছেন মঞ্চ থেকে মঞ্চে, বন্ধ করে দিচ্ছেন তরুণদের সাহসী হওয়ার পথ। তাই মুখোশপরা মহাপুরুদের হাত থেকে মুক্তি প্রয়োজন। বাতিল ক’রে দিতে হবে তাঁদের। তারা ব্যক্তি থাকুন নানা প্রতিষ্ঠান ও সুযোগের সেবায়; আর দেখা দিক বিতর্কিত প্রতিভাবানেরা। স্বার্থ সত্য ও প্রতিভার বড়ো শত্রু। স্বার্থ বিপ্লবীকে ক্লীবে ও সিংহকে গাধায় পরিণত করে। ক্লীব ও গর্দভপর্বের পর বাঙলায় দেখা দিক বিতর্কিতরা, যারা আক্রান্তু হবে, কিন্তু ভ্রষ্ট হবে না।